ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

‘কাজী ফার্মস কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিংয়ের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের ব্যবসা সচল রাখে’

কাজী জাহিন হাসান

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ৫ জুলাই ২০২৩; আপডেট: ২১:০৫, ৫ জুলাই ২০২৩

‘কাজী ফার্মস কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিংয়ের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের ব্যবসা সচল রাখে’

কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং

সারা বিশ্বের অনেক পোল্ট্রি কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ খামারিদের মাধ্যমে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন করে থাকে; একে "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং" বলা হয়।

সম্প্রতি ঢাকা ট্রিবিউনে জনাব এম.এস. সিদ্দিকী ভুল তথ্য সংবলিত প্রবন্ধে ("প্রান্তিক মুরগির খামারিদের রক্ষা করুন", এম.এস. সিদ্দিকী) মতামত দিয়েছেন যে, চুক্তিবদ্ধ ব্রয়লার পালন ছোট খামারিদের ক্ষতি করে৷ আমাদের কোম্পানি, কাজী ফার্মস লিঃ, বাংলাদেশের অন্যতম "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং" প্রতিষ্ঠান। এটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, মিঃ সিদ্দিকীর অভিযোগ ভুল তথ্যযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং " পদ্ধতি খামারিদের জন্য প্রচুর সুবিধা তৈরি করে ।

গতানুগতিকভাবে,পোল্ট্রি কোম্পানীগুলো একদিনের বাচ্চা এবং ফিড উৎপাদন করে যা ডিলারদের(মধ্যস্বত্বভোগী) মাধ্যমে খামারিদের কাছে বিক্রি হয়। ডিলাররা প্রতি বস্তা ফিডের উপর কমিশন এবং প্রতিটি একদিনের বাচ্চার উপর লাভ করে। চুক্তিবদ্ধ খামার ব্যবস্থার অধীনে, পোল্ট্রি কোম্পানিগুলি ছোট খামারিদের সরাসরি একদিনের বাচ্চা এবং খাদ্য সরবরাহ করে। এতে কোন মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় উৎপাদন খরচ কমে, যা স্পষ্টতই খামারি এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যই  অর্থসাশ্রয়ী ।

বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন নিয়মে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পরিচালনা করে। কাজী ফার্মসের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিতে খামারিদের কাছে একদিন বয়সী বাচ্চা, খাদ্য এবং ঔষধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়, তবে সব উপকরণ কাজী ফার্মসের সম্পত্তি রয়ে যায় । একদিনের বাচ্চা এবং ফিড কখনই চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছে বিক্রি করা হয় না, তাদের খামারে বড় হওয়া ব্রয়লার কাজী ফার্মসের সম্পত্তি বলে গণ্য হয়। আমরা এই উৎপাদিত ব্রয়লার বিক্রি করি এবং খামারিদেরকে উৎপাদন বাবদ কেজি প্রতি গ্রোয়িং চার্জ দেই। যে সকল খামারিদের উৎপাদন দক্ষতা বেশি তারা গ্রোয়িং ফি বেশি পান আর যে সকল খামারিদের উৎপাদন দক্ষতা কম তারা গ্রোয়িং ফি কম পান। প্রতি কেজি মুরগির জন্য গড় গ্রোয়িং ফি প্রায় ১৫ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৬ টাকা। সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল খামারিরা প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত পান।

আমাদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি খামারিদের তিনটি কারণে বিশেষ সুরক্ষা দেয়।

প্রথমত, রোগের প্রাদুর্ভাব হলে এবং মুরগি মারা গেলে খামারি তার পুঁজি হারাবেন না। ব্রয়লার মুরগি কাজী ফার্মের মালিকানাধীন; ব্রয়লার মুরগি মারা গেলে কাজী ফার্মের ক্ষতি হয়। কাজী ফার্মসের আর্থিক ক্ষতি সত্ত্বেও খামারিদেরকে কেজি প্রতি (জীবিত ব্রয়লার মুরগির ওজন অনুযায়ী) গ্রোয়িং ফি প্রদান করা হয়। রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও চুক্তিবদ্ধ খামারির লোকসান হয় না। মুরগি মারা গেলে চুক্তি বহির্ভূত খামারিরা পুঁজি হারিয়ে ফেলে কিন্তু কন্ট্রাক্ট ফার্মের খামারিরা লোকসান থেকে রক্ষা পায়। 

দ্বিতীয়ত, ফিডের দাম বেশি হলেও চুক্তিবদ্ধ খামারিরা লোকসান করেন না। কাজী ফার্মস চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছে কোনো ফিড বিক্রি করে না। যখন ভুট্টা বা সয়াবিনের বাজার মূল্য বেশি থাকে, তখন ফিডের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, চুক্তিবদ্ধ খামারে মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং এই মুরগি বিক্রি করে লোকসানও হতে পারে। তবে এটি চুক্তিবদ্ধ খামারিদেরকে প্রভাবিত করবে না এবং কোম্পানির লোকসান হলেও খামারিদেরকে গ্রোয়িং ফি প্রদান করা হবে। খাদ্যের দাম বেশি হলে চুক্তি বহির্ভূত খামারিরা পুঁজি হারায়, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ খামারিরা লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পান ।

তৃতীয়ত, ব্রয়লার মুরগির বিক্রয়মূল্য কম হলেও চুক্তিবদ্ধ খামারি লোকসান করেন না। যখন মুরগির দাম কম থাকে, কাজী ফার্মস চুক্তিবদ্ধ খামারে উৎপাদিত ব্রয়লার বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু  চুক্তিবদ্ধ খামারিদের ক্ষতি হয় না। এমনকি কাজী ফার্মস লোকসানে ব্রয়লার বিক্রি করলেও, চুক্তিবদ্ধ খামারিদেরকে গ্রোয়িং ফি প্রদান করা হয়। মুরগির বিক্রির দাম কম হলে চুক্তি বহির্ভূত খামারিরা পুঁজি হারায়, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ খামারিদের তা হয় না।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে কাজী ফার্মসের "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং" পদ্ধতি খামারিদের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এই কারণেই আরও অসংখ্য খামারি চুক্তিবদ্ধ খামারি হতে চায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত পর্যন্ত পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশে বর্তমানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং -এর মাধ্যমে বেশিরভাগ ব্রয়লার উৎপাদন হয়।

জনাব সিদ্দিকী লিখেছেন: "প্রান্তিক খামারিরা বড় কোম্পানির কাছ থেকে সমস্ত উপকরণ গ্রহণ করতে বাধ্য, যেহেতু বড় কোম্পানিগুলো এই উপকরণ উৎপাদনে একচেটিয়া ব্যবসা করে।" এটা সত্য নয়। কয়েক ডজন পোল্ট্রি কোম্পানী একদিনের বাচ্চা বা ফিড বা উভয়ই উৎপাদন করে এবং খামারিদের কাছে এগুলো বিক্রি করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। বাচ্চা, খাদ্য ও মুরগির বাজারে কোনো একক কোম্পানির বা কোম্পানিগুলোর প্রান্তিক খামারিদের উপরে একচেটিয়া আধিপত্য নেই ।

জনাব সিদ্দিকী আরও লিখেছেন: '৫ জানুয়ারী ৯ টাকায় বিক্রি হওয়া একটি মুরগির বাচ্চা ৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ টাকায় বিক্রি হয়’। বিভিন্ন মৌসুমে যখন খামারিরা তাদের খামারের জন্য ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উঠাতে চায় তখন বড় কোম্পানিগুলি তাদের উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়।" জনাব সিদ্দিকী স্পষ্টতই জানেন না যে বাচ্চার বাজার খুব প্রতিযোগিতামূলক। যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে, সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের কারণে দাম ওঠানামা করে। বিপরীতে, যদি একটি পণ্যের বাজার প্রতিযোগিতামূলক না হয়, তাহলে উৎপাদকরা সবসময় লাভজনক মূল্যে সেই পণ্য বিক্রি করতে পারে। বাংলাদেশের সব হ্যাচারি ২০২২ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে লোকসানে বাচ্চা বিক্রি করেছিল, যখন বাচ্চা সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বেশি ছিল। ইচ্ছানুযায়ী কেউ বাচ্চার দাম বাড়াতে পারেনা ।

হ্যাচারিগুলো একদিন বয়সী বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কারণ এটা নির্ভর করে হাজার হাজার ব্রয়লার খামারির ক্রয়ের সিদ্ধান্তের ওপর। ব্রয়লার মুরগির দাম কম হলে খামারিরা বাচ্চা কিনতে চায় না তখন বাচ্চার দাম পড়ে যায়। বাজার প্রতিযোগিতামূলক না হলে হ্যাচারিগুলো কখনই ৫ টাকায় (যা তাদের উৎপাদন খরচের অনেক কম) বাচ্চা বিক্রি করতে বাধ্য হতো না।

জনাব সিদ্দিকী আরও লিখেছেন: "কাজী ফার্মস লিমিটেড, প্যারাগন এবং সিপি সহ কোম্পানিগুলি চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছে ২,৭০০ টাকায় এবং চুক্তি বহির্ভূত খামারিদের কাছে ৩,৫০০ টাকায় ৫০ কেজি ওজনের ফিডের বস্তা বিক্রি করেন।" এটা ভুল; কাজী ফার্মস আমাদের চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছে কোন ফিড বিক্রি করে না। যেহেতু চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছে কাজী ফার্মস্ ফিড কখনো বিক্রি করে না, জনাব সিদ্দিকী এই কথাটা ভুল লিখেছেন। 

জনাব সিদ্দিকী আরও লিখেছেন: "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং চুক্তিটি ছোট খামারিদের দ্বারা স্বাক্ষরিত ব্ল্যাংক চেকের (Blank Cheque) দ্বারা নিশ্চিত করা হয় এবং চুক্তির শর্তাবলী লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে, বড় কোম্পানিগুলি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্ল্যাংক চেকগুলি (Blank Cheque) ব্যবহার করে।" এটা সত্য নয়। কাজী ফার্মস কখনই চুক্তিবদ্ধ খামারিদের কাছ থেকে ব্ল্যাংক চেক (Blank Cheque) নেয় না। নিরাপত্তা হিসাবে আমরা একটি স্বাক্ষরিত চেক নিয়ে থাকি যাতে লিখিত টাকার পরিমাণ ফিড , বাচ্চা এবং ওষুধ  (যা আমরা খামারিদেরকে দেই)-এর দামের সমমূল্য। এই সিকিউরিটি চেকটি শুধুমাত্র তখনই ক্যাশ করা হবে যখন আমাদের দেওয়া উপকরণগুলি (ফিড, বাচ্চা এবং ওষুধ) খামারি কতৃক চুক্তি বহির্ভূতভাবে ব্যবহৃত হয়, অথবা উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগি খামারি কর্তৃক আত্মসাৎ হয়ে যায় (অন্য কথায়, যদি খামারি আমাদের সাথে প্রতারণা করে)।

জনাব সিদ্দিকী বেশিরভাগই বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের করা অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছেন। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত কোনো ব্যবসায়ী সমিতি নয়। এই সমিতির মুখপাত্র সুমন হাওলাদার । তার এজেন্ডা কি? যেহেতু সুমন হাওলাদার ক্রমাগত কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চলেছেন, এতে মনে হচ্ছে যে তিনি ডিলারদের (মধ্যস্বত্বভোগীদের) পক্ষে আছেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা খামারিদের কাছে বাচ্চা, ফিড এবং ঔষধ বিক্রি করেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিংয়ের বিরোধিতা করেন কারণ তারা চান না যে পোল্ট্রি কোম্পানিগুলি তাদের এড়িয়ে সরাসরি খামারিদের সাথে লেনদেন করুক।

কাজী ফার্মস এর "কন্ট্রাক্ট ব্রয়লার ফার্মিং" পদ্ধতি খামারিদের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে সাহায্য করে। আমাদের ব্যবসা খামারিদের উপর নির্ভরশীল; তাদেরকে লোকসান থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা তাদেরকে চুক্তির মধ্যে এনেছি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, মিঃ সিদ্দিকীর মতো ভুল তথ্যপ্রবণ লেখকেরা পোল্ট্রি শিল্প এবং হাজার হাজার খামারির বিরুদ্ধে থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের পাশে রয়েছেন।

পরিচালক
কাজী ফার্মস লিমিটেড
 

 

আরএস

×