ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

তীব্র তাপপ্রবাহে অতীষ্ঠ জনজীবন

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫২, ২২ এপ্রিল ২০২৪

তীব্র তাপপ্রবাহে অতীষ্ঠ জনজীবন

তীব্র তাপপ্রবাহে অতীষ্ঠ জনজীবন

আপাতত আমাদের সামলাতে হবে পর পর বৈশাখ, জৈষ্ঠ্যের অসহনীয় তাপপ্রবাহ। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে অনেক কিছু তছনছ হলেও আম গাছে আম দৃশ্যমান হওয়া বাঙালিদের এক পরম পাওনা। আমরা জানি রৌদ্রের খরতাপে আম পাকার মৌসুম সবাইকে মিষ্টি মধুর আমেজে ভরিয়ে তুলবে। ভালো-মন্দের অবিমিশ্র দ্যোতনায় বাংলার যে ঐতিহ্যিক প্রাচুর্য ভাঙা-গড়ায় তাকে সম্মুখযুদ্ধে সামলানো লড়াকু বাঙালির অপরাজেয় এক কর্ম ও মানস দক্ষতা তো বটেই

ষড়ঋতুর নানামাত্রিক আবেদনে আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ পালাক্রমের অনন্য পর্যায়। ঋতুবৈচিত্র্যের রূপ, রস, গন্ধ আর অনুভবে যে ফারাক তাও নদীমাতৃক বাংলার হরেক রূপান্তরের ভিন্ন মাত্রার যাত্রা। এখন আমরা ১৪৩১ বঙ্গাব্দের সূচনা মাস বৈশাখ অতিক্রম করছি। প্রচ- তাপপ্রবাহে গ্রীষ্মের শুরু করার পথেই জনজীবন অতীষ্ঠ, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সারাদেশ তাপমাত্রা ৪০০ সেলসিয়াসকে সহ্য করে দারুণ অগ্নিবাণকে আলিঙ্গন করছে।

উত্তর-দক্ষিণ বঙ্গ তো ৪২০-কে রীতিমত মোকাবিলায় গ্রীষ্মের তপ্ততায় হিমশিম খাবার দুরবস্থা। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের গরম আবহাওয়া অসহনীয় এক অগ্নিঝরা পর্ব বলাই যায়। কবিগুরুর মতে তো সেই ‘অগ্নি¯œানে শুচি হোক ধরা।’ প্রখর সূর্যের কিরণ কতখানি শুচি বর্ষণ করে তা বলা মুশকিল। কিন্তু যাপিত জীবনের কষ্টকর রৌদ্রতাপ যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিপ্রবাহ। দেশের সিংহভাগ জেলায় এই মুহূর্তে বইছে খরতাপের প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম।

বৈশাখ এবার তার আগমনী ধ্বনি জানান দেওয়ার আগেই যেন উষ্ণ আবহাওয়াকে আলিঙ্গন করে সেই চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকে। প্রাকৃতিক বৈভবে বাংলার অপরিমেয় রূপশৌর্য সেই পুরাকালের এক পরম নির্মাল্য, যা আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও যেন বহমান। তবে এমন জীবন অতীষ্ঠ করা উষ্ণ আবহ প্রাক শিল্পযুগে ছিল না বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নানাভাবে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে চলেছেন সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের ক্রান্তিলগ্ন থেকেই।

নিত্যনতুন প্রযুক্তি বিশ্বকে নবসম্ভাবনায় নতুন যুগ উপহার দিলেও কত বিপন্নতার সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করে তা বুঝতেও বিশ্ববাসীকে গোটা এক শতক অপেক্ষমাণ থাকতে হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া শিল্প বিপ্লবের বহুমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে তার বাস্তবতা ব্যাকুল করার দুরবস্থা। তখন থেকেই নিসর্গ বিজ্ঞানীরা সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে থাকেন প্রকৃতি সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যতিরেকে উষ্ণ আবহ নিয়ন্ত্রণ করার দ্বিতীয় কোনো রাস্তা কিংবা সুযোগই নেই।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বাতাসে যে কার্বন নিঃসরণ করে সেখান থেকেই প্রকৃতি অনধিগম্য এক সময় পার করছে। এমন জীবন বিপন্ন করা আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার লাগাম টেনে ধরাও বিরূপ আবহের ন্যায্যতা। কিন্তু উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিকাশ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ অসম্ভব বলে আধুনিক বিজ্ঞানীদের বদ্ধমূল ধারণা। তবে পাশ্চাত্যের অতি উন্নত দেশগুলো যে মাত্রায় যান্ত্রিক সভ্যতায় নিজেদের যাপিত জীবন সমৃদ্ধ করে সেখানে কার্বন নিঃসরণ হয় সবচেয়ে বেশি।

আবার এশিয়ায় জাপান, চীন, ভারতের মতো উন্নত দেশগুলোও অপেক্ষাকৃত বেশি কার্বন ঢালে শান্ত-¯িœগ্ধ প্রকৃতিতে। তবে বাংলাদেশ নাকি কার্বন নিঃসরণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বেশ পিছনে। কিন্তু উষ্ণতার বিপরীত আবহে আবর্তিত হচ্ছে অনেক বেশি। এটাও যেন সহজাত প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর তুলনায় একবিংশ শতক আরও উষ্ণতার চরম শিখরে নিত্যনতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান ধারায়। আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশও সেখান থেকে আলাদা থাকতে পারছে না।

গরমকালের তাপপ্রবাহ এপ্রিল-মে মাস চরম সময় পার করে। এপ্রিলের মাঝপথে বৈশাখের শুরুতেই অত্যধিক কাঠফাটা রোদে আমরা বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন পার করছি। সামনে অপেক্ষমাণ অসহনীয় মে মাস। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের মহাসম্মিলনে এক প্রখর গরমের সন্ধিকাল। শুধু কি তাই? বৃষ্টির ছিটেফোঁটা দেখা না যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাকাল। গ্রীষ্মকালের বৃষ্টিতে তাপপ্রবাহ কমে ঠিকই, কিন্তু ভ্যাপসা গরমে কাবু হতে হয় সংশ্লিষ্ট মানুষকে। তেমন খরতাপে জীবনমান একেবারেই ওষ্ঠাগত। সারাদেশেই তাপমাত্রা বাড়ছে। ঢাকায় কখনো ৩৭.৬০ সেলসিয়াস আবার দক্ষিণবঙ্গের পটুয়াখালী, কলাপাড়ায় সর্বোচ্চ ৪০০ সেলসিয়াস, যা মূলত তাপমাত্রার অসহনীয় দাপটে সারাদেশ নাকাল হওয়ার দুরবস্থায়। রাঙ্গামাটিতেও ৪০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা জনজীবন ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। কৃষিপ্রধান আবহমান বাংলা। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা সুশোভিত শ্যামল বাংলা।

তেমন ঐহিত্যকে ধরে রাখাও চিরায়ত স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। শস্যের জন্য যেমন বৃষ্টির অবারিত ধারা আবশ্যক, একইভাবে রৌদ্র¯œাত অগ্নিঝরা প্রতিবেশও সবুজ বাংলাকে স্বয়ম্ভরতার সীমানায় ভরে দিয়েছে। এটাও কম প্রাপ্তি নয়। ছায়াঘেরা, শান্ত-¯িœগ্ধ বাংলাদেশ নৈসর্গের যে অবর্ণনীয় লীলাক্ষেত্র সেভাবে গ্রীষ্মকালই শুধু নয়, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত আর শীতের মতো প্রাচুর্যময় প্রকৃতির সমারোহও বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ব-দ্বীপের অভাবনীয় ঐশ্বর্য।
তবে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রায় অনেক কিছু বিপর্যস্ত হলেও শস্যভা-ারের প্রাপ্তিও উল্লেখ করার মতো। চা শিল্পনগরী সিলেটের হাওড় অঞ্চল মূলত শস্যধানে নজর কাড়া হয়েছে। তেমন সুসংবাদ অত্যধিক গরমেও স্বস্তিদায়ক। সুনামগঞ্জে বিভিন্ন হাওড় প্রাঙ্গণে সোনালি শস্যের হাসি মাতিয়ে দেওয়ার মতো। সেই পুরাকালের কবি-সাহিত্যিকদের শস্যভা-ার নিয়ে অঙ্কিত তেমন বর্ণাঢ্য সমরোহ যেন ধনেধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, যা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অকুণ্ঠচিত্তে যে বাণী বঙ্গভূমিকে উপহার দেন তা আজও শতকণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে শ্যামল বাংলার শৌর্যকে যেন প্রণতি জানায়।

সোনালি ধানের রূপ-রস ভরা ম-ম সুগন্ধ যেমন বাতাসকে আকুল করছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলবাসীদের খাদ্যের সংস্থান দিয়ে যাপিত জীবনকে পূর্ণ করে চলেছে। সুনামগঞ্জ হাওড়ের প্রধান শস্য আবহমান বাংলার বোরো ধান। যার অভাবনীয় ফলনে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের আহারের সংস্থান হয়। ভেতো বাঙালির ভাতের তেমন আকালই হয় না বলা যায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত শ্রমে কৃষকদের যেন দৈনন্দিন কর্মসাধনা। সেটা আবার এই অঞ্চলের মূল আহারের জোগানও দেয়।

তবে গোলায় ধান তোলা পর্যন্ত কৃষি শ্রমিকদের হরেক অস্বস্তিতে সময় পার করাও এক দোলাচল বিষয়। কারণ অকাল বন্যা, অতিবৃষ্টি বা অন্য কোনো দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে অঞ্চলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। কারণ খেতের বিভিন্ন ফসলেই তারা পরিপূর্ণ হয় ভাতে-মাছে চিরায়িত বাঙালিয়ানায়। এর ব্যত্যয় আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় শতগুণ। এখান থেকে বিপুল জনগোষ্ঠীর সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান। তাছাড়া উৎসব, আয়োজনেও পরিকল্পিতভাবে সাজানো-গোছানো যেন দায়বদ্ধতা।

তাই এই সময়কে মূলত সম্মুখসমরে মোকাবিলা করা যেন সূর্যের প্রচ- তাপে পরিবেশ আর জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস। শুধু তাই নয়, বরং হরেক রোগবালাইও উপস্থিত বিপন্নতাকে বেশ বাড়িয়েই দেয়। অত্যধিক গরমে ঘাম বসে ঠা-া লাগা থেকে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই, যা শারীরিক যন্ত্রণার আর এক উপশম তো বটেই। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে প্রচ- গরমে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে। তবে এবার ঈদের দীর্ঘ ছুটি থাকায় চিকিৎসা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবার হরেক বিপন্নতা আক্রান্ত রোগীদের জন্য এক বিপরীত আবহ।

বিশেষভাবে আক্রান্ত যখন বেশি শিশুরাই সেখানে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউটে রোগীদের ভিড় লক্ষণীয়। গরমে নাভিশ্বাস হওয়া মানুষের আহার গ্রহণেও সতর্ক-সাবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক যতœশীল হওয়াও পারিবারিক দায়বদ্ধতা। বাচ্চাদের কোনোভাবেই বিপত্তিকর পরিবেশের ধারে-কাছে নেওয়াই যাবে না। আর বয়োবৃদ্ধদেরও পরিবেশের দুঃসময় থেকে ফারাকে রাখা পারিবারিক আবহে বিশেষ সচেতন কর্তব্য।

দুর্বল রোগাক্রান্ত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রতিও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে তাদের সুস্থ সবল রাখা অনুজদের দায়িত্ব। প্রচ- গরমে যেমন ক্লান্তি, অবসাদ ভর করে, তেমনি দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজে নিতে হবে। সেখানেই মিলবে নানামাত্রিক উত্তরণের পথ। শিশু এবং বয়োবৃদ্ধ যারা নিজেদের যতœ নিতে এক প্রকার অপারগ সেখানে পরিবার থেকেই তাদের যত্ন-আত্তির সুবন্দোবস্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। 
ঋতুপ্রবাহের সুনির্দিষ্ট যাত্রাপথ সব সময় সমান কিংবা সরলীকরণ হয় না। কারণ গত বৈশাখেও আমরা ¯িœগ্ধ আবহে কিছুটা বসন্তের আমেজ উপভোগ করেছি। এবার তার চিত্র অন্যরকম। বসন্ত আর বর্ষ বিদায়ের আগে খরতাপ গ্রীষ্মকাল তার উদাত্ত আহ্বান জানান দিলে প্রকৃতির ছায়ায় আবিষ্ট মানুষ কেমন যেন নড়েচড়ে বসছে। ছয় ঋতুর অভাবনীয় আবহ শাশ্বত বাংলার অপরিমেয় শৌর্য। সেটা যেমন কাঠফাটা রোদের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ কিংবা বর্ষণমুখর বর্ষামঙ্গলেই হোক না কেন।

আবার শরতের স্নিগ্ধতার পাশাপাশি ভাদ্র মাসের যে প্রখর তাপপ্রবাহ তাও কোলের সন্তানদের চিরচেনা অনন্য বাংলা। হেমন্তের পাকা ধানের সোঁদা গন্ধে ব্যাকুল হওয়া কৃষক থেকে ভূস্বামী পর্যন্ত এক অবারিত সুখ স্বপ্নের নির্মাল্য। সব মিলিয়ে চিরায়ত বঙ্গভূমির যে রূপ-মাধুর্য তা সর্বকালের অবিস্মরণীয় কর্মদ্যোতনা বললে অতিকথন নয় কিন্তু। তবে আপাতত আমাদের সামলাতে হবে পর পর বৈশাখ, জৈষ্ঠ্যের অসহনীয় তাপপ্রবাহ।

কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে অনেক কিছু তছনছ হলেও আম গাছে আম দৃশ্যমান হওয়া বাঙালিদের এক পরম পাওনা। আমরা জানি রৌদ্রের খরতাপে আম পাকার মৌসুম সবাইকে মিষ্টি মধুর আমেজে ভরিয়ে তুলবে। ভালো-মন্দের অবিমিশ্র দ্যোতনায় বাংলার যে ঐতিহ্যিক প্রাচুর্য, ভাঙা-গড়ায় তাকে সম্মুখযুদ্ধে সামলানো লড়াকু বাঙালির অপরাজেয় এক কর্ম ও মানস দক্ষতা তো বটেই। যুগ-যুগান্তরের চিরস্থায়ী শৌর্যে অম্লান আমাদের এই বাংলাদেশ। তার প্রাকৃতিক সম্ভারের সঙ্গে অনবচ্ছেদ করেছে নব্য প্রযুক্তির আধুনিকতাও। 

লেখক : সাংবাদিক

×