ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৯ জুন ২০২৪

বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ

একটি দেশের স্থিতিশীল রাজনীতির বাতাস সকলের নিকট কাক্সিক্ষত

একটি দেশের স্থিতিশীল রাজনীতির বাতাস সকলের নিকট কাক্সিক্ষত। শালীনতা, সহনশীলতা এবং উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকলেও বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রভাবে সেগুলো প্রায় হাতের নাগালে। নির্ভয়ে বাইরে বের হওয়া, শান্তিতে বসবাস করা- সবকিছুই জনগণের প্রত্যাশিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হঠকারি রাজনৈতিক কর্মসূচি- যা মানুষের শঙ্কার কারণ হয়- তা কখনোই প্রত্যাশিত নয়।

এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনমূলক নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সকলের নিকট কাম্য। সকলকে মনে রাখতে হবে, ধীরগতি সব সময়ই কল্যাণের পথে ধাবিত হয়। সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য তা মঙ্গলজনকও বটে। মঙ্গলজনক রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় দেশে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার ও সরকারবিরোধীদের যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সতর্কভাবে চলার সুযোগ এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। 
ইতোমধ্যেই বিএনপি বুঝতে পেরেছে যে, তারেক জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন ফলপ্রসূ করার সম্ভাবনা মোটেও নেই। কারণ, ভূরাজনৈতিক বিচারে বিদেশে বসে দেশীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যে কারণে এত কিছুর পরও বিএনপির আন্দোলনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। কারণ, আন্দোলনের প্রধান সমস্যা হলো এর সঙ্গে জনপ্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার। নির্বাচন-পরবর্তী কূটনৈতিক তৎপরতা এই মুহূর্তে শতভাগ সরকারের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রও তার আগের ভূমিকা থেকে সরে এসে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক ইতিবাচক বার্তা দেশের জন্য যথেষ্ট মঙ্গলজনক বলে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করে গড়ে তুলতে তাদের সদিচ্ছা একাধিকবার প্রকাশ করেছে। নানা কারণেই ৭ জানুয়ারির পর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের অনেক নেতা নিজেদের আত্মসমালোচনায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকে ভুল বলেও আখ্যায়িত করেছেন। 
রাজনীতিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে। তবে বর্তমানের মতো বিএনপির দ্বিধাদ্বন্দ্ব এতটা আগে দেখা যায়নি। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। তবে সত্য এবং ন্যায্য কথা নিশ্চয়ই থাকতে হয়। পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের যথাযথ কমিটমেন্ট জরুরি। সে কমিটমেন্টটি জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হয়। জনগণের নিকট কমিটমেন্ট না থাকলে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া দুস্কর। আপাতত বিএনপির কোনো দৃশ্যমান রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নেই। এমনকি কোনো আন্দোলন কর্মসূচিও নেই।

তাদের প্রতি জনসমর্থনও দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে তাদের আন্দোলনে যাওয়ার কোনো ইস্যু কিংবা জোরালো কোনো সুযোগ নেই। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলা যায়, বেশ কিছু রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে ইতোমধ্যেই বুমেরাং পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দলকে সুসংগঠিত করা, জনগণের সমর্থন আদায়, আন্তর্জাতিক সমর্থন তাদের পক্ষে নেওয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তারা এখন ঘূর্ণিপাকে। নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তে বারবার নিজেরাই হোঁচট খাচ্ছে। 
সাধারণ মানুষের মনেও এখন প্রশ্ন একটাই- বিএনপি এখন কী করবে? সরকারও বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক ও সজাগ রয়েছে। এই মুহূর্তে সরকার তাদের নিজেদের কর্মকা-ে অনেকটা ইতিবাচক স্থানে রয়েছে। বেশ কিছু ইস্যুতে সরকার যেমন সফলতা দেখিয়েছে, ঠিক তেমনি বিএনপিও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে যথেষ্ট। তবে বিএনপিকে দুর্বল মনে করাও উচিত হবে না সরকারের। কারণ, বিএনপির মাঠ পর্যায়ে কিছুটা হলেও জনপ্রিয়তা রয়েছে।

পরিস্থিতির কারণে ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারালেও আবার এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই পারে যাতে বিএনপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে পারে। ইতোপূর্বে অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি যে, সরকার কখনোই চাইবে না যে, তাদের জনপ্রিয়তা চলে যাক আর বিরোধীরা অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠুক।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দল অংশগ্রহণ না করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব সময়ে আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচন নিয়ে কিছুটা বিরূপ থাকলেও পরবর্তীতে নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতা দেখে তারা ইতিবাচক ভূমিকা প্রদর্শন করেছে। 
বিএনপি সঙ্গত কারণেই এখন বুঝে গেছে ২০২৯ সালের আগে কোনো সংসদ নির্বাচনের সুযোগ নেই। সাংগঠনিক অবস্থা ধরে রাখার বিষয়টিই এখন তাদের প্রাধান্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীদের অংশ নিতে দেখা গেছে। বিএনপিকে তাদের নিজেদের অবস্থান পুনরুজ্জীবিত করতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হতো। যদিও এ বিষয়ে তাদের মনে যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।

কারণ, বিএনপি যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছে সেটি তাদের জন্য ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তারা অনেকটা ‘ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড এবং টু স্টেপস ব্যাক’ নীতির মতো করে চলছে। 
অন্যদিকে ক্রমেই আওয়ামী লীগ সরকারের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতির প্রেক্ষিতে মনে হয়েছে, প্রতিপক্ষ কিংবা বহির্বিশ্বের কোনো চাপ বর্তমানে সরকারের ওপর নেই। প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের এমন আত্মবিশ্বাস বিএনপির জন্য ক্রমেই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সরকারের এই আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিতে বিএনপির জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। একদিকে সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, অন্যদিকে নিজেদের যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারায় দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে বিএনপির। বর্তমানে উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ই বহির্বিশ্বের কাছে সরকারের অন্যতম প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। 
প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলে যাচ্ছেন, ‘দেশ এগিয়ে যাবে।’ এটি নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস ও সাহস। মূলত বিএনপি-জামায়াতের বিগত সময়ের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলেই এ শক্তি তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। প্রতিপক্ষকে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো চাপের কাছে সহজে নতি স্বীকার করে না। এই মুহূর্তে দেশকে এগিয়ে নিতে সরকারের কর্মকা-ের গঠনমূলক সমালোচনা করাই বিরোধীদের দায়িত্ব হওয়া উচিত।
 
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

×