ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর এক ঝলকে বর্তমান চীন 

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২ জুলাই ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর এক ঝলকে বর্তমান চীন 

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিনগুণ

ডলারের হিসাবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিনগুণ বড় হলেও বেজিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান জিকে ড্রাগনোমিক্সের এক কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে

আট জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে গিয়েছিলেন দু’হাজার চোদ্দয়। সেবার নির্বাচন নিয়ে টেলিভিশন টক শোয় বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। তার মধ্যেই সফর সম্পন্ন করেছিলেন তিনি এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নয়ন হয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে টেলিভিশন টকশোয় বিতর্কের পারদ যতই চড়ুক দাতাদের তাতে কিছু এসে যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের প্রপার এডুকেশন বা কালচারাল লেভেলের গুণগত মান যাচাইয়ে তাদের আগ্রহ নেই। তাদের মূল মনোযোগ ব্যবসা ও বিনিয়োগে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে সে সত্যকেই সমর্থন দিয়েছিল।
চীন গণতান্ত্রিক দেশ না হলেও গণতন্ত্র নিয়ে পুঁজিবাদী কেন্দ্রের ক্ষমতাধর দেশগুলোর রাজনৈতিক খেলা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিষ্কার ধারণা রাখে। তারা জানে নির্বাচনে সব দলের অংশ নেয়ার গণতন্ত্র আর এক দলের প্রাধান্যের গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক তেমন কোন পার্থক্য নেই।
কারণ গণতন্ত্র নামে পৃথিবীতে যে পদ্ধতি চালু আছে তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কোনকালেই অনুন্নত দেশের সাধারণ মানুষের হাতে ছিল না। শাসকদের হাতেই বা কতটুকু ছিল? বিশ্ব যারা নিয়ন্ত্রণ করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা যখন যে ফর্ম নিজেদের জন্য সুবিধাজনক মনে করে তখনকার জন্য সেটাই সেরা পদ্ধতিÑ তা মুখে তারা যাই বলুক। তবে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ‘গরিব’ দেশগুলোয় নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নানা ধরনের শর্ত চাপিয়ে তারা যেভাবে সরকার রদবদল করিয়ে এসেছে, নিজেদের দেশে এখন তারাও সে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাদের গণতন্ত্র এখন ব্যাংক মালিকদের হাতে। শর্তের পর শর্ত চাপিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যাংক মালিকরা অগ্রসর পুঁজির দেশগুলোতে সরকার বদলে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে।

পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির কেন্দ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা এখন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চীন। ডলারের হিসাবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিনগুণ বড় হলেও বেজিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান জিকে ড্রাগনোমিক্সের এক কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে অতিরঞ্জন নেই বলেই মনে হয়। কারণ বিশ্ব মুদ্রা মজুদের চল্লিশ শতাংশের বেশি রয়েছে চীনের কাছে। দু’হাজার পঁচিশ সালের মধ্যে দু’শ’ একুশটি নগর ও আটটি অত্যাধুনিক মেগাসিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার প্রতিটিতে জনসংখ্যা থাকবে দশ লাখ। চীনের অর্থনীতি লাফিয়ে এগোচ্ছে।

দু’হাজার দশের শেষ দিকে ডলারের হিসাবে তার অর্থনীতির আয়তন ছিল পাঁচ দশমিক আট ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলার। এক শ’ পঁয়ত্রিশ কোটি দশ লাখ জনসংখ্যার দেশ চীন বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভোক্তা। প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্য চীনকে তাই বিভিন্ন মহাদেশে অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে। আরও আছে। বিমানবাহী জাহাজ তারা সমুদ্রে ভাসিয়েছে সে খবর এখন পুরনো। সব শেষ খবর হলো, চীন দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন শুরু করেছে, যা সমুদ্রে চলমান জাহাজে আঘাত করতে সক্ষম। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বে এই প্রথম।

আর বিশ্ববাসীর জানা আছে বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মূলস্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে নৌশক্তির প্রদর্শনের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল। সুতরাং চীন কোথায় যাচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। 
দু’ হাজার বারো সালে চীনে অনুষ্ঠিত বিমান প্রদর্শনীতে তারা চালক বা মানুষবিহীন হেলিকপ্টার জেড-ফাইভ এবং চালক বা মানুষবিহীন বিমান ডব্লিউজে-সিক্স হান্ড্রেড প্রদর্শন করে যা রাডার ফাঁকি দিয়ে উড়তে সক্ষম।
চীনের এ দ্রুত এগিয়ে চলা ভূ-রাজনীতিকে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র আমূল পাল্টে দিতে পারে। এমনকি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের চাবি পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যের হাতে চলে আসতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন।
চীনের এগিয়ে চলাকে ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘পিভট টু এশিয়া’ কৌশল নিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ইত্যাদি দেশকে নৌশক্তি প্রদর্শনের জন্য ক্রমাগত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শতকরা আশি ভাগ জ্বালানি তেল আসে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাঝখানের মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগও এ পথে। এ পথ বন্ধ করে দিয়ে চীনকে বাণিজ্য ঝুঁকিতে ফেলাই যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য।

এ উদ্দেশ্যে তারা নৌশক্তির এক বড় অংশ দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই গোটা পরিকল্পনার নাম ‘পিভট টু এশিয়া’। এর বাস্তবায়নের জন্য দু’হাজার পনেরো সালে প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক কৌশলগত দলিল- ‘এ ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজি ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি সি পাওয়ার : ফরোয়ার্ড, এনগেজড রেডি। সংক্ষেপে সিএস ২১ আর। সিএস ২১-এ আরও বলা হয়েছে দু’হাজার বিশ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমান শক্তির শতকরা ষাট ভাগ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। চীনকে ঘেরাও করার জন্যই যে এ পরিকল্পনা তাও এতে স্পষ্ট করা হয়।

এ পরিকল্পনায় আরও রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান ও নৌযুদ্ধ এবং ভারত মহাসাগরে চীনের আমদানি-রফতানি যে কোন সময় আটকে দেয়া। দু’হাজার বারো সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে সে সময়ের মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও পেনট্টা যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির শতকরা ষাট ভাগ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করার কথা জানান। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। 
 চীন, ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশই এখন মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বসবাস এখানে। বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের দেশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এর পরের অবস্থানের দেশটি দক্ষিণ এশিয়ায় না হলেও এশিয়ায়। অর্থাৎ জাপান। চীন ও জাপানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা বাংলাদেশের জন্য তাই জরুরি। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন-জাপান সফর রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহের প্রকাশ বিভিন্ন সময় ঘটেছে।
এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দশ বছর থেকে তেরো বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড আরও তিন বছর বাড়ানোর অনুরোধ করবেন এবং কয়েকটি চুক্তি সম্পাদন করবেন বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়।  এছাড়া বাজেট ঘাটতি পূরণে আর্থিক সহায়তা এবং অর্থায়নের অনুরোধ করা হবে। দু’দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মাারক (এমওইউ)সহ এগারটি দলিল সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।

এগুলো হচ্ছে চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বাণিজ্য সহায়তা, বিনিয়োগ সুরক্ষা ডিজিটাল অর্থনীতি, সুশীল অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষার ঘোষণাও একাধিক মৈত্রী সেতু নির্মাণ ও সংস্কার। মূলতঃ এ সফরে দু’দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতি গুরুত্ব পাবে সবচেয়ে বেশি। আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। প্রকাশিত সংবাদে এসব তথ্য জানা যায়।
তবে সম্পর্ক স্থাপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও সেখানে পাহাড় সমান বৈষম্য রয়েছে। তারা শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য করছে বাংলাদেশে। এমন কোন চুক্তি যেন না হয় যাতে সব সুযোগ সুবিধা তাদের হাতে চলে যায়। যেমন ভারতের বেলায় হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে অনেক সুবিধা দিয়েছে কিন্তু গঙ্গা, তিস্তা ও অভিন্ন অন্য সব নদীর পানির সঠিকভাগ আজও পায়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের এ ন্যায্য চাওয়াকে ভারত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আসছে।

ওদিকে নিজেদের সুবিধা পুরোপুরি আদায় করে নিচ্ছে। চীন ভারত দু’দেশেরই বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি রয়েছে। তারা তাদের সুবিধা আদায় করতে নানা ধরনের কৌশলী অবস্থান বিভিন্ন সময়ই নেয়। মেরুদ- সোজা রেখে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে নিজের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে মুখোমুখি হতে হবে। বিশেষ করে চীন তার পররাষ্ট্রনীতিতে ধীরে ধীরে নিজের শক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে। একে আধিপত্যবাদের সফট সংস্করণ বললেও বলা যেতে পারে। যেমন দু’হাজার দশে তারা দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বীপমালার মালিকানা দাবি করার মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটিয়েছিল।

এসব দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাটানি চলছিল বহুদিন ধরে। দু হাজার দুইয়ে আসিয়ানের সঙ্গে চীন একমত হয় যে বিষয়টি বহু পক্ষীয়ভাবে মীমাংসা করা হবে। কিন্তু পরে চীন ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে জানায়, এ সমস্যার সমাধান হবে আলাদা আলাদা বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে।
আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক অবশ্যই রাখতে হবে তবে শক্তিধর দেশ দুটোর (চীন, ভারত) আধিপত্যবাদী প্রবণতার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

×