ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১

ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা তামাকমুক্ত দেশ গঠনে অন্তরায়

সেজাল সারাফ

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১ আগস্ট ২০২৩

ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা তামাকমুক্ত দেশ গঠনে অন্তরায়

বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে ধূমপানমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে

বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে ধূমপানমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। এই লক্ষ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ নিয়ন্ত্রণ করা, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক), ফুসফুসের অসুখ এবং ডায়াবেটিসের মতো বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী। তামাক ব্যবহারজনিত কারণে প্রতি বছর ৮০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। তবে সমস্যাটির ব্যাপ্তি আরও গভীরে। এসব মৃত্যুর ১০ শতাংশের বেশি ঘটে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে। এ ক্ষেত্রে তামাকজাত পণ্যের জলন্ত অংশ থেকে বের হওয়া ধোঁয়া এবং একজন ধূমপায়ী ব্যক্তির প্রশ্বাসের সঙ্গে বেরোনো ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসে অধূমপায়ীরাও ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের প্রায় ১৮ শতাংশ তামাকের ধোঁয়া গ্রহণ করে, আর প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি ১০ জনে ৪ জন তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তাই এটা স্পষ্ট যে, ধূমপান আমরা করি আর না-ই বা করি, ধূমপান আমাদের সবার ওপরই প্রভাব ফেলে।

ধূমপানমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য 
ধূমপানমুক্ত নীতিমালা জনগণকে পরোক্ষ ধূমপাান থেকে রক্ষা করে এবং সামগ্রিকভাবে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে ধূমপানমুক্ত আইনের পার্থক্য রয়েছে।  যেমন- বিশ্বের ৫৫টি দেশ ধূমপানমুক্ত আইন বাস্তবায়ন করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মতো কিছু কিছু দেশ নির্দিষ্ট কিছু পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা স্থাপনের সুযোগ রেখেছে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, যা ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন হসপিটালিটি ভেন্যুতে এবং গণপরিবহনে কিছু বিধিনিষেধের আওতায় ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আইনের অধীনে এসব স্থানে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা চিহ্নিত করার পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপক (ফায়ার এক্সটিংগুইশার), তামাকদ্রব্য ফেলার স্থান নির্ধারণ ও নো-টোব্যাকো সাইনেজ  স্থাপন করতে হবে। এই আইনে ধূমপানমুক্ত এলাকায় ধূমপান করা ও ছাইদানি (অ্যাশট্রে) রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা স্থাপনের মাধ্যমে ধূমপায়ীদের জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও ধোঁয়া ধূমপানমুক্ত এলাকার অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে ওই এলাকার লোকদের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী রাসায়নিক উপাদানের (কার্সিনোজেন) সংস্পর্শে নিয়ে আসে।

আইন মেনে চলার প্রবণতা কম
প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং জনস্ হপকিনস্ ব্লুমবার্গ স্কুল অব্ পাবলিক হেলথ্ সম্প্রতি একটি গবেষণা সম্পন্ন করেছে, যার ফলে দেখা যায়, বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং ট্রেনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান কী ভাবে অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপানের ঝুঁকিতে ফেলেছে। ৫২৬টি স্থান পরিদর্শনের পর গবেষণায় ৪১টি ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা পরীক্ষা করা হয়। এগুলোর কোনোটিই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী নির্ধারিত বিধিমালার শর্তাবলি পুরোপুরি অনুসরণ করেনি। ফলে, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকাগুলো অধূমপায়ীদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।
গবেষণায় পর্যবেক্ষণকৃত ১১৮টি হোটেলের মধ্যে ১৮টিতে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা রয়েছে। যার মধ্যে ৭টিতে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ও অধূমপায়ীদের স্থান একই অবকাঠামোতে অবস্থিত। ফলে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ প্রকৃতপক্ষে একটি অকার্যকর ব্যবস্থা। তাছাড়া সাতটি হোটেলে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানে যেতে হলে পথপ্রদর্শকের সহায়তা নিতে হয় এবং ১৭টিতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নির্দেশক প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেই, যা আইন বাস্তবায়নের পরিপন্থি। একইভাবে ৫৩টি ট্রেনের মধ্যে ২১টিতে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা পাওয়া যায়, যেখানে সাতটি ট্রেনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় খাবার ও পানীয় বিক্রয় করতে দেখা যায়, যা অধূমপায়ীদের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, সেখানে খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়ে তারা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে।  

জনগণকে আরও সুরক্ষা দিতে করণীয়
বাংলাদেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা নিয়ে বিদ্যমান নিয়মকানুন কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ধূমপানের জন্য নির্ধারিত আইনের বিধিনিষেধ পালনের প্রবণতা অত্যন্ত কম দেখা যায়। গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা বাংলাদেশের জনগণকে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে না। নীতিনির্ধারকগণ, ভেন্যুর মালিকগণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা অপসারণ করে শতভাগ ধূমপানমুক্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। যেন বাংলাদেশের মানুষ এবং পরিবারগুলোর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা স্থাপন সমাধান নয়। এসব স্থান বা এলাকা নির্মূল করার মাধ্যমে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে পারে।  

লেখক : বিডিএস, এমপিএইচ
সিনিয়র রিসার্চ প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল টোব্যাকো কন্ট্রোল, জনস্ হপকিনস্ ব্লুমবার্গ স্কুল অব্ পাবলিক হেলথ্

×