ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১

আম রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষিচর্চা

ড. মো. জামাল উদ্দিন

প্রকাশিত: ২২:২৮, ৩০ জুন ২০২৪

আম রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষিচর্চা

.

নিরাপদ আম উৎপাদন রপ্তানির জন্য উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) অনুসরণ করা বেশ জরুরি। উত্তম কৃষিচর্চা সারা পৃথিবীতে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদন বাজারজাতকরণের বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণ করে। উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন পর্যায়ে বাছ-বিচারহীন বালাইনাশক রাসায়নিকের ব্যবহার, ভারি ধাতব পদার্থের উপস্থিতি, অণুজীবের সংক্রমণ ইত্যাদি খাদ্য বা ফসলকে অনিরাপদ করে। এসব কারণে নিরাপদ খাদ্যপণ্য প্রাপ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনের শুরু থেকে সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াকরণ যেমনÑ মাঠ হতে সংগ্রহ, প্যাকেজিং, পরিবহন ইত্যাদি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। গত ২৭ জুন, ২০২৪ তারিখে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে কৃষিমন্ত্রী . মো. আব্দুস শহীদ, এমপির নেতৃত্বে ঢাকায় নিযুক্ত প্রায় ২০টি দেশের রাষ্ট্রদূত/মিশনপ্রধানগণকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের কান্দবোনা গ্রামের আম চাষি রাফিকুল আমিনের আম বাগানে উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) অনুসরণের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুমিষ্ট আমের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। সে খ্যাতি বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি, বাণিজ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমবাগান পরিদর্শন শেষে কৃষিমন্ত্রী . মো. আব্দুস শহীদ, এমপি বলেন, ‘বাংলাদেশের আম স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এবং বিদেশেও জনপ্রিয়। প্রতিবছর দেশ থেকে লক্ষাধিক টন আম রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা মাত্র তিন হাজার টনের মতো রপ্তানি করতে পারি। ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল উত্তম কৃষিচর্চা বা গ্যাপ অনুসরণ না করা। সে জন্য গ্যাপ মেনে আমরা নিরাপদ আম উৎপাদন শুরু করেছি। আজ বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার, রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকরা কার্যক্রম ঘুরে দেখেছেন। আমরা বেশি পরিমাণ আম রপ্তানির চেষ্টা করছি। পরিদর্শনের মাধ্যমে বিদেশী কূটনীতিকদের উৎসাহিত করছি। যাতে বেশি পরিমাণ আম রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। আমি মনে করি, পরিদর্শনের ফলে আম রপ্তানি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি, বাণিজ্য পররাষ্ট্রÑ এই তিন মন্ত্রণালয় মিলে আমরা আমাদের আমকে বিদেশে ব্র্যান্ডিং করব। যাতে বিদেশে রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পায়। আম রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের বহু সমস্যা আছে। থাকতে পারে। গ্যাপ না থাকলে চাইলেই বিদেশে আম রপ্তানি করা যায় না। গ্যাপ বাস্তবায়নে আমরা শুরু করেছি। সামনে কোনো সমস্যা থাকবে না।

আমবাগান ঘুরে সিঙ্গাপুরের চার্জ দ্য আ্যফেয়ার্স শীলা পিললাই বলেন, বাগান দেখে আমি অভিভূত। সিঙ্গাপুরে ভারতের আম যায়। দামও একটু বেশি। সাশ্রয়ী দামে ভালো কোয়ালিটি পাওয়া গেলে বাংলাদেশ কেন নয়! আমরা যেহেতু উৎপাদন করি নাÑ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো সুযোগ পেতে পারে। জাতিসংঘের কৃষি খাদ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউ কুন শী বলেন, এখানে প্রথমবার দেখলাম আমের বাগান। আম ভ্যালু চেইন প্রোডাক্ট। এফএও গুরুত্ব দিয়ে গ্যাপ অনুসরণে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশের কৃষি বদলে গেছে। গ্যাপ মেইনটেইন করছে। এটি বিশ্বকে জানাতে চায় এফএও। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), ঢাকা এর নির্বাহী চেয়ারম্যান . শেখ মো. বখতিয়ারের ফেসবুক পোস্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রদূত/মিশনপ্রধানগণ বাংলাদেশের উদ্যোগকে প্রশংসা করেছেন এবং নিরাপদ আম উৎপাদন কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশে উত্তম কৃষিচর্চায় ফল ফসল উৎপাদন হওয়ার বিষয়টি নিজ নিজ দেশের ক্রেতাদের অবহিত করবেন বলে জানান রাষ্ট্রদূতরা।

. বখতিয়ার বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) অনুসরণ করে দেশে চলেছে  নিরাপদ আম উৎপাদন। নিরাপদ আম উৎপাদন কার্যক্রম পরিদর্শন করলেন রাষ্ট্রদূতগণ। সরেজমিন মাঠ পরিদর্শনে নেতৃত্ব দেন কৃষিমন্ত্রী . মো. আব্দুস শহীদ। সে সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, পল্লী উন্নয়ন সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. আব্দুল ওয়াদুদ, স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহা. জিয়াউর রহমান, কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মো বখতিয়ার। ব্রুনাই দারুস সালাম, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, স্পেন, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভুটান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতগণ পরিদর্শনে অংশগ্রহণ করেন। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) এর বাংলাদেশ প্রতিনিধিও টিমে ছিলেন।

বিশ্বের আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দেশের লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৮ একর জমিতে আম চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে লাখ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমিতে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ মে. টন আম উৎপাদিত হয়। আম পরিবহন, সংরক্ষণ বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদন পর্যায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় উৎপাদিত আমের ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৩৮টি দেশে আম রপ্তানি হচ্ছে। অবশ্য এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। ২০২১ সালে বিশ্বে প্রায় . বিলিয়ন ডলার মূল্যের আম রপ্তানি হয়। আর বাংলাদেশ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে হাজার ৭৫৭ মে. টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে হাজার ৪৫.৪৩৭ মে. টন আম রপ্তানি হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমের কোয়ালিটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদের মার্কেটিং করতে হবে। কৃষি সচিব বলেন, আমরা উত্তম কৃষিচর্চা শুরু করেছি। এটি সারা বিশ্বের প্রতিনিধিরা দেখলেন। যা আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

বিএআরসি চেয়ারম্যান . শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, আমাদের আমের কোয়ালিটি নম্বর ওয়ান। তবে মার্কেট দখল করে আছে অন্যরা। রপ্তানি করার যে চাহিদা, সেটা আমরা পূরণ করছি। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ- তা বিশ্বে তুলে ধরতে উন্নয়নশীল সহযোগীদের দেখালাম। ১০টা সবজি ৫টা ফলে আমরা এই চর্চা চালু করেছি। নাচোলের আমচাষি রাফিকুল ইসলাম বলেন, তাদের ফার্মি অ্যাগ্রো নামের আমবাগানটি ১৪০ বিঘার। পুরো বাগানেই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদিত হয়। আম বাগানে ফ্রুটব্যাগিং করে ঢেকে রাখা হয়েছে অনেক আম। পোকামাকড়ের আক্রমণ মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে এমন ব্যবস্থা। গত বছর থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে তিন বিঘার বাগানে বারি আম- এবং বারি- আমের বাগানও করেছেন। প্রথমবারের মতো বিদেশী কূটনীতিকদের উচ্চপর্যায়ের একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমবাগান পরিদর্শন করলেন। এতে স্থানীয় আমচাষিসহ উদ্যোক্তারা খুব খুশি। এর মাধ্যমে দেশের আম রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন তারা। বারির সিনিয়র ফল বিজ্ঞানী . শরফ উদ্দিন জানানÑ পার্টনার প্রকল্পের আওতায় আগামী চার বছরে ১৫টি ফসলের তিন লাখ হেক্টর জমিতে উত্তম কৃষিচর্চা প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের মানুষ নিরাপদ খাদ্যপণ্য খাওয়ার সুযোগ পাবে। সে সঙ্গে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে বহুগুণে।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি মন্ত্রণালয়বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা নীতিমালা- ২০২০প্রণয়ন করে। ওই নীতিমালা অনুসারেউত্তম কৃষি পদ্ধতিহলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম, যা অনুসরণে নিরাপদ মানসম্পন্ন খাদ্য খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত হয়। উত্তম কৃষিচর্চায় এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা করা হয়, যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নিরাপদ মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এটি এক গুচ্ছ নীতি-বিধি প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা, যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন কাজের পরিবেশ উন্নত করে। উত্তম কৃষিচর্চার অন্যতম বিষয় হলোÑ স্বাস্থ্যসম্মত উৎপাদন, নিরাপদ খাদ্যমান রক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কৃষিকর্মীর স্বাস্থ্য, তথ্যাদি সংরক্ষণ, সার্টিফিকেট প্রদান লোগো ব্যবহার, প্রশিক্ষণ, বাজার নিশ্চিত করা, মনিটরিং প্রচার-প্রসার ঘটানো।

ভবিষ্যৎ কৃষিকে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটাতে উত্তম কৃষিচর্চা হতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের উদ্যোক্তা রফিকুল আমিনের আম বাগানে উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) এর কার্যক্রমে এরই প্রমাণ মেলে। দেশব্যাপী আমের বাণিজ্যিক উৎপাদন এলাকায় ক্রমান্বয়ে এটির প্রয়োগ ঘটাতে পারলে দেশের মানুষ নিরাপদপণ্য ভোগ করার সুযোগ পাবে। পণ্যের ব্র্যান্ডিং হবে। তাতে বিদেশে আমাদের পরিচিতি বাড়বে। রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি, সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট,

এফএও, জাতিসংঘ

[email protected]

×