সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত ডলার সংকট পরিস্থিতি
বর্তমানে চলমান ডলার সংকট এবং বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে অর্থনৈতিক ব্লকগুলো স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে, যা আগামীতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। ডলারের প্রভাব কমানোর জন্য নতুন মুদ্রা আনারও বিবেচনা করছে। সেক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য একক মুদ্রা চালু একদিকে যেমন এ অঞ্চলের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, ঠিক তেমনি উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং অপেক্ষাকৃত সহজ যাতায়াত এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এবং ভ্রাতৃত্ববোধ আরও জোরদার করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে
সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত ডলার সংকট পরিস্থিতি প্রতিটি দেশকে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভাবাচ্ছে। তবে এটির প্রয়োজনীয়তা যে এখনই অনুভূত হয়েছে এমন নয়। ১৯৯৯ সালে ইউরোর আবির্ভাব ঘটার পরপরই লাটিন আমেরিকা, আসিয়ান, সার্কসহ বিভিন্ন ইকোনমিক ব্লক নিজস্ব মুদ্রায় যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যকার আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের প্রসারের জন্য একটি সর্বজন গৃহীত মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী। ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সার্ক সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন, যদিও পরবর্তীতে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা বা ডি-ডলারাইজেশন বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ডলারের বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার ক্রমাগত দরপতনের কারণ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডলার এবং আর্থিক নীতি নিয়ন্ত্রণের ছায়াতল থেকে সরে আসতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই পথে হাঁটার পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা নিজস্ব অর্থ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছে। আইএমএফের তথ্য মতে ২০২২ সালে বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশ ছিল মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশ্ব বাণিজ্যের লেনদেন কার্যক্রমের প্রায় ৪০ শতাংশ ডলারে সম্পাদিত হয়।
করোনা মহামারি পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের রিজার্ভ সংকট তীব্র হয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশ বিনিময়ের অন্যান্য একক যেমন- পাউন্ড, রুপি, ইয়েন বা রুবল- এগুলোর মাধ্যমে লেনদেন করতে পারে। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিকল্প মাধ্যমের চিন্তার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো অতটা শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে তারা আন্তর্জাতিক লেনদেনে টাকাকে বিনিময়ের একক হিসেবে তুলে ধরতে পারবে। আবার পাউন্ড, রুপি, ইয়েন বা রুবলের অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে ডলারের মতো হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই জোটবদ্ধ হয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ব্লকের নিজস্ব মুদ্রার সূচনা করা যেতে পারে।
একক মুদ্রা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশগুলোকে প্রথমত একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অধীনে আসতে হবে। এর পাশাপাশি ‘দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ বা ‘সার্ক ব্যাংক’ নামে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূচনা করা যেতে পারে। ব্যাংকটি এই একক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ এবং মান ধরে রাখতে কাজ করবে। ‘ইউরো’র মতো একক মুদ্রার নাম হতে পারে যেমনÑ ‘ইন্দো’। এখানে মুদ্রার ব্যবহারের বাস্তবায়ন পদ্ধতি দু’ধরনের হতে পারে। এক, একক মুদ্রাটি চালুর পর এই অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অধীনস্থ সকল দেশকে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার পরিহার করে এটিকেই সর্বত্র মূল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা। এটি বাস্তবায়নে কিছুটা জটিলতা থাকতে পারে।
কেননা, প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ভিন্ন। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে আমলে নিয়ে অভিন্ন আর্থিক নীতি প্রণয়ন করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। দুই, প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করবে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য। শুধু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘ইন্দো’ ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রার মান কমে যাওয়ার মতো আর্থিক সমস্যাগুলোর হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
একক মুদ্রার সুবিধা : একই মনিটারি ইউনিয়নের অধীনে আসলে সার্কে গৃহীত সাফটা এবং সাপটা চুক্তিগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। আন্তঃউপমহাদেশীয় বাণিজ্য আরও বিস্তার লাভ করবে। তাছাড়াও লেনদেন খরচ (ট্রানজেকশন কস্ট) এবং রূপান্তর হারও (কনভার্সন রেট) অনেকাংশে কমে আসবে। বাংলাদেশের বরাত দিয়েই উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো আমদানিকারক পার্শ্ববর্তী যে কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গেলে আমদানি ব্যয় মেটানোর প্রথমে টাকাকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়। অপর পাশে যিনি রপ্তানি করছেন তাকে এই ডলার তার দেশের মুদ্রায় রূপান্তর করতে হয়।
উভয়পক্ষ থেকেই বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ রূপান্তর হার (কনভার্সন রেট) হিসেবে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একক মুদ্রা চালু হলে রূপান্তরিত খরচ উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসবে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করেছে এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ তা রুপি-টাকাতে পরিবর্তিত হবে। সেক্ষেত্রে এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা দেখা আসলে সময়ের বিষয়। কেননা, ভারতের সঙ্গে রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশের আমদানি ঢের বেশি।
ধান, চা, পাটসহ অন্যান্য কৃষিজ পণ্যের মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের একটি বড় অংশ হয় এ অঞ্চলে। সেক্ষেত্রে তেল বাণিজ্যে মধ্যপ্রাচ্য যেমন কার্টেল করে দামের ওপর প্রভাব রাখছে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোরও উপরোল্লিখিত কৃষিজ পণ্যগুলোতে তুলনামূলক ভালো দামে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীভূত সামষ্টিক উপমহাদেশীয় অর্থনীতি আগের চাইতে অধিক পরিমাণে অগ্রগতি লাভ করবে, যা কর্মসৃজনে অবদান রাখবে। এর পাশাপাশি বর্ধিত বাজার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে। একই অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অধীনে এলে জাতিগত বৈরিতা কমে ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় হবে, যা ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব হ্রাস করবে বহুলাংশে।
একক মুদ্রায় অন্তরায় : প্রথমত, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের চলমান সংঘাত। শ্রীলঙ্কাও তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে অনাকাক্সিক্ষত সময় পার করছে। এমতাবস্থায় এসব দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বর্তমানে একই মনিটারি ইউনিয়নে আসার জন্য কতটা প্রস্তুত তা অন্য দেশগুলোর চিন্তার বিষয়। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পরিচালনার ধরন এবং আর্থিক নীতি (মনিটারি পলিসি) অভিন্ন নয়। সেক্ষেত্রে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। তৃতীয়ত, ভারতীয় উপমহাদেশে নকল মুদ্রার বিচরণ প্রায়ই দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এটিকে সামাল দিতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তাই নতুন একক মুদ্রা চালু হলে এটিরও নকল হওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন।
একক মুদ্রা হিসেবে রুপিকে গ্রহণ কতটা যৌক্তিক : ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের পর বৈশ্বিক বাণিজ্যে রুপির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সৌদি আরব, ইউএই, রাশিয়ার মতো দেশগুলো রুপিতে লেনদেনে আগ্রহী হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন বিশ্ববাণিজ্যের গড় লেনদেনে প্রায় ১.০৬ শতাংশ ভারতীয় রুপির দ্বারা পরিচালিত হয়, যা ২০০৭ সালে ছিল প্রায় ০.০৭ শতাংশ। একমাত্র সুবিধা হলো এর গ্রহণযোগ্যতা বহির্বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নতুন মুদ্রা চালু করলে তার বিস্তৃতি ঘটাতে একটি সময়ের প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশ এটিকে কিভাবে স্বাগত জানাবে তাও ভাবনার বিষয়। এক্ষেত্রে রুপিকে একক মুদ্রা হিসেবে মেনে নিলে এগুলোর সম্মুখীন হওয়ার তেমন প্রয়োজন পড়বে না। বরং ভারতের সুবিশাল এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি অন্য দেশগুলোকে রুপি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।
ভারতীয় মুদ্রাকে একক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো দেশ হিসেবে তুলনামূলক কম শক্তিধর দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্বের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। এমনিতেই আয়তন, জনসংখ্যা এবং উৎপাদনের পরিমাণের আধিক্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যোজন যোজন দূরত্বে এগিয়ে রেখেছে ভারতকে। যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে না চাইলেও অর্থনৈতিকভাবে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান প্রভাব সবসময় বিরাজ করে। কিন্তু রুপিকে এ অঞ্চলের একক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করলে অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে ভারতের প্রভাব লক্ষণীয় হতে পারে, যা কোনো দেশের মর্যাদার জন্য সুখকর নয়। আরেকটি বড় বিষয় হলো, আন্তঃউপমহাদেশীয় জাতিগত দ্বন্দ্ব।
এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিরাজমান অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব। যার ফলে পাকিস্তান হয়তো কখনোই চাইবে না ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য করতে। এর পাশাপাশি কোনো একটি দেশের মুদ্রার ওপর নিভরশীলতা দীর্ঘ সময়ে গিয়ে ভালো ফল দেয় না। সে দেশ নিজস্ব অর্থনীতিকে সবল এবং চাঙ্গা রাখতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা এর মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এখন পুরো বিশ্ব যাচ্ছে।
বর্তমানে চলমান ডলার সংকট এবং বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে অর্থনৈতিক ব্লকগুলো স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে, যা আগামীতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। ডলারের প্রভাব কমানোর জন্য নতুন মুদ্রা আনারও বিবেচনা করছে। সেক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য একক মুদ্রা চালু একদিকে যেমন এ অঞ্চলের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, ঠিক তেমনি উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং অপেক্ষাকৃত সহজ যাতায়াত এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এবং ভ্রাতৃত্ববোধ আরও জোরদার করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যোগ করতে পারে এক নতুন মাত্রা।
লেখক : গবেষক (অর্থনীতি বিভাগ)
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট
[email protected]
এবং সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট
অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট