ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন

ড. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ৮ মার্চ ২০২৪

আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন

.

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বৈশ্বিকভাবে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যথাক্রমে সপ্তম পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের -দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর ফলে ইতোমধ্যেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিক্ষয়জনিত ঝুঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর বরাবর উপকূলীয় তটরেখার ৭১০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বসবাসরত প্রায় কোটি পরিবারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো পরিষেবায় প্রবেশ অন্তর্ভুক্তি পরস্থিতি খুব সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬৯ শতাংশ উপকূলীয় উপজেলায় সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো বর্তমানে গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে, যা বাংলাদেশের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা , , , ১৩ নম্বর সূচক অর্জনকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড, শেফিল্ডসহ খ্যাতনামা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের সাতজন গবেষকের করাক্লাইমেট থ্রেটস টু কোস্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট আউটকামশীর্ষক ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার , , , ১৩ নম্বর সূচক ৫০-৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা গেলে, জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকার এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ শতাংশ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সঙ্গে অভিযোজনে সক্ষম হতে পারে। তবে জন্য বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দরিদ্রমুখী উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ুর বিপজ্জনকরকম পরিবর্তনে দরিদ্র অরক্ষিত অবস্থায় থাকা মানুষ সম্প্রদায়ের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই শ্রেণির মানুষের জীবনকেই সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলেছে। জলবায়ু পরিববর্তনের প্রভাবে সমগ্র উপকূল অঞ্চলজুড়ে দরিদ্র পরিবারগুলো ধনী আর্থসামাজিক অগ্রসর গোষ্ঠীর তুলনায় বেশি হারে খাদ্য, বাসস্থান শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদা পরিষেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে শিক্ষা সুবিধার ক্ষেত্রে মধ্যম বা ধনী গোষ্ঠীর তুলনায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী বর্তমানে যথাক্রমে .০৭ গুণ এবং .১৩ গুণ বেশি বঞ্চিত হচ্ছে, যা ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততার তীব্রতায় আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি, ফলন কমছে ক্রমাগত। এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতিবছর উপকূলীয় জেলাগুলো ৩০ লাখ টনেরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি থেকে আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি উৎপাদনবঞ্চিত হবে। ফলে, বিপুলসংখ্যক অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হবে। প্রধান খাদ্যশস্য ধান ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য শস্য যেমন পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে; যার প্রধান কারণ শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা, খরা পরিস্থিতি প্রভৃতি। ফলে, উপকূলীয় মানুষের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু কৃষিই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত-ক্ষেত্র সংকটে পড়েছে। যেমন দেশে প্রায় লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং ১১ কোটি হেক্টর চিংড়িঘেরে মাছ চাষ হয়। ছাড়া ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়, যেমন নদী, হাওড়, বিল, খালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ বাস করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রভাবে এই মৎস্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। কারণে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে, যা প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের ওপর, যাদের জীবিকা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান সময়ে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ায় মানুষ তাদের সব হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছে, যাদের পুনর্বাসন আবার করতে সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে নিজ এলাকা ছেড়ে বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে অপরিকল্পিতভাবে বিকাশমান শিল্পকারখানা শ্রম ব্যবস্থায় জড়িত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবমতে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাত তাপমাত্রাজনিত অস্বস্তি বা হিট স্ট্রেসের কারণে বর্তমানে দশমিক ৫৯ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে, যা ২০৩০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যদি পোশাক কারখানাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবিষ্যতে এয়ার কন্ডিশনের ওপর বেশি নির্ভর করে, তাহলে তা বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন আরও বাড়িয়ে দেবে, যেখানে আবার আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত প্রায় পুরোপুরিভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। অন্যদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে দিনের মাঝামাঝি সময়ে মানুষের মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, ক্লান্তি বমি বমি ভাবের কারণে বাংলাদেশের মানুষের উৎপাদনশীলতা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে, গ্রীষ্মকালে অফিস-আদালত কর্মক্ষেত্রে তুলনামূলক উচ্চ অনুপস্থিতির হার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে গ্রীষ্মমন্ডলীয় শুধু ঘূর্ণিঝড়ের কারণেই বাংলাদেশে বছরে প্রায় বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ হারিয়ে যাবে এবং ভয়াবহ বন্যার ফলে জিডিপি শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে। একই সময়ে বাংলাদেশের কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিজ ভূখ- থেকে বিতাড়িত হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারণ পরিস্থিতি পরিবর্তনে বাংলাদেশের যেহেতু তেমন কিছু করার নেই, সেহেতু নিজ উদ্যোগেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং অন্যান্য দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশকে নিজের উদ্যোগেই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হতে হবে। জন্য সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তর শ্রেণিপেশার মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। সব সরকার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনোমতেই তা ভালো হবে না। ব্যক্তিপর্যায়ে বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, শস্য, লেবু, বাদাম বীজ এবং কম মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার খেলেও পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখা যায়; উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করা যায় এবং কম শক্তি, জমি এবং জলের প্রয়োজন হয়। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যদি বিদেশে অনুষ্ঠিত সভা-সেমিনারগুলো সম্পন্ন করা যায়, তাহলে বিপুল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো উড়োজাহাজে ওড়া এড়ানো যায়। রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাজারো ব্যক্তিপ্রচেষ্টা মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×