ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের নেপথ্যে

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১২ অক্টোবর ২০২৩

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের নেপথ্যে

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের আরেকটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবী সাধারণ মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ দেখতে চায় না। যুদ্ধবাজরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এরকম খেলার জন্যই বিশ^মোড়লরা দেশে দেশে সংকট জিইয়ে রাখে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বোধশক্তি জেগে উঠুক যে, ‘মোড়লগিরি আর নয়।’ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি দেওয়া। জাতিসংঘকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের আরেকটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এ যুদ্ধের শেষ কবে তা কেউ বলতে পারবে না। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গোটা বিশে^র মানবসভ্যতা যখন প্রায় বিপর্যয়ের মুখে তখন ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বিশ^কে আরও গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট অবশ্য দীর্ঘদিনের। এ সংকটের ইতিহাসের গভীরে তাকালে দেখা যাবে আধিপত্যবাদী স্বার্থান্বেষী শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সমস্যাই ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্বকে প্রলম্বিত করছে। দেশ দুটোর সার্বভৌমত্বের বিরোধকে জিইয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। যে জন্য মাঝে-মধ্যে বিরতি দিয়ে যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে আসছে। বিরোধ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।

সেজন্য একটু পেছনের দিকে তাকাতে চাই। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ফিলিস্তিন, ইসরাইল, গাজা, হামাস, জেরুজালেমÑ এ শব্দগুলোর তেমন পরিচিত নয়। তবে ফিলিস্তিন নেতা ইয়াসির আরাফাত নামটি কম-বেশি সকলেই জানেন। এখন আসি ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে। ভূ-মধ্যসাগরের পূর্বে ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ^যুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেনবিরোধী জোটে। ব্রিটিশরা যুদ্ধে জয়ের আশায় ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা চায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ের পর এই ভূমিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে ঘোষণা দেন। যা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত।

যেহেতু ফিলিস্তিন অঞ্চলে আরবীয়রা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই ধরে নেয় স্থানীয় আরবীয়রা। এদিকে প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আনন্দিত হয়ে বাইজম্যানকে পুরস্কার দিতে চান। কিন্তু বাইজম্যান নগদ কোনো পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্ব-জাতির জন্য এক টুকরো স্বাধীন ভূমি দাবি করেন ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিন ভূখ-টি ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন ইহুদিদের স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীনে রাখে। মূলত এই সময়টিতেই ফিলিস্তিনকে আরবীয়শূন্য করার কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। 
অন্যদিকে, ১৯২০ সালে জাতিপুঞ্জ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার একদিকে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিন উন্মুক্ত করে দেয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদি মিলিশিয়ারা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তুলতে থাকে সংগঠন। এর মধ্যে প্রধান তিনটি সংগঠন ছিল ‘হাগনাহু, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে। এদের গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার হচ্ছিল তখন পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বেছে নেয় আত্মহননের পথ।

১৯৪০ সালে এসএস প্যান্ট্রিয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে দোষ চাপিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের ওপর। এভাবে নিজেরাই নিজেদের লোক হত্যা করতে থাকে। ইংরেজদের সহযোগিতায় ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আবরদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে দ্রুত। ১৯৪৭ সালে ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ করা হয়। এতে ৩৩টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দেয়। ১৩টি বিপক্ষে, ১০টি ভোটদানে বিরত থাকে। ফিলিস্তিনে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ ইহুদিরা পেল ৫৭%, আর ফিলিস্তিনিরা পেল ৪৩%। ইহুদি রাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত। পরবর্তীতে এই সীমানাকে কেন্দ্র করেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধ শুরু হয়।

১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টায় স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশ। ইসরাইলের আধিপত্যবাদ নীতির কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণহীন হয়ে পড়ে। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজিয়ার্ন শহরে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (পিএনসি) একপক্ষীয়ভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ ফিলিস্তিন ছিল নির্বাসনে ঘোষিত একটি রাষ্ট্র। স্বাধীনতা ঘোষণাকালে কোনো অঞ্চলই পিএলওর নিয়ন্ত্রণে ছিল না, যে অঞ্চলগুলো পিএলওর দাবি ছিল। ব্রিটেন যখন ইহুদিদের জন্য স্বাধীন ভূখ-ের ব্যবস্থা করে সেটি ছিল মূলত দ্বি-রাষ্ট্রতত্ত্ব।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিরসনের অন্যতম শর্তই ছিল দুপক্ষের জন্য স্বতন্ত্র দুটি দেশ। পুরনো দ্বি-রাষ্ট্রতত্ত্বটি ১৯৯৩ সালে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। দুপক্ষই এই তত্ত্বকে মেনে নিয়ে চলতে থাকে। শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র সবসময় দ্বি-রাষ্ট্রতত্ত্বের কথা বললেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে এনে জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠা করেন। এ ঘটনায় ফিলিস্তিনিরা প্রচ-ভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। যেদিন মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে এনে জেরুজালেমে উদ্বোধন করা হয় সেদিন ফিলিস্তিন অংশে গাজা পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত প্রান্তরে। ইসরাইলি সেনাদের হামলায় সেদিন নিহত হয়েছিল ৫৮ জন এবং আহত হয়েছিল প্রায় তিন হাজার।

ইসরাইলের দাবি জেরুজালেমে তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। এটা ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মনে করে তারা। অন্যদিকে, পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিরা রাজধানী হিসেবে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ায় ফিলিস্তিনিদের দাবি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। 
আন্তর্জাতিকভাবে দুটো রাষ্ট্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হলেও যুদ্ধ কিন্তু থামছে না। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক খেলায় মানবসভ্যতা পড়েছে সংকটের মুখে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা সম্প্রতি আকস্মিক হামলা করে ইসরাইলবাসীর ওপর। প্রতিশোধ হিসেবে পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইল, যা চলমান। হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজাকে নির্জন দ্বীপে পরিণত করার হুমকি দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ও আহত হয়েছে অনেক। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ফিলিস্তিনি। হতাহতের মধ্যে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন নাগরিকও রয়েছে। পারস্পরিক সংঘর্ষে গাজা এখন রক্তের বন্যায় ভাসছে। সমৃদ্ধ নগরী গাজাকে আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করেছে ইসরাইল।

ফিলিস্তিনের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অনেকটা গাজাকেন্দ্রিক। ফিলিস্তিনের পুরনো ইসলামী সংগঠন হামাসের শীর্ষ কমান্ডার তাদের হামলাকে অপারেশন ‘আল আকসা স্টর্ম’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইসরাইল বাহিনীকে তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এদিকে ইরান ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার কথা বলেছে এবং ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলের ওপর হামলাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ইসরাইলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে সামরিক রসদ পাঠানো শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। এ যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। 
ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিকে বিশ্লেষকগণ তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের বার্তা হিসেবে মনে করছেন। দীর্ঘদিনের যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্বকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেবে। তখন বিশ্বযুদ্ধ হয়ে উঠবে অনিবার্য। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ সংঘটিত হলে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে পৃথিবী। আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার পৃথিবীতে উন্নতমানের মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছে ধনবান রাষ্ট্রগুলো। মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এখন চলছে উন্নতমানের মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। মুখে বলছে শান্তির কথা; কিন্তু শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা, বিশ্বে এমন একজন নেতার আবির্ভাব ঘটুক যিনি বিশ্বের মানুষকে অস্ত্রমুক্ত করে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ রাখতে পারেন।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবী সাধারণ মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ দেখতে চায় না। যুদ্ধবাজরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এরকম খেলার জন্যই বিশ^মোড়লরা দেশে দেশে সংকট জিইয়ে রাখে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বোধশক্তি জেগে উঠুক যে, ‘মোড়লগিরি আর নয়।’ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি দেওয়া। জাতিসংঘকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। 

লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

[email protected]

×