ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

ক্রিকেট ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২১:২৭, ১ জুলাই ২০২৪

ক্রিকেট ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব

সিডনির মেলব্যাগ

ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা এ কথাটা আমরা বিশ্বাস করতাম। এক সময় ছড়া কাটা হতো এই বলে- খেলার রাজা ক্রিকেট, রাজার খেলা পোলো। কালক্রমে রাজা গেছেন, রাজ্যও গেছে; কিন্তু খেলার রাজা ক্রিকেট বেঁচে আছে। সগৌরবে চলছে তার জয়যাত্রা। আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজদের দেওয়া দুটি জিনিস আমরা অনিবার্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। তাহলো রোজ সকাল-সন্ধ্যায় এক কাপ চা আর খেলা মানেই এখন ক্রিকেট।

কেন জানি উপমহাদেশের সব দেশই ক্রিকেটপাগল। এমনকি শ্রীলঙ্কাও। যাদের নাম বা ঐতিহ্যে পর্তুগিজীয় প্রভাব সর্বাধিক। উপমহাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি বিষয় ঢুকে আছে। তাহলে উন্মাদনা, জোশ আর পাগলামির সঙ্গে তীব্র বিরোধিতা। যার আরেক নাম সাম্প্রদায়িকতা। ভারত-পাকিস্তান খেলা মানেই যেন যুদ্ধ। এই দুই দেশের উত্তেজনা সমর্থকদের শান্ত রাখার কোনো পরিকল্পনা বা প্রক্রিয়াই যেন কাজে আসে না। বরং এ যেন ছাইচাপা আগুন। কিছুদিন চাপা থাকলেও আবার দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে।

এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্ব কাপে সে লড়াই জমেনি। বিগত কিছু বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো তাদের ক্রিকেটের অবস্থাও নাজুক। ভারতের সঙ্গে হারাটা এখন প্রায় অভ্যাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান বিদায় নিলেও আমরা টিকেছিলাম। বাংলাদেশ মাঝে-মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায়। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোটা ধারাবাহিক হতে পারলে অন্যদের খবর ছিল। এ নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা আর গালমন্দ আছে। সেটা থাকতেই পারে।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকদের মনে ভয়াবহ ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বাসা বেঁধেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত ভারত জিতুক এটা কোনোভাবেই যেন মেনে নিতে পারে না তারা। যারা এমনটি করে বা এমন ধারণা পোষণ করে তাদের সংখ্যা প্রচুর। কেন এবং কি কারণে এমন মনোভাব? এর উত্তর দেওয়া সহজ নয়। এর সঙ্গে দেশ, জাতি, অর্থনীতি, দুই দেশের সম্পর্ক, সবার ওপরে ধর্মীয় পরিচয় জড়িত। বিশেষত ধর্মভিত্তিক পরিচয়টাই যেন বড়। না হলে দেশের শেষ খেলায় ভালো ব্যাটিং করার পরও লিটন দাসকে গঞ্জনার শিকার হতে হবে কেন?

এবার আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লেখক হিসেবে খ্যাতিমান একজন, যার লেখার পাঠক মূলত ওপার বাংলায়ই বেশি, তিনিও ভারত এবং শেষে লিটনকে অযথা এক হাত নিতে কসুর করেননি। সমাজের সব অংশে এখন এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে।টি২০ ফাইন্যাল ছিল অসাধারণ, অবিশ্বাস্য। জিততে জিততে হেরে যাওয়া সাউথ আফ্রিকার জন্য মনটা খারাপ হতে বাধ্য। এই পরাজয় বীরের পরাজয়। হার মানা হারের এক দুর্দান্ত উদাহরণ। বিশেষ করে সূর্যকুমার যাদব যদি ওই ক্যাচটি ধরতে না পারতেন তাহলে জয়টি হাতছাড়া হয়ে যেত পারত ভারতের কাছ থেকে।
ভারত যে জিতেছে তার কারণ মাঠের খেলা নয়, গ্যালারির সাধু-সন্ন্যাসীদের দেওয়া ফুঁ ও দোয়া। এ জাতীয় বিদ্বেষমূলক মনোভাব কোনো জাতি বা সমাজকে উন্নত করে না। রাজনীতি, ধর্ম ও খেলা এগুলোকে আলাদা করতে না পারলে আমরা এগোতে পারব না। এটা হয়তো অস্বীকার করা যাবে না যে, ভারত আনুকূল্য পায়। মাইকেল ভনের মতো নামকরা খেলোয়াড়ও এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস কি বলে?

যে বছর সবাইকে তাক লাগিয়ে ভারত লর্ডসে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল সে বছর তাদের শুরুটা কেমন ছিল? ১৯৮৩ সালে আন্ডার ডগ নামে পরিচিত কপিল দেবের ভারত যে লর্ডস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে সেটাই ভাবেনি কেউ। তাই শুরুতে দলগুলোকে লর্ডসের মাঠে ঢোকার পাস দেওয়া হলেও ভারতকে দেওয়া হয়নি। তাদের ধারণা ছিল কয়েকটা খেলার পরই গ্রুপ পর্যায় থেকে বিদায় নিতে হবে তাদের। সেবার কপিলের অলৌকিক অপরাজিত ১৭৫ রানে জিম্বাবুইয়েকে হারাতে না পারলে তাই ঘটত। এমনকি ভারত যে ফাইনালে অপরাজেয় অবধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারবে তাও ভাবেনি কেউ। সে ভারত আজ কোন আসনে কিভাবে বিরাজমান তা বোঝা দরকার। সেখান থেকে সবার পাঠ নেওয়া উচিত কোন অধ্যবসায় আর সাধনা মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়।

ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী প্রধান মিত্র দেশ। সময়ে জল গড়িয়েছে অনেক। অনেক বিষয়ে মতভেদ আছে আমাদের। কিন্তু এতটা বিদ্বেষ কি যৌক্তিক? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি জানেন, বৃহৎ প্রতিবেশীকে চটিয়ে লাভ হয় না। বরং ছলে বলে কৌশলে তার কাছ থেকে হক আদায় করাটাই জায়েজ। খেলাতেও আমাদের এই মনোভাব থাকা জরুরি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মান-সম্মানের সঙ্গে ক্রিকেট এখন ভালোভাবে জড়িয়ে আছে। মূলত ক্রিকেট আমাদের বৈশ্বিক পরিচয়ও বটে। তাই এ জায়গায় সংযম আর ধৈর্যের বিকল্প দেখি না। 
বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে দুর্বলতা বা আমাদের ধারাবাহিকতার যে সংকট তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ভারতের ক্রিকেটের সঙ্গে সমঝোতা বা শেখার দিকটা জরুরি। শুধু তারা কেন, যে কোনো দেশের ভালো খেলোয়াড় বা খেলার পাশে দাঁড়াতে পারলে আমাদেরই লাভ। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বিয়য়টা ভালোভাবে জড়িত। খেলোয়াড় থেকে সমর্থক সবার জন্য এটা প্রযোজ্য।

সাউথ আফ্রিকা জিতলে যেমন খুশি হতাম, তেমনি মন-মেজাজ ও মাথা খারাপকে উপেক্ষা করে ভারত না জিতলে বাংলাদেশী বাঙালি হিসেবে আমরাই হেরে যেতাম। অভিনন্দন টিম ইন্ডিয়া। দুর্দান্ত ফাইনালের জন্য সাউথ আফ্রিকাকেও শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।  আমরা যেন ভুলে না যাই, ক্রিকেট দিন শেষে একটি খেলা মাত্র। আর জাতিগত বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক চিরকালের বন্ধন।

[email protected]

×