ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি

গোরা বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২৫ অক্টোবর ২০২৩

নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি

সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ২০১৩ সালে একটি কৃষিনীতি প্রণয়ন করেছে

সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ২০১৩ সালে একটি কৃষিনীতি প্রণয়ন করেছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দেশে একটি নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা, লাভজনক কৃষি তৈরি এবং টেকসই খাদ্য পুষ্টি অর্জন করা। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যে ভেজাল মজুতকারী ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হলে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসবে

ক্ষুধা নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি আছে- হাঙ্গার ইজ মোস্ট পাওয়ারফুল দেন এ কিং-এ রুলার। পৃথিবীতে ক্ষুধা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী একজন ক্ষমতাধর রাজা ও শাসকের চেয়েও। ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষের সর্বাগ্রে প্রয়োজন খাদ্যের।  খাদ্যের পেছনে মানবজাতির নিরন্তর ছুটে চলা। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি এ চলার শেষ নেই। ক্ষুধা হচ্ছে মানুষের  জীবনের অনিবার্য পরিণতি, খাদ্য হচ্ছে তার অবিচ্ছেদ একটি অংশ। তাই ক্ষুধা ও খাদ্য একে অন্যের পরিপূরক। ক্ষুধার বর্ণনায় কবি সুকান্ত পূর্ণিমার চাঁদকেও একখ- রুটির সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাতিসংঘ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা স্বাস্থ্যÑ এ পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে খাদ্যকে প্রথম স্থানে রেখেছে। এ কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা ও সমবণ্টন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত রয়েছে সবাই। সর্বোপরি, একটি টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বিশ্বের ১০টি খাদ্যোৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম। 

কৃষি প্রধান এই বাংলাদেশের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষি ও কৃষক। উর্বর মাটির ছোট এই দেশটি আজ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ১৩  জানুয়ারি মন্ত্রী পরিষদের প্রথম বৈঠকে কৃষকদের বকেয়া খাজনা মওকুফ ও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা রহিত করেন। তিনি কৃষি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ উন্নয়ন এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন। শাক-সবজি ফলমূল পুষ্টি চাহিদা পূরণে গড়ে তোলেন হর্টি কালচার বোর্ড। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পরিকল্পনা ও নির্দেশিত পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস শ্রম ও দূরদর্শিতার কারণেই দেশ আজ খাদ্যে স্বনির্ভর।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, রুপালি ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, আম উৎপাদানে সপ্তম, কাঁঠাল উৎপাদনে তৃতীয়, পেয়ারা উৎপাদানে অষ্টম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম উৎপাদনে দশম স্থানে রয়েছে বিশ্বে। যে দেশটি পাকিস্তান আমল থেকে ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে ছিল, খাদ্যাভাব ছিল নিয়তির বিধান, সে দেশটি খাদ্যাভাব দূর করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ আজ আধুনিক কৃষি থেকে স্মার্ট কৃষির যুগে প্রবেশ করেছে। এক ফসলি কৃষি জমি এখন চার ফসলি  জমিতে পরিণত হয়েছে। 
এত উৎপাদন ও উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উৎপাদিত পণ্য কতটা নিরাপদ ও তা পুষ্টিমান সম্পন্ন! অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যপণ্যগুলো কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে মাঝারি ও তীব্র- এই দুই ধরনের খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। মানুষের খাবার যখন ফুরিয়ে যায়, কোনো ধরনের খাবার থাকে না, মানুষ অভুক্ত থাকে, খাদ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধস নামেÑ এ অবস্থাকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলা হয়েছে। এমন লোকের সংখ্যা দেশে ১ কোটি ৮৭ লাখ। মাঝারি ধরনের খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে একটি দেশে যখন খাদ্য প্রাপ্তির বিষয়ে কোনো প্রকার নিশ্চয়তা থাকে না, বছরে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বাড়ে বা কমে এবং খাদ্যের মান নিম্নমুখী হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুষ্টির অভাবে ৫ বছর বয়সী ৩৯ লাখ শিশু খর্বকায় হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী লোকের মধ্যে ৯৯ শতাংশ রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কারণ, ১৯ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় শাক-সবজি ও ফলমূল খায় না। ২০ শতাংশ মানুষ কায়িক পরিশ্রম করে না। ২৫ শতাংশ মানুষ ধূমপানের কারণে এমন অবস্থায় পতিত হয়। 
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা এবং মানুষের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা। বিশ্ব সংস্থার মতে, একটি দেশে খাদ্যের পরিমাণ কতটা এবং তার সহজলভ্যতা ও ব্যবহার প্রক্রিয়া কেমন, তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা মানেই খাদ্যপণ্যের প্রাপ্যতা, প্রাচুর্যতা, সমবণ্টন ব্যবস্থা এবং ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মাপকাঠিতে বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য পুষ্টিমানের অবস্থা কতটা সন্তোষজনক ও যুগোপযোগী, সেটি এখন ভাববার বিষয়। আমরা খাদ্য বলতে শুধু ভাত, মাছ, মাংস আটা এগুলোই বুঝে থাকি। শাক-সবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ অন্যান্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারকে তেমন একটা আমলে নেই না। এর প্রধান কারণ, খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

দ্বিতীয়, সামাজিক কিছু গোঁড়ামি ও কুসংস্কার এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ খাদ্য গ্রহণে একটি বড় বাধা হয়ে আছে, যা সমাজ ও জাতিকে পেছনের দিকে টানছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন বাড়লেও চাহিদাও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পুষ্টি ঘাটতি আমাদের থেকেই যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে প্রয়োজন খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর খাবার নির্বাচন ও যোগ করা। অনেকেই মনে করেন, এর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। প্রচলিত ধারণাটি আজ পাল্টে গেছে। কেননা, আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করে। গ্রামের বাড়িতে ফরমালিন ও বিষমুক্ত টাটকা প্রচুর ফল শাক-সবজি রয়েছে। যেমন- আম, জাম, পেয়ারা, কামরাঙা, জাম্বুরা ও জলপাই ইত্যাদি। এসব বারো মাসই কমবেশি পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রচুর ভিটামিন সি, ম্যালিক এসিড, ফলিক এসিড, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়ামের মতো উপাদান রয়েছে, যা মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে ডেভেলপ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

এ ছাড়াও ছোট ছোট মলা ডেলা চাঁন্দা ডানকানা- এসবের মধ্যে প্রচুর ফসফরাস ও আমিষ রয়েছে, যা শিশুদের শরীর গঠন, মেধা বিকাশ ও অন্ধত্ব রোধে সাহায্য করে। এছাড়া প্রকৃতিক উৎস ভোরের কুয়াশা বিশুদ্ধ বায়ু সূর্য কিরণ ও হাটা-চলা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। গ্রামাঞ্চলে এসবের কোনো কমতি নেই। এ কারণে দেখা যায়, শহরের মানুুষের চেয়ে গ্রামের মানুষের রোগ ব্যাধি কম এবং গড় আয়ু একটু বেশি। তাই শহর কিংবা গ্রামে যেখানে যেটুকু পতিত জায়গা আছে, তা কাজে লাগানো প্রয়োজন। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, খাদ্য ও পুষ্টি অপচয়ের সংস্কৃতি থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। 
সরকার স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করে থাকে এবং কৃষি ক্ষেত্রে যতই উৎপাদন বাড়ুক না কেন, তার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাবে না। এক তথ্যে দেখা যায়, পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয় তা দিয়ে একটি দেশের এক বছরের ব্যয় মেটানো সম্ভব। বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী খাদ্য অপচয় ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান রেখেছেন বারবার। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, খাদ্যে ভেজাল, ক্ষতিকর রঙ ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে দেশের মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তাই পুষ্টি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিডনি, হৃদরোগ, লিভার ক্যান্সার, ব্লাড প্রেসার ও ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। যা একটি সুষ্ঠু জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক বিকাশের পথে অন্তরায়।

অতএব, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, ভেজাল ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দরিদ্র ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে এনে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রের। যে দেশ এ সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে দেশ পিছিয়ে থাকে। সরকার বিশেষ গুরুত্ব¡ দিয়ে ২০১৩ সালে একটি কৃষিনীতি প্রণয়ন করেছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দেশে একটি নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা লাভজনক কৃষি তৈরি এবং টেকসই খাদ্য-পুষ্টি অর্জন করা। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যে ভেজাল, মজুতকারী ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হলে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

শহর ও গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসডিজি অর্জনে অপুষ্টির হার কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : পরিবেশকর্মী

×