
ড.মো.শফিকুল ইসলাম
২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ফল প্রকাশিত হয়েছে। গড় পাশের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। গতবার পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার পাশের হার বেড়েছে। এটি নিঃসন্দেহ ইতিবাচক দিক। এবার ছাত্রদের পাশের হার ৮১.৫৭ শতাংশ, ছাত্রীদের পাশের হার ৮৪.৪৭। ৫১ টি কেন্দ্রে কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। খবরটি খুবই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে ফল প্রকাশের পর যারা অভিভাবকদের আশানুরূপ ফল অর্জন করতে পারেনি, সেসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানাই। কারণ, এতে দেশের বা পরিবারের অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। কষ্টে বা অভিমানে কেউ কেউ জীবনের অবসান ঘটাতে পারে। যেমন- এসএসসির ফলে অকৃতকার্য হওয়ার খবরে মাগুরার কথা সাহা নামের এক ছাত্রী চতুর্থতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যা কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক।
সারাদেশে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৬১৪টি। যা ভালো খবর। এ রকম যদি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত, তাহলে দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসত। এজন্য যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাশ করেছে, তাদের পুরস্কৃত করা হোক। যা শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করবে এবং কাজের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল করবে।
এখন যে হারে শিক্ষার্থী মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করে, তা প্রশংসনীয়। দুঃখের বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষায় কতজন ভর্তি হতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ আসন সংখ্যা রয়েছে, সবাই কিন্তু উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। আসন সংখ্যা সীমিত। যে পরিমাণ শিক্ষার্থী পাস করে, সেই পরিমাণ আসন সংখ্যা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই।
তাই অনেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে। আমরা সবাইকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে দিতে পারছি না, এটা কোনো বিষয় না। কারণ, সবাইকে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হতে হবে না। সবাই যদি উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হয়, তাহলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরিতে লোক পাওয়া যাবে না। শিক্ষা জাতির মেরুদ- বলে সবাইকে উচ্চ শিক্ষায় যাওয়ার দরকার নেই।
শিক্ষাকে বহুমুখী হতে হবে। যেমন- কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন হতে হবে। তাহলে শিক্ষা জাতির মেরুদ- বলে যে কথা, সেটা বাস্তবায়ন হবে। সবাই উচ্চ শিক্ষায় গেলে কারিগরি বা টেকনিক্যাল শিক্ষায় কারা পড়াশোনা করবে। কারিগরি শিক্ষা যদি সত্যি উন্নত করা যায়, তাহলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধা বাড়বে।
কেউ কেউ মনে করছেন, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করলে উচ্চ শিক্ষায় আসন নিয়ে যে সমস্যা হয়ে থাকে, তা কমে যেতে পারে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান কমে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা বাড়ানো যাবে না। তবে কিছু কলেজে নানা শর্তে আসন সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
পরিবর্তে এসব শিক্ষার্থীকে কিভাবে কারিগরি শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করা যায়, সে বিষয়ে যদি সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। সবাই যদি সাধারণ শিক্ষায় পড়াশোনা করে, তাহলে আমাদের টেকনিক্যাল পেশায় লোকের অভাব পড়ে যাবে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারছি কি? এটি একটি বড় প্রশ্ন। শুধু পাশ করলেই হবে না, তাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এজন্য ভালোমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যার জন্য সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ডিজিটাল এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞান ও সব তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সবাইকে ঐসব প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
বাস্তবিক অর্থে শিক্ষা খাতের মূল সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে বড় এবং মূল সমস্যা অনেক শিক্ষকের অদক্ষতা। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় কেন আসতে চাচ্ছে না, সেটা ভাবার সময় এখনই। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী না হলে শিক্ষার গুণগতমান বাড়ানো সম্ভব নয়।
এসব সমস্যার সমাধানের জন্য শিক্ষা খাতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা করবে। শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের গাইড বই, কোচিং সেন্টারের অভ্যাস এবং মুখস্ত বিদ্যার ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যার জন্য অভিভাবক এবং শিক্ষকদের আরও বেশি সচেতন এবং দায়িত্বশীল হতে হবে।
তরুণ বয়সে শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি বর্তমানে করোনা মহামারির চেয়েও বেশি মারাত্মক এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এজন্য পিতা-মাতার বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে ছেলেমেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নেতিবাচক কাজে আসক্ত না হতে পারে।
উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নের জন্য মূলে কাজ করতে হবে। মূল মানে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার আরও উন্নয়ন হওয়া উচিত। শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা উচিত। তাহলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করতে আগ্রহী হবে। এতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান না বাড়ানো হলে উচ্চ শিক্ষায় গলদ থেকেই যাবে। তাই সরকারের উচিত, প্রাথমিক লেভেলে কিভাবে গুণগত পরিবর্তন আনা যায়, সেটা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
নারীরা যদিও এগিয়ে আছে অনেক জায়গায়, দেশে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষায় নারীদের উপস্থিতি বেশি হলেও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত এ চিত্র ঠিক নয়। কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। উচ্চশিক্ষায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে নারীরা।
২০২২ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ৫৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ নারী হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী ৩৭ দশমিক ৫৮শতাংশ। তাই নারী শিক্ষার্থীদের কিভাবে উচ্চশিক্ষায় বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যায়, তা নিয়েও কাজ করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ