.
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধের পটভূমির মেয়াদ আরও সুদীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল দুই ভূখ-। পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যাপকভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিনের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আপামর বাঙালি জনতা। ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে স্বাধীনতা লাভ করে প্রিয় বাংলাদেশ। সেই পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয়। গত ২৫ এপ্রিল ফাস্টপোস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, শাহবাজ শরিফ বলেছেন, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন তাদের আমাদের জন্য বোঝা মনে করা হতো। বলা হতো এ অংশটি ‘পাকিস্তানের ওপর একটি বোঝা।’ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বোঝা এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ফলে বাংলাদেশের দিকে তাকালে এখন আমাদের লজ্জা হয়। কারণ, বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ওই সময়ে আমি খুবই তরুণ ছিলাম। আমাদের বলা হতো বাংলাদেশ একটি বোঝাস্বরূপ। কিন্তু আজ সবাই জানেন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সেই বোঝা কোথায় পৌঁছে গেছে। আমরা এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পাই।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ বহুলাংশে একটি ইতিবাচক ও অর্থবহ সংবাদ। কিন্তু এ উচ্ছ্বাস নিয়ে আমাদের তৃপ্তির ঢেকুর তুললে চলবে না। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে আমরা ঠিক করেছি। এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সব মানুষকে একত্রিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দায়িত্বশীল ও উদ্যোগী হয়ে দলমত নির্বিশেষে দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনের নিমিত্তে নিজ নিজ জায়গা থেকে কর্মঠ ও মনোযোগী হয়ে দেশের জন্য ভূমিকা রাখার সদিচ্ছা লালন করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটিকে বাস্তবায়নে আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
তবে সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানের মতো দেশের ইতিবাচক স্বীকৃতি এ দেশে যারা এখনো পাকিস্তানপন্থি, বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে দেশের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য এ বার্তা কিছুটা হলেও শাপেবর হবে। শুধু তাই নয়, যারা এখনো বলে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার তেমন প্রয়োজন ছিল না, অখ- পাকিস্তানের পক্ষে যারা এখনো যুক্তি প্রদান করে, তাদের নিজেদের সংশোধনের জন্য হলেও এ ধরনের বার্তা বিশেষ ইঙ্গিত প্রদান করে। এছাড়াও মহান স্বাধীনতার পক্ষে যারা সশস্ত্র সংগ্রামসহ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসংশ্লিষ্ট কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের ত্যাগ, সাহস ও অংশগ্রহণের যৌক্তিকতাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্যও একটি অনুঘটক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সূচকের বিভিন্ন প্যারামিটারে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে যোজন যোজন দূরত্বে এগিয়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশ যোগ্যতার জায়গা থেকে প্রতিনিধিত্ব করছে। যেখানে পাকিস্তানের ক্রমমান ক্রমশ নি¤œতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে ইতিবাচক ও যথার্থ ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের মর্যাদা ও গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী মজবুত হচ্ছে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে এ সকল জায়গায় পাকিস্তানের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই বিভিন্ন ফোরাম ও প্ল্যাটফর্মে পাকিস্তানের নেতৃত্ব পর্যায়ের ব্যক্তিগণ বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের অবস্থানকে তুলে ধরেন।
জাতীয় একটি দৈনিকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মাথাপিছু আয়ের সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার, ভারতে ২ হাজার ৬১২ ডলার এবং পাকিস্তানে তা হলো ১ হাজার ৪৭১ ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ ডলার, পাকিস্তানের ১৮০ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের ছিল ১ হাজার ৪৭০ ডলার।
বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে ৬.০৭ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ৩-৪ শতাংশ। স্বাধীনতার সময় জিডিপির ৬-৭ শতাংশ আসত শিল্প খাত থেকে। তখন পাকিস্তানের শিল্পের অবদান ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প খাতের অবদান জিডিপির ২৯ শতাংশ। এদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ। যেখানে ভারতে হচ্ছে ১.৪১ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২.৫৫ শতাংশ। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটির মতো। আয়তনে আমাদের চেয়ে পাঁচগুণ বড় পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি। এখন আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৬ লাখ। পাকিস্তানের ২৪ কোটি। শ্রম শক্তিতে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতি তিনজনের একজন নারী কাজ করে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি পাঁচজনের একজন কর্মক্ষম নারী। অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ নারী, যা ভারতে ২৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২০ শতাংশ। নারী কর্মসংস্থানে ভারত-পাকিস্তান থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২.৪ বছর। ভারতে এ সংখ্যা ৭২ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৯ বছর। শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ৩০, ভারতে ৪০ এবং পাকিস্তানে এর সংখ্যা ৭০ এর বেশি। প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের সাফল্য প্রায় শতভাগ। বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার হার ৪২ শতাংশ। পাকিস্তানে এই হার অর্ধেকেরও কম ১৫ শতাংশ এবং ভারত এ ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গড়ে ১২.৪ বছর ধরে লেখাপড়া করে। যেখানে পাকিস্তানের হার ৮.১ বছর। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে ১২৯তম। ভারত ১৩২ এবং পাকিস্তান ১৬১তম।
গত অর্ধশতাব্দীর কিছু বেশি সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭১ গুণ। রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। রিজার্ভ প্রায় চারগুণ বেশি। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ২৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে সাড়ে ৯ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান গত অর্থবছরে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখন ৬০ শতাংশ বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ আছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাবে, নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে পাকিস্তানের মানুষ পিষ্ট। সবশেষ গত নভেম্বরে পাকিস্তানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৪৬০ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার কোটি ডলার। পাকিস্তানের জিডিপি আকার ৩৪৮ বিলিয়ন বা ৩৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৩.৫ শতাংশ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। পাকিস্তানে ৭৫ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। বাংলাদেশে প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেকারত্ব হার মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ৬ শতাংশের ওপরে। কাজেই বাংলাদেশের অর্জনের ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করতে বর্তমান সরকার ঘোষিত কর্মসূচি বিশেষ করে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যথাযথ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের অবস্থানকে বিশ্বে আরও সুসংহত করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়