ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘ

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২১:২২, ১ জুলাই ২০২৪

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘ

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘ

১৯২০ সালে গঠিত জাতিপুঞ্জ বা লীগ অব নেশনস ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। বিশ^বাসী তাই একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ৫১টি দেশের সমন্বয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৯৩। জাতিসংঘের মূল সনদে ১৯টি অধ্যায় এবং ১১১টি ধারা রয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার সময় সবাই প্রত্যাশা করেছিল শান্তিপূর্ণ বিশ^ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। জাতিসংঘ সনদের ১ নং ধারায় ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ’-এর উদ্দেশ্যে শান্তিভঙ্গের হুমকি নিবারণ ও দূরীকরণের জন্য আক্রমণ অথবা অন্যান্য শান্তিভঙ্গের কার্যকলাপ দমনের জন্য কার্যকর যৌথ কর্মপন্থা গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আন্তর্জাতিক বিরোধ বা শান্তিভঙ্গের আশঙ্কাপূর্ণ পরিস্থিতির নিষ্পত্তি বা সমাধানের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

সনদের ২৪ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের ওপর অর্পিত হয়েছে। জাতিসংঘ সনদের প্রস্তাবনা এবং ১ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংস্থাটির উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছেÑ ১) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ করা; ২) সমানাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা; ৩) অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহ সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা; ৪) শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদের মীমাংসা করা এবং ৫) উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনে জাতিসংঘকে দেশসমূহের সমগ্র কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।

জাতিসংঘ সনদের ২নং অনুচ্ছেদে সংস্থাটির নীতিসমূহ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ১) জাতিসংঘের সকল সদস্যের সার্বভৌম ক্ষমতার স্বীকৃতি এবং সমমর্যাদার নীতিতে বিশ^াসী, ২) এর সকল সদস্যই সনদের আনুগত্যের প্রতি অটল থাকবে, ৩) সদস্য রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিরোধসমূহের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করবে, ৪) কোনো সদস্য রাষ্ট্র এমন কোনো কাজ করবে না যাতে অপর রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখ-তা নষ্ট হয়, ৫) কোনো সদস্য রাষ্ট্রই অপর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিপক্ষে কোনো ধরনের শক্তি প্রদর্শন বা হুমকি প্রদর্শন করবে না, ৬) সদস্য রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত কার্যাবলিতে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবে এবং ৭) যে সকল রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য নয়, তারাও যাতে প্রয়োজনে জাতিসংঘের নীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। 
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তি করে এবং বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শান্তি স্থাপনে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশে^ উত্তেজনা হ্রাস, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, যুদ্ধ বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে সংস্থটির ভূমিকা রয়েছে। উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পেরেছে জাতিসংঘ। রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রদানে জাতিসংঘের অবদান প্রশংসনীয়। ষাটের দশকে এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিসংগ্রামকে সহযোগিতা করেছে সংস্থাটি।

মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকাও ইতিবাচক বলতে পারি। শান্তি রক্ষা মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ যুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহযোগিতা দিচ্ছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমনে রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিরক্ষী বাহিনী সহায়তা দিচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থার মাধ্যমে সমগ্র বিশে^ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিশু ও নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, কৃষি ও মৎস্য খাতের উন্নয়ন, আণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, কোটি কোটি শরণার্থীকে সহায়তা করা, জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা, বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি জাতিসংঘের উল্লেখ করার মতো অবদান। 
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন এক চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত সৈন্য ইরানে  মোতায়েন ছিল। যুদ্ধ শেষ হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য অপসারণ না করায় ইরান জাতিসংঘের নিকট অভিযোগ আনে। ফলে, ইরান থেকে সোভিয়েত বাহিনী অপসারিত হলে বিরোধের অবসান হয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন সিরিয়া ও লেবাননে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সৈন্য মোতায়েন ছিল। যুদ্ধ শেষ হলেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স  সৈন্য ফিরিয়ে না নেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপক আলোচনা হলে সৈন্য অপসারণ করতে তারা বাধ্য হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডাচ উপনিবেশ ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ শাসক গোষ্ঠী ও ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা বিরোধে জড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘের সহযোগিতায় ১৯৪৯ সালে ডাচরা ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা দেয়। পূর্ব তিমুর, ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ সুদানসহ বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছিল। হাইতি, রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, আইভরিকোস্টসহ বিভিন্ন দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী।

ইসরাইল ও লেবানন সীমান্তে পুঁতে রাখা স্থলমাইন অপসারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইরাক-কুয়েত সীমান্তে ‘নো-ফ্লাই জোন’ তৈরি করে জাতিসংঘ সেখানে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণ করেছিল। কুয়েত থেকে স্থলমাইন অপসারণে ভূমিকা রেখেছিল। 
আবার বসনিয়া-হার্জগোভিনায় মুসলিম নিধনে নির্লিপ্ততা, সোমালিয়ায় বিতর্কিত ভূমিকা, নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি ছাড়াই মার্কিন মিত্র বাহিনীর আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণে বাধা প্রদানে ব্যর্থতাও রয়েছে সংস্থাটির। ইরাকে নিষিদ্ধ পরমাণু ও জীবাণু অস্ত্রের মজুত রয়েছে এই অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও স্পেন ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তা আন্তর্জাতিক আইন তো বটেই; এমনকি জাতসংঘ সনদেরও পরিপন্থি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতিসংঘ এবং এর তৎকালীন মহাসচিব উথান্টের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক। পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে সামরিক বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল, জাতিসংঘ সে বিষয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আন্তঃপ্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল; সেই স্নায়ুযুদ্ধ রোধ করা কিংবা উত্তেজনা হ্রাসে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। 
সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ১৯৭৫-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চলা কম্বোডিয়ার গণহত্যায় উগ্র মাওবাদীরা দেশটির ২৫ ভাগ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে। এছাড়াও ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলমান সোমালিয়া ও সুদানের গৃহযুদ্ধের কোনো মীমাংসা করতে পারেনি সংস্থাটি। চলতি দশকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন, গণহত্যা ও উচ্ছেদকরণ; সিরিয়া-ইয়েমেন সংঘাত, চীনের উইঘুরে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, চীন-তাইওয়ান সংকট, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়ায় আগ্রাসন, কিউবার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রম, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষেত্র বিশেষে পক্ষপাতিত্ব এবং নিষ্ক্রিয়তা জাতিসংঘের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘের তেমন কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের চেয়ে ভেটো প্রদানের ক্ষমতাকে মুখ্য হিসেবে দেখা হয়। জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূলেই রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের এই অগণতান্ত্রিক ভেটো ব্যবস্থা। শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখার কথা ছিল নিরাপত্তা পরিষদের। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভেটো ব্যবস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশেগুলো নিজেদের স্বার্থে ভেটো ব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সাধারণ পরিষদও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখন ভারত, চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির ফলে সৌদি আরব, মেক্সিকো, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম রাশিয়ার বিরুদ্ধে একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে মানছে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতেও নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, সিরিয়া ও কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তির তথা ন্যাটো জোটের বিপরীতে। 
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপ্তি সমগ্র বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশে^ মেরুকরণ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুুদ্ধের পুনঃজাগরণ এবং পরাশক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া তৎপরতা চালাচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য তৈরির প্রচেষ্টা, সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণ, ইউরোপের রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অংশীদারিত্বের নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।

বিশ্ব যখন সংঘাতের পথ বেছে নিচ্ছে, তখন সংঘাত থামাতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া বর্তমান বিশে^র শক্তিধর দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র  তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বর্তমানে জাতিসংঘকে একটি উন্নয়নমুখী এনজিও প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না বলে মন্তব্য করেছেন অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরপত্তা উন্নয়ন ও সংকট নিরসনে জাতিসংঘকে একটি অসহায় সংস্থা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধ থামাতে সংগঠনটি শুধুু আহ্বান জানানো ছাড়া কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

এখন পর্যন্ত সংস্থাটির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট সমাধানে এটি কোনো কার্যকর প্রভাব রাখতে পারেনি। বিভিন্ন সময় আলোচনায় বসলেও ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মদতে ফিলিস্তিনের প্রায় ৮৫ ভাগ ভূমি ইসরাইলের দখলে। ১৯৪৮ সাল থেকে চলমান এ সংঘর্ষে জাতিসংঘকে শুধু আহ্বানকারী ও অসহায় পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় দেখা গেছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত মধ্যপ্রাচ্য তথা আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চলমান বিবাদের কোনো সুরাহা করতে পারেনি জাতিসংঘ। 
তাছাড়াও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক শান্তির চেয়েও নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখা, সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা রোধে ব্যর্থতাসহ তোষণ নীতির কারণে জাতিসংঘের ব্যর্থতা দৃশ্যমান। এ ছাড়াও জাতিসংঘের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করা। জাতিসংঘ মূলত বৃহৎ শক্তিধর দেশের চাঁদায় পরিচালিত। এতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদা প্রদানকারী দেশগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। একবিংশ শতকে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হলে এর আমূল সংস্কারের বিকল্প নেই।

জাতিসংঘের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো, সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা, কার্যপ্রণালী ও নিয়মনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পটভূমি বিবেচনা করলে এর সংস্কার তথা পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সহজেই অনুমেয়। জাতিসংঘের সংস্কারের লক্ষ্যে সাবেক সহাসচিব কফি আনান প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য দশ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযাগ্য হলো- বাজেটের ব্যয় হ্রাস, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রয়াসকে জোরদারকরণ, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাসচিব নিয়োগ প্রভৃতি।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ড. বুট্রোস ঘালিও জাতিসংঘ সংস্কারের বিষয়ে যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। সংস্থাটির বর্তমান ব্যর্থতা ও অকার্যকারিতার জন্য এর সাংগঠনিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতিকে দায়ী করেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘ সচিবালয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দপ্তরসমূহের কাজ সুসংহত করে পরিবর্তিত বিশ^ব্যবস্থার আলোকে সাজাতে হবে।

বর্তমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তিসমূহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরাশক্তি; কেউ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আবার কেউ সার্বিক বিবেচনায়। বিশে^র ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্যের প্রতিফলনে নিরাপত্তা পরিষদকে অধিক কার্যকর করা প্রয়োজন।

পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিারাপত্তা রক্ষা এবং সন্ত্রাস, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী সংগঠনে পরিণত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংস্কার অত্যাবশ্যক। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে জাতিসংঘকে এখনো বিশ্ববাসীর শান্তি, সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য সংস্থায় পরিণত করা সম্ভব। 
লেখক :  অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×