ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

সর্বাত্মক প্রস্তুতির পরিকল্পনা

কাজী সেলিম

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২৯ জুন ২০২৪

সর্বাত্মক প্রস্তুতির পরিকল্পনা

বর্তমান বিশ্বে চলমান সংঘর্ষ, যুদ্ধ, গণহত্যা, সন্ত্রাস

বর্তমান বিশ্বে চলমান সংঘর্ষ, যুদ্ধ, গণহত্যা, সন্ত্রাস এবং একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাত ও বিস্তার থেকে বাংলাদেশ ও তার জনগণকে অথবা দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ধরনের জঙ্গি, ধ্বংসাত্মক নাশকতামূলক অথবা সংঘটিত কার্যকলাপের ধ্বংসাত্মক পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করার একটি ঢাল অথবা রক্ষক হিসেবে ব্যবস্থাবলি, নির্দেশাবলি করণীয় দায়িত্ব সংক্রান্ত ২০১৩ সালের প্রণীত বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বা গাইড লাইনের পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনা করে বর্ধিত আকারে সর্বাত্মক Contingencey Plan, Strategy অথবা বলা যায়, সম্ভাব্য যে কোনো বড় ধরনের ঘটনার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত বা তৈরি থাকার আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আমাদের মনে রাখা চাই যে সৃষ্টিকর্তা না করুন, যদি বিশে^ একটি ভয়াবহ মারাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয় বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সে যুদ্ধ হবে ঈযবসরপধষ ও ইরড়ষড়মরপধষ ডধৎযবধফং দিয়ে। অর্থাৎ রাসায়নিক এবং জৈবিক বিষাক্ত বিস্ফোরক সংবলিত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে ভয়াবহ দাবানল সৃষ্টি করে মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল এলাকা তথা দেশ ও জনপদ ধ্বংস করা হবে।

সুতরাং বাংলাদেশকেও এই দুই ধরনের মারণাস্ত্রের প্রতিক্রিয়া ও তার আঘাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তার ওপর বিস্তারিত প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহ, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্য দপ্তর ও বিভাগকে আগাম ব্যাপক কর্মসূচিসহ প্রস্তুত করে রাখা জরুরি। বাংলাদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে বা  কচও (Key point of Installations) যে কোনো আক্রমণ বা হামলা থেকে রক্ষার একটি ঢাল মোটামুটি দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে। 
বাংলাদেশ সরকারের ২০১৩ সালে গৃহীত পরিকল্পনা বা গাইডলাইনের পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনা করে সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে দ্রুত। যে কোনো যুদ্ধে শত্রু পক্ষের মূল লক্ষ্য বা টার্গেট থাকে একে অপরের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, তেল শোধনাগার, বিমান, নৌবন্দর, বৃহৎ আকারের ব্রিজ, রেললাইনসহ সকল যোগাযোগ  ও  সরবরাহের পথকে ধ্বংস করে দেওয়া।

তাছাড়া আক্রমণের অপর প্রধান টার্গেট বা লক্ষ্য থাকে দেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরের রানওয়ে বা কন্ট্রোল টাওয়ারসমূহ, সামরিক ক্যান্টনমেন্ট, গ্যারিসন, নৌ, বিমানবাহিনীর ঘাঁটিসমূহকে ধ্বংস করে প্রথমেই একটি দেশের Critical Infrastructure বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ ধ্বংস করার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়া।
শত্রুর অপর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু হলো দেশের আইটি বা Information Technology-কে ধ্বংস করে গোটা দেশের সব প্রকার ডিজিটাল তথ্য আদান-প্রদানের নির্ভরশীল মাধ্যমকে ধ্বংস ও অকেজো করে দেওয়া।

কাজেই বাংলাদেশকেও সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে দেশের Digital Information ব্যবস্থা সুরক্ষার। কারণ এই গোটা আইটি ব্যবস্থাই বর্তমান বিশে^ বাংলাদেশসহ সকল দেশেই বিদ্যুৎ সরবরাহকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। আইটি পদ্ধতি বা সিস্টেম ব্যবহার হয় আর্থিক লেনদেন দাপ্তরিক নিত্যনৈমিত্তিক কাজে। শিশুখাদ্য, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী, অর্থ প্রদানকারী টাকা উত্তোলনের যন্ত্র এটিএম টেলিযোগাযোগ, মোবাইল, ইন্টারনেট, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিসহ ওষুধপত্র উৎপাদনেরও আইটি পদ্ধতি নির্ভরশীল ব্যবস্থা।

বর্তমান বিশ্বে যে কোনো দেশ ও জাতিকে অচল ও পঙ্গু করতে পারে যে কোনো ধরনের সাইবার আক্রমণের (Cyber Attack) অপব্যবহার। সেজন্য ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের সাইবার আক্রমণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করাও আবশ্যক। বাংলাদেশের সকল কল-কারখানায়, যেখানে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, ওষুধপত্র, শিশুখাদ্য, কৃষি উপাদান, খাদ্যশস্য, পোশাক তৈরিসহ নানা ধরনের উৎপাদন কাজ হয় সেই  ব্যবস্থাকে রক্ষা করে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সকল মিল-কলকারখানা ফ্যাক্টরির উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের পর্যাপ্ত মজুত সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশে^র যে কোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সচল ও কার্যকর রাখার একটি টেকসই ব্যবস্থার সর্বাত্মক পন্থা প্রণয়ন করা উচিত। এ বিষয়ে যে কোনো ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষাক্ত ক্রিয়ায়, রাসায়নিক পদার্থের বিস্তার, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে সমগ্র দেশের মানুষকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

এই জরুরি ব্যবস্থার একটি ‘কোড নাম’ ব্যবহার করে সমগ্র বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের সর্বস্তরের চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক, প্যারামেডিক্সদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি ড্রিল বা এক্সারসাইজ অনুশীলন ও সামরিক বাহিনীর মেডিক্যাল কোর গঠন করা যায়। ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ, শাখার স্ব-স্ব দায়িত্ব কি হবে তার ওপর একটি সম্যক ধারণা সৃষ্টি হবে। 
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে যে কোনো ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হলে আমাদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুরক্ষার জন্য। এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে আঘাত করে ধ্বংস করার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে দেশী ও বিদেশী সন্ত্রাসীদের দ্বারা। কারণ পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে যে  কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে এই প্রকল্পের পাশর্^বর্তী এলাকার জনগণকে দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তর করা সম্ভব হবে না।

পারমাণবিক প্লান্টের ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের তেজস্বী বস্তুর বিস্ফোরণসহ অন্যান্য উপাদানের সংমিশ্রণ তখন এক মহাদুর্যোগ বয়ে আনবে। অবশ্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।  আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সজাগ ও সচেতন থাকবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ভূখ-কে রক্ষার। সন্ত্রাসীদের দ্বারা অথবা শত্রু পক্ষকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে যে কোনো দেশ ও রাষ্ট্রে মধ্যে যে কোনো ধরনের জৈবিক যুদ্ধ বা Biological Warfare সংগঠিত হলে তা মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

Biological Warfare গোটা জাতিকে সংক্ষিপ্ত সময়েই সংক্রমিত করে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অতএব, পারমাণবিক ঘঁপষবধৎ এবং ইরড়ষড়মরপধষ যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের আকাশসীমা ও মূল ভূখণ্ডকে রক্ষা করার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনবিরোধী প্রতিরক্ষা বা Missile Defence Systems বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার সক্ষমতার ব্যবস্থা করা উচিত। এ লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয় যুদ্ধ ব্যবস্থাকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার কথা IB WAR BOOK-এ থাকবে। যদি সম্ভব হয় আর্থিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের জন্য একটি (Integrated Air and Misssile Defence Battle Command System বা IBCS) বা সমন্বিত বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব প্রদানের বিবেচনা করা যেতে পারে।

বহির্শত্রুর আক্রমণে শত্রুর নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের হাত থেকে দেশের ভূখণ্ড, মানবকে রক্ষা করে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে  কিভাবে রাখা হবে সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে নিকটস্থ নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়, মেট্রো টানেলে আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের সকল বিভাগ, সংস্থা প্রধানদের কোনো প্রকার আত্মতুষ্টি বা মানসিক প্রসন্নতায় সময় নষ্ট না করে এখনই একটি Comprehensive বা ব্যাপক আকারের কর্মসূচির পরিকল্পনার কর্মযজ্ঞ দ্রুত প্রস্তুত করার কাজে নিয়োজিত হতে হবে।
পূর্ব জরুরি সতর্কীকরণ বা Emergency Alarming এবং Early Warning System-কে সক্রিয় করে ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান হামলাসহ ধ্বংসাত্মক আক্রমণে দেশের জন্য হুমকি হলে কি করণীয় ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এসবের বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে জনগণের জন্য সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের পুস্তিকায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক দেশের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার জন্য একটি উপযুক্ত জাতীয় বিশেষ প্রস্তুতি যেন শীঘ্রই সম্পন্ন করা হয়- দেশবাসীর এই প্রত্যাশা।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক

×