ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

উজাড় বন-জঙ্গল

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:২৪, ১ জুলাই ২০২৪

উজাড় বন-জঙ্গল

বন-জঙ্গল

শস্যশ্যামল ছায়াঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ বাংলাদেশ। কোন্ দাবানলে সেই সবুজ প্রান্তর আজ তার চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন-বিলুপ্ত প্রায়? পার্বত্য অঞ্চলের নিবিড় ঘন বন উজাড় হয়ে যাওয়া এক অযাচিত কালো থাবার নির্মম পেষণ। শুধু কি পার্বত্য অঞ্চল? সুন্দরবনের শ্যামল প্রকৃতির নিবিড় পরশ দক্ষিণ প্রান্তরকে যে মাত্রায় রক্ষা করে চলছে, তা সত্যিই এক অত্যাশ্চর্য নিসর্গেরই পরম আশীর্বচন। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আবহমান বাংলাকে হরেক রূপ, রস আর প্রাকৃতিক বৈভবে আবৃত করে জানমালকে যে মাত্রায় আগলে রেখেছেন, তাও এই বদ্বীপের পরম বরমাল্য।

কিন্তু প্রকৃতির সেই অবারিত, অফুরান দানকে যারা নিত্যনতুন কূটকৌশলে ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠে, তার দামও প্রকৃতিই তুলে নেয় নির্মম প্রতিশোধে। বাংলাদেশ সমুদ্র, নদ-নদী আর বন-বনাঞ্চল ঘেরা এক অনন্য প্রকৃতির নির্মল সুশোভিত প্রান্তর। এমন অনিন্দ্য সুন্দর নিসর্গ সময় অসময়ে উন্মত্ত খেলায় মেতে ওঠে বিক্ষিপ্ত নানামাত্রিক কর্মকা-ে। তেমন বিরূপ নিসর্গকে সামাল দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে আবহমান বাংলা ও বাঙালিকে। প্রকৃতি যেমন উজাড় হস্তে দান করেছে, পাশাপাশি ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে কেড়ে নিতেও কসুর করেনি।

এই অঞ্চলের প্রকৃতি পরিবেশে জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার উপায় খোঁজা কঠিন হলেও অঞ্চলবাসীই তা সহজ, স্বাভাবিক করে নিয়ে উর্বর পলিমাটির ভূমিকে বাসযোগ্য করে তুলেছে। ঝড়-ঝাপটা আর প্রাকৃতিক বৈরিতার সঙ্গে লড়াই করেও ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়নি কখনো। বরং নতুন উদ্যমে ভাঙনের প্রতিকূল প্রতিবেশকে আয়ত্তে এনে নিজেদের রক্ষাকবচও তৈরি করেছে। 
একসময়ের উন্মত্ত, ধরা-ছোঁয়ার বাইরের অতীত প্রকৃতিকে আধুনিক মানুষ জয় করেছে নিত্যনতুন জ্ঞান ও উদ্ভাবনের কলাকৌশল দিয়ে। জীবনমান উন্নত হয়েছে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা জীবনের যে জয়ধ্বনিতে এগিয়ে চলেছে, সেখান থেকেই নাকি যাত্রা শুরু করে পরিবেশের বৈপরীত্য, বৈরিতা। অর্থাৎ, যে বিজ্ঞান জীবনযাত্রাকে আধুনিকতার বলয়ে প্রবেশাধিকার দিল, তারই বিপরীত দাবানলে বিশ্ব প্রকৃতি যেন নির্মমতার এক শৃঙ্খলেও আটকে গেল।

বাংলাদেশও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যার নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যে নাজেহাল অবস্থা, তাও একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে নিষ্ঠুর অভিঘাত। সবুজ বাংলা আজ ধু-ধু মরু প্রান্তরের দীর্ণ দশায় পড়ে যাওয়ার দুর্বিষহ অবস্থা। সেখানে প্রায়শ সামনে চলে আসছে গভীর জঙ্গলের হরেক গাছ কেটে তা পাচার করার মতো দুঃসহ ঘটনা। বন-বনাঞ্চলে সুরক্ষিত বাংলার শ্যামল প্রান্তর। সেখানে নাকি গাছ কাটা কাঠচোরদের উন্মত্ত থাবায় বেসামাল, অপ্রকৃতিস্থ। সুস্থিরভাবে দিন যাপনের কোনো অবকাশই নেই।

সুন্দরবনের পরে যে দ্বিতীয় বৃহত্তম বনটির নাম সামনে এসে যায়, তা টেংরাগিরি বন। এখানে নাকি সব সময় গাছ কেটে কাঠ চুরি করা ছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়ার চিত্র দুর্বিষহ। কিছু পরিমাণ জায়গায় আগুন জ্বালালেও পার্শ্ববর্তী অনেক বৃক্ষ আগুনের লেলিহান শিখায় শুকিয়ে যাওয়ার যে আলামত দৃশ্যমান হয়, তাতে বৃক্ষরাশির অব্যবস্থা অবর্ণনীয়। যেভাবে নষ্ট করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সারি সারি গাছের সবুজ প্রান্তর। এমন সব কাঠচোরেরা ধরা পড়ার অবকাশ থাকে কমই।

চিহ্নিত কিছু কাঠচোর গাছ কেটে বিভিন্ন জায়গায় কাঠ পাচার করছে। তারা ধরা না পড়ার কারণও রহস্যে আবৃত। ধারণা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বন বিভাগই চুরি-চামারির সর্বাধিক তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তবুও অপরাধী পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার অন্তরালে। স্থানীয় জনগণের হরেক আপত্তিও জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। যেমনÑ বনে আগুন লাগার বিষয়টি মাঝে মধ্যে ঘটে থাকে। নেভানোও হয়। তারপর সব যেন ধামাচাপা পড়ে যায়। অগ্নিসংযোগের অঘটনে মামলা করার বিষয়ও উঠে আসে। ক্রমান্বয়ে তা আর শেষ অবধি যেতেই পারে না। তাই দেশের বনাঞ্চল সুরক্ষায় কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। 
সম্প্রতি আমরা ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ রেমালকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঁচড় বসাতে দেখেছি। শুধু তাই নয়, সেখানে সুন্দরবনের রক্ষাকবচের বিষয়টিও বিভিন্নভাবে আলোচিত। সমুদ্র ও নদ-নদী পরিবেষ্টিত চিরায়ত বাংলা নানামাত্রিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেও মোকাবিলা করে আসছে। যা যুগ-যুগান্তরের এক বিপন্ন পরিবেশের নির্মম শিকার। প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করে থাকে সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল।

তেমন অঞ্চলে প্রকৃতির অবারিত দানে বন-বনাঞ্চলের যে সুরক্ষিত বেষ্টন সেটা নিসর্গের আর এক লীলা ক্ষেত্র তো বটেই। সঙ্গত কারণে প্রকৃতি নির্মমতার যে বেড়াজাল বিস্তৃত করে, সেখানেই ঘনীভূত থাকে তার পরিত্রাণের উপায়ও। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ তারই উৎকৃষ্ট নজির। সুতরাং প্রকৃতিধন্য এই বাংলাদেশ। হরেক বিপর্যয় আর তা-বের মধ্যে সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামল বাংলাদেশ তার আপন রূপরস আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ।

যেখানে ভাঙাগড়ার খেলায় প্রকৃতি উন্মত্ত, উদ্যত হলেও সেখান থেকেই তার পরিত্রাণের সুরক্ষিত দুর্গও রচিত হয়ে যায়। সেটাই আবহমান বাংলার শাশ্বত প্রাকৃতিক উপহার। নরম, পলিমাটির অঞ্চল বাংলা তার রূপ মাধুর্যে যেমন এক অবিস্মরণীয় লীলাময় ভূমি, তেমনি আপন বৈভবে পরিত্রাণ পাবারও পরম বরমাল্যে ধন্য তৃপ্ত আর নিশ্চিন্ত। 

তবে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় আবেদনে বিশ্বসভা যেমন নতুন সময়ের অনুগামী, আমাদের বাংলাদেশও তার থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলা আজ অবকাঠামোগত উন্নয়নে দৃষ্টিনন্দনভাবে উদ্ভাসিত। নানামাত্রিক অমীমাংসিত ঘটনা অঘটনে অস্থির না হয়ে পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন জাতির বড় অহঙ্কার। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানামাত্রিক যুগোপযোগী কর্মসাধনায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর কন্যার স্মার্ট বাংলাদেশ সামনের দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়াও অবধারিত উন্নয়ন মহাপ্রকল্প।

সমুদ্রনগরী চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেলের শুভ উদ্বোধন শুধু উপমহাদেশীয় নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় এক চমকপ্রদ নবতর স্থাপনা। দেশকে বিশ^সভায় নজরকাড়া করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মাত্রায় উন্নয়ন অভিগামিতায় সম্মুখগামী হচ্ছেন, সেখানে আর কোনো বাধা বিপত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাও সাধ্যের বাইরে। উন্নত মম শিরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এমন এক বদ্বীপকে সফলতার সিঁড়ি ছোঁয়াতে সব ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাও যেন এক অবধারিত চ্যালেঞ্জ।

নৈসর্গিক ছায়াঘেরা শ্যামল বাংলা আজ উন্নয়নযজ্ঞের দৃশ্যমান ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তির বাংলাদেশকেও আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। কম আনন্দ আর সাফল্যের বিষয় নয় কিন্তু। বৃহত্তর এশিয়া আর উপমহাদেশীয় আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বিনির্মাণেও তার যুগোপযোগী কর্মসাধনা জাতির জন্য এক অভাবনীয় গৌরব। কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রতিপক্ষকে উন্নয়ন ধারাবাহিকতার সামনেই আসতে দিচ্ছেন না।

দুঃসাহসিক মনোবল, নিয়ত কর্মসাধনা, উজাড় করার দেশপ্রেম আর জনগোষ্ঠীর প্রতি হৃদয় নিঃসৃত মায়া মমতার ধারক বাহক হয়ে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সামনেও ব্যতিক্রম হবে না বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন ধ্বজার ধারাবাহিক কর্মপ্রকল্পের নতুন সময়।
লেখক : সাংবাদিক

×