ব্যক্তি জীবনে শেখ রেহানাও বাবা ও বড় বোনের মতো একজন সংগীতপ্রিয় ব্যক্তিত্ব
(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর)
ব্যক্তি জীবনে শেখ রেহানাও বাবা ও বড় বোনের মতো একজন সংগীতপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু পরিবারে সবসময়ই সংগীতের কদর ছিল। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের গান-বাজনার সঙ্গে সখ্য ছিল। তিনি সেতার বাজাতেন। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ছায়ানট থেকে সেতার বাজানোয় তালিম নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হয়েছিলেন। দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্লাব শেখ কামালের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শেখ কামাল ফুটবল ছাড়াও ভলিবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতে পছন্দ করতেন।
আবাহনী ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্ট আয়োজন করতেন। শেখ কামাল নাট্যচক্র নামে একটি নাট্য সংগঠনও গঠন করেছিলেন। তিনি যেমন সেতার বাজাতে জানতেন, তার ছোট ভাই শেখ জামাল গিটার বাজাতেন। শেখ কামাল নিজে বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ও করেছেন। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন ছায়ানটে ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন। ছোট বোন শেখ রেহানা নাচ এবং গানের তালিম নিয়েছিলেন ছায়ানট থেকে।
শেখ কামাল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং শাহাদাতবরণের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তিনি এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষা শেষ করেছিলেন, যার ফল বেরিয়েছিল ১৯৭৬ সালে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে মাত্র দশ বছর বয়সে হত্যা করা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তখন। নিষ্পাপ এই শিশুকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, এরা মানুষ নামের কলঙ্ক। এদের হিংস্রতা বর্বর পশুদেরও হার মানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্কৃতিমনস্কতা ও সাংস্কৃতিক চিন্তা বাঙালি জাতির সামষ্টিক সাংস্কৃতিক সত্তাকে এক সুসংহত ভিত্তি ও পরিচয় দান করেছে।
তাঁর লালিত এই সকল সুমহান মূল্যবোধ তাঁর পরিবারের মধ্যে সমানভাবে বহমান ও চির জাগ্রত। তাই বঙ্গবন্ধুর পরিবার বাঙালি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধারণ করে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এভাবে এক সময় বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যার ব্যর্থ স্বাদ পেতে চেয়েছে। কেননা, ওই নরপশু ঘাতকরা জানে না বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যায় না।
তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনে অনন্য অসাম্প্রদায়িক একটি উৎসব। আপামর বাঙালি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে দিনটি উদ্যাপন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পয়লা বৈশাখে সরকারি কর্মচারীদের স্বীয় বেতনের শতকরা বিশ ভাগ হারে বৈশাখী ভাতা প্রদানের প্রচলন করেছেন, যা এই দিনটিতে উৎসব পালনের একটি বড় প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানা উভয়েই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। কারও কারও জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নিজে শুভাশীষ জানাতে ভোলেন না। সুগভীর সংস্কৃতিপ্রীতি থেকেই উৎসারিত এই ভালোবাসা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানদেরও গড়ে তুলেছিলেন তাঁরই লালিত দার্শনিক বোধ, চেতনা ও আদর্শে। পরিশেষে যাঁর কথা না বললে অন্যায় হবে তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের কর্তা ব্যক্তি হলেও বাঙালির বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য তাঁকে জীবনের বহু বছর কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। সেই অর্থে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যারা তাঁদের মাতা মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অভিভাবকত্বেই বেড়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন লেখকের বই থেকে জানা যায়, পুত্র-কন্যাদের বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছুটির দিনে লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতেন- তাঁরা যেন তাঁদের পছন্দ মতো বই সংগ্রহ ও পাঠ করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের লেখক-সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধায় ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘শেখ মুজিব বললেন, আমার জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল বাঙালিকে জাতি হিসেবে তৈরি করা। আমার সে স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, বাঙালি আজ জাতি হয়েছে।’
একটি জাতির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিগঠন ও সুসংহতকরণ কোনো সহজ কাজ নয়। হাজার বছর ধরে যে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের বিকাশ এবং বিবর্তন ঘটেছে, তাকে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মানচিত্রের জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করা এক মহাকালিক দায়িত্ব। মহাকালের তরী বেয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা কর্তৃক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই পরিচয় পূর্ণতা লাভ করেছে। এই ভীষণ নিঃসঙ্গ ও অশেষ প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুকে দলের নেতৃবৃন্দের বাইরে যে মানুষটি একান্তভাবে নিরন্তর সাহস যুগিয়েছেন, সহযোগিতা করে গেছেন, তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মহৎ পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত ও তাঁদের স্নেহধন্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি রক্ষার যে আন্দোলন অব্যাহত আছে, তা সামনের দিনে আরও বেগবান হবে বলে প্রত্যেক বাঙালির বিশ্বাস।
জাতির পিতার সারা জীবনের সাধনা ছিল উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদয়িক এক বাংলাদেশ নির্মাণ। একটি জাতির সামষ্টিক মননে এসব অমূল্য আদর্শের বীজ রোপণ করা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় মহাজীবনের অধিকারী কোনো মহামানবের। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের সেই কাক্সিক্ষত মহামানব।
ওই মহামানব আসে।/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে ॥/সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,/নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-/এলো মহাজন্মের লগ্ন।/আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।/উদয় শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’/নব জীবনের আশ্বাসে ?/‘জয় জয় জয়রে মানব-অভ্যুদয়’/মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে ॥
(সমাপ্ত)
লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ