
বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে
বাংলাদেশ রেলপথের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রেলপথ সচল হয়েছিল। অনেক ব্রিজ (ভৈরব সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ) পুনর্নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু আশির দশকে রেলপথ পিছিয়ে পড়ে। সেই ঝিম ধরা রেলপথ এখন আগের চেয়ে বেশি সচল। প্রতিটি জেলায় রেল সংযোগ
পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, ঝাউবাগান পেরোনো বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর সমুদ্রের টানা গর্জনের সঙ্গে মিশে ট্রেন পৌঁছাবে বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে। এক সময় মানুষ স্বপ্ন দেখত ট্রেনে করে কক্সবাজার যাবে। সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন রইল না, তা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজারে এতদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সড়ক ও বিমান পথে পর্যটকদের আসার সুযোগ থাকলেও এখন থেকে যুক্ত হয়েছে নতুন এক যোগাযোগ ব্যবস্থা। জননেত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হলো কক্সবাজার।
১১ নভেম্বর ২০২৩ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সংযোগ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভ্রমণপীপাসু পর্যটকরা রেলগাড়িতে চড়ে সমুদ্র দেখতে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। ঢাকা-কক্সবাজার লাইন বাংলাদেশ রেলওয়ের এমন একটি রেলপথ, যেখানে যাত্রাপথে কখনো চোখে পড়বে নদীর সৌন্দর্য। মুগ্ধ করবে টিলা-পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। যেতে যেতে কখনো দুই ধারে দেখা মিলবে বিস্তীর্ণ ধানখেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য।
একপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়, সম্মুখ পানে সীমাহীন নীল সমুদ্রের হাতছানি। ঘন অরণ্যরাজির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কখনো যাত্রীরা চেয়ে দেখবেন চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বন্যহাতি চলাচলের পথ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ করে দেখিয়েছেন ট্রেন কক্সবাজারেও যেতে পারে। চট্টগ্রাম থেকে রেঙ্গুন রেলপথের পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশরা। সময়টা ছিল উনিশ শতকের শেষ দশকে অর্থাৎ ১৮৯০ সালে। ব্রিটিশদের পরিকল্পনায় ছিল আসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করে সেটাকে বার্মা (মিয়ানমার) নিয়ে যাওয়া। এজন্য ১৮৯২ সালে গঠিত হয়েছিল অসম-বেঙ্গল রেলওয়ে। চট্টগ্রামে এর প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৯২-১৯৪২ সাল পর্যন্ত এর উদ্যোগে অনেক রেলপথ তৈরি হয়েছিল।
১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটিশরা কক্সবাজার থেকে রামু পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে আর আগ্রহ দেখায়নি। ফলে ব্রিটিশদের এই প্রজেক্টটি পরিত্যক্ত হয়। এমনকি পাকিস্তানি শাসনামলেও এই রেলপথ সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দোহাজারী থেকে রেলপথের সম্প্রসারণের এই সাহসিকতার কাজটি দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯২ সালে প্রথম তিনিই ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত এই রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এজন্য এসকাপ কমিশন অধিবেশনে ইউরো এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়।
কিন্তু পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সেই রেল নেটওয়ার্ক চালুর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবারও আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেন। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাভুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে জনগণ এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে।
কক্সবাজারের নতুন রেলপথে চলাচলের জন্য টুরিস্ট কোচের আদলে উন্নতমানের কোচ যুক্ত হবে। ট্রেনে বসেই মানুষ অনায়াসে দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে। কক্সবাজারের ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেল স্টেশন। এটি দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রেলস্টেশন ভবনটি এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ভবনটি ছয়তলা। মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি করা হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা।
দেশী-বিদেশী পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আইকনিক রেলস্টেশনে রয়েছে লাগেজ স্টেশন, অভ্যর্থনা কক্ষ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিং মল, রেস্তরাঁ। একই দিনে কোনো হোটেলে অবস্থান না করে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ঘুরে আসার সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। ঢাকা থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টায় এবং চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘণ্টায় যাওয়া যাবে কক্সবাজারে। এর ফলে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতে দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড় বাড়বে। বয়ে আনবে পর্যটনের সুদিন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। নতুন এই ১০০ কিলোমিটার রেললাইনে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছল। এর মধ্যে আছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়াও পুরো রেলপথে নির্মিত হয়েছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট এবং ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথের দূরত্ব দেড় শ’ কিলোমিটার। সড়কপথে বাসে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। আর এ মহাসড়কে যানজটে পড়লে ছয়-সাত ঘণ্টাও লেগে যায়। বর্তমানে রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে এই ছয়-সাত ঘণ্টার দূরত্ব নেমে আসবে অর্ধেকে; কমবে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আর অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি আসার পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি হবে বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের। দেশের পর্যটনের খাতকে অনেক এগিয়ে নেবে এ রেলপথ। আগে দূরত্ব, যানজট ও দুর্ঘটনার ভয়ে অনেকে কক্সবাজার যেতে চাইতেন না। আবার দেশের অনেক মানুষ খরচের ভয়ে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সেকতে আসতে পারে না। কিন্তু এখন তারাও মাত্র ১৮৮টাকা টিকেটে ট্রেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার চলে আসতে পারবে। পর্যটকরা ট্রেনে সকালে গিয়ে রাতে বা পরদিন ফিরে আসতে পারবে। তাতে খরচও হবে কম।
ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ পর্যটন খাত ছাড়াও কক্সবাজারের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পর্যটনের পাশাপাশি রেলের সুফল পাবে কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের আরও কয়েকটি খাতে। সেসব খাতের মধ্যে রয়েছে- লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি। এসব পণ্য কম খরচে আনা-নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষিপণ্য সহজে আনা-নেয়ার সুবিধা থাকলে কৃষকেরও দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও কিছুটা গতি আনতে পারে নতুন এ রেলপথ।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির। সেই সঙ্গে চাপ কমবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের পরিবর্তন ঘটবে। চাঙ্গা হবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান। আবার এই রেলপথকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় পণ্য পরিবহনের হাব তৈরি করতে চায় রেলওয়ে। সেখান থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত একটি নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাতারবাড়ির সমুদ্রবন্দরটি চকরিয়ার মাধ্যমে দেশের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
তবে খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন নিয়মিত সেবাটা দিতে পারি। কারণ আমরা ভালো কিছু শুরু করার পর আর সেবা দিতে পারি না। সঠিক সেবা দিতে পারলে এই রেলপথ ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসবে। উন্নত যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সব সময় ব্যবসার প্রসারে ভূমিকা রাখে। ফলে এ জাতীয় বড় প্রকল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাণিজ্যে গতি বাড়বে।
বাংলাদেশ রেলপথের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রেলপথ সচল হয়েছিল। অনেক ব্রিজ (ভৈরব সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ) পুনর্নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু আশির দশকে রেলপথ পিছিয়ে পড়ে। সেই ঝিম ধরা রেলপথ এখন আগের চেয়ে বেশি সচল। প্রতিটি জেলায় রেল সংযোগ। এগুলো সম্ভব হচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। তার হাত ধরেই পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণের পথে রেলপথ চালু হয়েছে। নতুন রেলপথটি ঢাকার গেন্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর-ফরিদপুর গেছে। যমুনা নদীর ওপর নির্মাণ হচ্ছে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়