
.
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। বাঙালির প্রধান খাদ্য হলো ভাত। ভাত ছাড়া দৈনিক আমরা যা খাই তাতে গমের তৈরি খাবারই বেশি। অর্থাৎ, ভাতের পরেই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন হলো গম। গমের সিংহভাগ আমদানি নির্ভর। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি প্রায় ৫২ বছর হলো। দীর্ঘ এই সময়ে মানুষ দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও গমের উৎপাদন সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যদিও চালের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। আর চালের উৎপাদন ছিল মাত্র প্রায় ১ কোটি টনের মতো। তখন মানুষের ভাতের চাহিদা এই পরিমাণ চালে পূরণ হতো না। ফলে অনেক মানুষকে আধা পেটা কিম্বা বেঁচে থাকতে হতো।
সদ্য স্বাধীন দেশে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাৎকালীন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই না খেয়েও অনেক মানুষকে মরতে হয়েছে। ক্ষুদা এক নিদারুণ দুর্দশা। একমাত্র সেচভিত্তিক হাইব্রিড চাষাবাদের বদৌলতে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। বাড়তে থাকে সেচভিত্তিক বোরো ধানের চাষাবাদ। যা আজ মহীরুহে রূপ নিয়েছে। এখন বছরে প্রায় ৪ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়। ৭ কোটি মানুষের দেশ আজ ১৭ কোটিতে রূপ নিয়েছে। তবু কোনো মানুষকে না খেয়ে মরতে হয় না। বরং মানুষের রুচি বোধের পরিবর্তন হয়েছে। এখন মানুষ চকচকে ভালোমানের চালের ভাত খায়। শতভাগ না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। তবে ভাতের পরেই আটা ময়দার চাহিদা পূরণে যে পরিমাণ গমের প্রয়োজন দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, সে পরিমাণ তো নয়ই, তার কাছাকাছি পর্যায়ও গম উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। চাহিদার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ গম প্রতিবছর আমদানি করে মেটানো হচ্ছে চাহিদা। ফলে ব্যয় হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। আর বাড়তি দামে ভোক্তাদের আটা-ময়দা কিনে খেতে হচ্ছে।
এমন এক সময় ছিল, যখন গরিব মানুষ ভাতের বদলে আটার রুটি খেতো। সেই প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। এখন গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ আটার রুটির বদলে ভাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখন রুটি, পাউরুটি, নানা জাতীয় বিস্কুট, ফাস্টফুডের দোকানে আটার তৈরি খাবার এনেছে নতুন বৈচিত্র্য। বর্তমানে দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি খাদ্য আটা-ময়দার তৈরি। বাসা-বাড়িতেও এখন আটার ব্যবহার বেড়েছে। এক সময় চালের দাম ছিল বেশি। তখন মানুষ আটার রুটি খেত। এখন আটার দাম চালের থেকেও বেশি। ফলে নিম্নবিত্ত বা স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে রুটি-পরোটা অনেকটা বিলাসিতার মতো। অর্থাৎ যে হারে আটার চাহিদা বেড়েছে, সে হারে দেশে গমের উৎপাদন বাড়েনি। বরং গমের উৎপাদন অনেক কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গমের উৎপাদন ১৩ লাখ ৬ হাজার টন হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে গমের উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন। অর্থাৎ এক দশকে গমের উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। সরকার খোলাবাজারে ন্যায্য মূল্যের ময়দা-আটা সারাবছরই বিক্রি করায় গরিব নিম্ন্নবিত্ত মানুষ এখন কম দামে আটা কিনতে পারছে। প্যাকেটজাত আটা বাড়তি দামে কিনে খাওয়া অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে।
দেশে প্রতিবছর গমের চাহিদা প্রায় ৭০-৭৫ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে দেশীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ১১-১২ লাখ মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে এখন গড়ে ৫০ থেকে ৬৭ লাখ মেট্রিক টন গম ও গমজাত পণ্য আমদানি করতে হয়। এক দশক আগেও গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৩০ থেকে ৩৩ লাখ টন। গমের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে গম আমদানিতে সরকারকে প্রায় দেড় থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর চাপও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের পাশাপাশি পশু খাদ্য হিসেবেও গমের কদর বেড়েছে।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম.এ হামিদ বলেন, দেশে যেভাবে গমের চাহিদা বাড়ছে, সেভাবে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারিনি। কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এক দশক আগে ৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে গমের চাষাবাদ হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ হেক্টরে। যেখানে মানুষ বাড়ছে। যেখানে ভোক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে গমের উৎপাদন বৃদ্ধি না পেয়ে বরং প্রতিনিয়তই কমে আসছে। যা কোনোভাবেই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অনুকূল নয়। গম চাষের পরিবর্তে কৃষক লাভজনক অন্য ফসলের চাষাবাদের দিকে ঝুঁকেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের দিকে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে গমের ফলনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। সে সময় থেকে গম চাষিরা আতঙ্কে গম চাষ করা কমিয়ে দিয়েছে। গম চাষের নেতিবাচক এ ধারা থেকে বেরিয়ে এসে গমের উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, দেশে ৭০-৭৫ লাখ মেট্রিক টন গমের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১১ লাখ টনের মতো গম উৎপাদন করে ভাতের পরে দ্বিতীয় খাদ্য হিসেবে গমের যোগান কোনভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। বরং আমদানি নির্ভরতা আরও বেড়ে যাবে, যা দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ নয়।
বাস্তবে গমের উৎপাদন কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ওঠানামা করায় সে প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে গম আমদানিতে পড়ছে। গমের চাহিদা একদিকে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ডলার সংকটে গমের আমদানিও কমে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও গম আমদানি কমার অন্যতম কারণ। যে কারণে দেশে গম-আটার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও বিভিন্ন দেশে উষ্ণতার কারণে গম চাষাবাদে গমের ফলন বিপর্যয়ে ঘটছে। শঙ্কা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম আরও চড়া হবে। সেক্ষেত্রে দেশীয়ভাবে গমের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আটার চাহিদা পূরণ করা অনেকাংশেই কঠিন হবে।
‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’-এর মতো ডলার সংকটের কারণে নতুন করে গম আমদানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গম আমদানি বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গম আমদানি ৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৯৫ লাখ টনে।
মোটকথা, আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং দেশীয়ভাবে গমের উৎপাদন বাড়াতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিনামূল্যে উন্নত জাতের বীজ, সার, কীটনাশকের ব্যবস্থা করে গম চাষে চাষিদের আকৃষ্ট করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাতের পরেই খাদ্যশস্য হিসেবে আটার অবস্থান দ্বিতীয়। দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য গমের চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে না পারলে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনোদিন সম্ভব হবে না।
লেখক : উন্নয়নকর্মী