ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা ও অ্যাপসে দরকারি তথ্য

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা ও অ্যাপসে দরকারি তথ্য

গত শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে

ঢাকায় গত ১৪ আগস্ট রাতে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের ভূগর্ভের ডাউকি চ্যুতি নামে পরিচিত ফাটল বরাবর। ডাউকি ফল্টে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরো সিলেট বিভাগে বিপর্যয় নেমে আসবে, যার প্রভাব পড়বে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে। রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় সাড়ে ৮ লাখের বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪০% স্থাপনা ধ্বংস হতে পারে

গত শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে এই লেখা পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার জন মারা গেছে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে মরক্কোর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। ২০০৪ সালে দেশটির উত্তর-পূর্বের আল হোসেইমা অঞ্চলে ভূমিকম্পে ৬২৮ জন মারা গিয়েছিল। আর ১৯৬০ সালে আগাদির অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত ১২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ভূমিকম্পটি মরক্কোর আধুনিক ইতিহাসে নথিভুক্ত সবচেয়ে বৃহত্তম যা ১৭৫৫ সালের মেকনেস ভূমিকম্পের উচ্চ অনুমানকেও অতিক্রম করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই অঞ্চলে এর আগেও বেশ কয়েকবার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। তাদের মতে, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের নিচে থাকা দুই টেকটোনিকে প্লেটের সংঘর্ষ থেকেই এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এর আগেও এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী ভূমিকম্পে (৭.৮ মাত্রার) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪০০০ জনেরও বেশি। ভূতত্ত্ব জরিপ (ইউএসজিএস) অনুসারে তুরস্কের ওই এলাকার মাটির নিচে থাকা অ্যারাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে গিয়ে আনাতোলিয়ান প্লেটে ধাক্কা দিলে এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের তৈরি হয়। একই কারণে ১৮২২ সালে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। বিশ্বের যেসব এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তুরস্কের এই এলাকাটি তার অন্যতম।
বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে জাতিসংঘ গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছিল। সেই প্রকল্পের আওতায় অতীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তথ্য এবং গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের যেসব এলাকা বিজ্ঞানীদের বিশেষ নজরে রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। আসলে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাবপ্লেট রয়েছে।

এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূপৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বাংলাদেশ উত্তর তিব্বত সাবপ্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাবপ্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই সব প্লেটগুলো সিলেট-সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ-চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।

এসব কারণে বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে বেশিরভাগ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট ও এর আশপাশ এলাকায়। ঢাকায় গত ১৪ আগস্ট রাতে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের ভূগর্ভের ডাউকি চ্যুতি নামে পরিচিত ফাটল বরাবর। ডাউকি ফল্টে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরো সিলেট বিভাগে বিপর্যয় নেমে আসবে, যার প্রভাব পড়বে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে। রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় সাড়ে ৮ লাখের বেশি অর্থাৎ প্রায় ৪০% স্থাপনা ধ্বংস হতে পারে।

সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলার বা আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আবার সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ধসে পড়তে পারে প্রায় ৪১ হাজার স্থাপনা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। 
শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে রক্ষার জন্য প্রাথমিক কিছু উপায় আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রেট্রোফিটিং পদ্ধতি যা খুব ব্যয়বহুল। রেট্রোফিটিং বর্তমানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে খুবই জনপ্রিয়। পূর্বে নির্মিত বিল্ডিং বা স্ট্রাকচারে নতুন কিছু সংযোগ করে, বিল্ডিংয়ের স্ট্রেনথ বাড়ানোর বা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়াকে রেট্রোফিটিং বলে। যেসব কারণে রেট্রোফিটিং করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১. বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে না মেনে বিল্ডিং নির্মাণ করা হলে। ২. ডিজাইনে ত্রুটির কারণে। ৩. দীর্ঘদিন ব্যবহারে ও অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিল্ডিংয়ের স্ট্রেনথ বাড়াতে। ৪. ব্যবহৃত বিল্ডিংয়ের মূল ডিজাইনের বাইরে গিয়ে অনেক ধরনের পরিবর্তন করা হলে।

৫. বিল্ডিংয়ের ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন করা হলে। জনপ্রিয় রেট্রোফিটিং পদ্ধতিগুলো হলো ১. কলাম জ্যাকেটিং পদ্ধতি যা কলাম বা পিলারকে জ্যাকেট পরিয়ে দেওয়ার মতো উপায়। ২. শিয়ার ওয়াল পদ্ধতি যা পিলারের পাশে আরও রড দিয়ে ঢালাই করে একটি দেয়ালের মতো তোলা হয়। ৩. স্টিল ব্রেসিং পদ্ধতি যা দুই পিলারের মাঝখানে একটি ধাতব ফ্রেম বসানো হয় ভুমিকম্পের ঝাঁকুনি থেকে পিলারকে রক্ষা করার জন্য। ৪. ওয়াল থিকেনিং পদ্ধতি যা দুই কলামের মাঝের দেওয়ালটাকেই মোটা করে ওজন বাড়িয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়াও আছে ১. রিনফোর্স স্ট্রেনথনিং ২.এক্সটারনালি বন্ডেড প্লেট পদ্ধতি।
উন্নত বিশ্বে যেসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো ১. টিএমডি (টিউন মাস ড্যাম্পার) প্রযুক্তি যাতে থাকে তেল বা পানির মতো তরল পদার্থ। সিস্টেমটি নিজে দুলে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি শোষণ করতে পারে। কোনো ক্ষেত্রে এর ভেতরের তরল পদার্থ দুলবে, আবার কোনো ক্ষেত্রে সিস্টেমটাই ডানে-বামে স্লাইড করবে। ২. বেজ আইসোলেটর প্রযুক্তি যা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে নিচের অংশটি নড়বে, কিন্তু উপরের অংশ দুলবে না। ৩. বিআরবি (বাকলিং রিস্ট্রেইন্ড ব্রেইস) প্রযুক্তি হলো স্টিল ও স্প্রিংয়ের মতো একটি কাঠামো।

ভূমিকম্পে এর ভেতরের স্প্রিংয়ের সংকোচন-প্রসারণ হয় এবং সেটি পিলারের ওপর চাপ না ফেলে নিজে কাঁপুনি/ঝাঁকুনি শোষণ করে। বাংলাদেশে রেট্রোফিটিংয়ের ধারণা বহুল প্রচলিত না হলেও একেবারে নতুন নয়। কতিপয় স্থপতি ও প্রকৌশলী ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজটি করছেন। কোনো কোনো ডেভেলপার ও বিল্ডিং সার্ভিস কোম্পানিগুলো পুরো স্ট্রাকচার ডিজাইন করা থেকে যাবতীয় সংস্কার ও পরিচর্যামূলক কাজ এ পদ্ধতিতে করছে। ঐতিহ্যবাহী পুরানো কিছু স্থাপনা যেমন কার্জন হলের মসজিদ, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, পাহাড়পুর, কান্তজির মন্দির ইত্যাদিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে এসব স্থাপনা আরও শত শত বছর স্থায়ী হবে। 
তবে রাজধানীতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বিল্ডিং কোড না মানার কারণে এ ধরনের প্রযুক্তি প্রয়োগ করা এখন খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে শুধু সতর্ক হওয়ার জন্য অনেক মোবাইল অ্যাপস আছে, যেখান থেকে বিশ্বের যে কোনো স্থানের ভূমিকম্প সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো হলোÑ ১. কুয়েকফিড- যা কাস্টমাইজযোগ্য একটি ইন্টারফেস, ব্যবহারকারীরা এতে বিভিন্ন এলাকার ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে ট্রাক ও ফিল্টার করতে পারেন। অ্যাপটি ব্যবহারকারীরা প্রতিটি ভূমিকম্পের অবস্থান, মাত্রা এবং গভীরতাসহ বিস্তারিত তথ্য পান। এ ছাড়া রিয়েল-টাইম  নোটিফিকেশনসহ ব্যবহারকারীরা তাদের এলাকায় যেকোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প সংক্রান্ত তথ্যও পেতে পারেন।

২. আর্থকোয়েক অ্যালার্ট- এটি ভূমিকম্পের রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদানের জন্য ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) থেকে তথ্য ব্যবহার করে থাকে। অ্যাপটিতে ব্যবহারকারীদের জন্য ভূমিকম্পের অবস্থান, মাত্রা এবং সময় অনুসারে ফলাফল ফিল্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের তথ্য প্রদর্শন করে। ৩. আর্থকোয়েক নেটওয়ার্ক- যেখানে ব্যবহারকারীরা ভূমিকম্প সম্পর্কে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এবং বিশ্বব্যাপী একটি কমিউনিটি বেজড  ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ভূমিকম্পের তীব্রতা এবং তাদের অবস্থানের নিকটবর্তী তার ওপর ভিত্তি করে নোটিফিকেশন কাস্টমাইজ করার সুযোগ রেখেছে। ৪. মাইশেক- বার্কলে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার তৈরি।

ভূমিকম্প শনাক্ত করতে এবং ব্যবহারকারীদের রিয়েল-টাইম সতর্ক করতে স্মার্টফোন সেন্সর সেট করা আছে অ্যাপটিতে। এ ছাড়া ভূমিকম্প সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে তথ্য সরবরাহ করে নাগরিকদের সিটিজেন-সায়েন্স প্রজেক্টে অবদান রাখারও সুযোগ আছে। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে কিংবা অ্যাড-ফ্রি প্রো-ভার্সনটি খুব সহজেই আইওএস এবং অ্যান্ড্রয়েড উভয় ধরনের মোবাইলে সেট করা যায়।


লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×