শামীম আহমদে
আমেরিকার ৭১তম সেক্রেটারি অব স্টেট এন্টনি ব্লিঙ্কেনের টুইট করা একটি পোস্ট নিয়ে সারাবিশ্বের বাংলাদেশীদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সেটি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পড়ালেখা ও চিন্তাভাবনাও চলছিল। সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন প্রায় প্রতিদিন এক বা একাধিক টুইট (টুইটারের পোস্ট) করে থাকেন। যেমন গত ১৭ মে তিনি তার টুইটে সাইক্লোন মোকাবিলায় বাংলাদেশ এবং বার্মার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টটিতে কমেন্ট পড়েছিল ২৮৩টি, রিপোস্ট হয়েছিল ২০৩ বার, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন ৯২৩ জন মানুষ। প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষ পোস্টটি দেখেছিল।
বাংলাদেশকে নিয়ে করা গতকালকের ঠিক আগের ন্যাটো সংক্রান্ত পোস্টে কমেন্ট পড়েছিল ১৭৫টি, রিপোস্ট হয়েছিল ১৮২ বার, প্রতিক্রিয়া ৮৫৩টি এবং দেখেছেন ৭০ হাজারের অধিক মানুষ। বাংলাদেশকে নিয়ে করা গতকালকের টুইটের পর তিনি আরও দুটো টুইট করেছেন কংগোতে চলমান সহিংসতা এবং আফ্রিকা দিবসের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।
এই দুটো পোস্টে কমেন্ট পড়েছে যথাক্রমে ৫৩৫ ও ৫০টি, রিপোস্ট হয়েছে ৪৪১ ও ৫১ বার, প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ১৩৩১ এবং ২৩৫ জন। এছাড়াও টুইট দুটি দেখেছেন যথাক্রমে প্রায় পৌনে ৩ লাখ ও ১৬ হাজার মানুষ। এদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে করা তার টুইটে কমেন্ট পড়েছে ৫৮৮৭টি, রিপোস্ট হয়েছে ৪৪৮৩ বার, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি মানুষ এবং টুইটটি দেখেছে ২০ লাখের মতো মানুষ। আমি গত দুইমাসে তার যত টুইট দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন ও সে সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বিষয়ক পোস্টটি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত তার করা সকল টুইটের মধ্যে এটি যদি সবচেয়ে বেশি আলোচিত না-ও হয়, অন্যতম আলোচিত টুইট তো বটেই।
বাংলাদেশকে নিয়ে করা পোস্টটিতে যত কমেন্ট পড়েছে, তার কিছু পড়ে দেখার চেষ্টা করেছি, কিছুক্ষণ পড়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশীদের টুইটারে উপস্থিতি বরাবরই কম, এই পোস্টটিতে বরং আধিপত্য দেখলাম পাকিস্তানিদের। তাদের অধিকাংশ বলছে, বাংলাদেশ সংক্রান্ত এই নীতি পাকিস্তানে আগে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তারা পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় উল্লেখ করে কেউ কেউ বলছেন আমেরিকার উচিত পাকিস্তানের বিষয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। অন্যরা বলছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলালেও এই অরাজকতা মোকাবেলায় বিশ্বের অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত।
বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। খোদ পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষজন বলছেন তাদের দেশের পরিস্থিতি আমেরিকার কাছ থেকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কামনা করে; বাংলাদেশ নয়। সেখানে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মনে হলো খুশিই হয়েছেন যে আমেরিকা বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে! পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে আমেরিকা তাদের দেশীয় মতবাদের বহির্প্রকাশ অন্যান্য দেশে দেখতে চাইবে, আমি এটাতে মোটেও অবাক হচ্ছি না। আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ। তারা অন্যান্য দেশেও গণতন্ত্র দেখতে চায়।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীতে শক্তির যে মেরুকরণ তাতে আমেরিকার মূল অস্ত্র পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র। তাদের সকল বৈদেশিক নীতি এই দুটো বিষয়কেন্দ্রিক। কেননা, একই সময়ে তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সাম্যবাদ ও কমিউনিজমের ধারক ও বাহক। নিঃসন্দেহে গত প্রায় পৌনে একশ’ বছরে আধিপত্যের এই লড়াইয়ে আমেরিকা এগিয়ে ছিল বেশিরভাগ সময়ে। তারা যখন একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়, তার পেছনে অনেক ঘটনা থাকে, যার বেশিরভাগ আমরা সাধারণ মানুষ জানতেই পারি না। আপনারা যদি সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দেখে থাকেন, তবে দেখবেন সেখানে তিনি তাঁর যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক অসন্তোষ লুকানোর চেষ্টা করেননি।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বে যে কটি দেশ আমেরিকাকে সরাসরি সমর্থন করেনি বাংলাদেশ তার অন্যতম। গত এক দশকে বাংলাদেশ সরকার ক্রমশ আমেরিকা থেকে সরে রাশিয়া, ভারত ও চায়নার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে এত বছর ধরে দিয়ে আসা অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করেছে। এই সব ঘটনা, যেগুলো সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা জানি, তার প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের আমেরিকার সঙ্গে শীতল সম্পর্ক দিকনির্দেশ করে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
১৯৭১ সালে আমেরিকার পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এমন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের সরকারপ্রধান গত ৫০ বছরে যে কোনো সময়ের চাইতে একজন সাহসী ও ‘independent’ রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
এটি মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্বদান বিষয়ক সিদ্ধান্তের পেছনে শেখ হাসিনার অবদান প্রায় একক। দল ও সরকার হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিগত সরকারগুলোর চাইতে কোনোভাবে আলাদা কিনা সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি, অরাজকতা প্রশ্নাতীত ও দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু যে কারণে বর্তমান বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সরকার অন্যদের চাইতে ভিন্ন তার মূল কারণ শেখ হাসিনা। গঙ্গা পানি চুক্তি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি, রোহিঙ্গা পুনর্বাসন, পদ্মা সেতু নির্মাণ থেকে অসংখ্য সিদ্ধান্ত তাঁর একক নেতৃত্বে হয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো সরকার প্রধান সম্ভবত নিতে পারতেন না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সেসব সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল না। শেখ হাসিনা মূলত একজন ‘ারংরড়হধৎু’ নেতা হিসেবে এই সিদ্ধান্তগুলো নেন, যাতে বিশ্বের শীর্ষ দেশ আমেরিকাসহ অনেকেই পুরোপুরি খুশি ছিল না।
সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ব্লিঙ্কেন যেদিন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসানীতির ঘোষণা দেন, ঠিক সেদিনই আমেরিকার শীর্ষ পত্রিকা The Economist শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারের শিরোনাম -‘Sheikh Hasina is Asia's iron lady’। সাক্ষাৎকারের প্রারম্ভে তারা শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখেছে,
Bangladesh's prime minister, Sheikh Hasina, is the world's longest-serving female head of government, and one of the most significant of either sex. During two decades in office she has presided over momentous poverty alleviation in her country of 170m, fuelled by average annual gdp growth of 7% for much of that time. The 75-year-old has led her party, the Awami League, to victory in three consecutive polls, and four in all—one more than Indira Gandhi or Margaret Thatcher managed. With an election due early next year, which she is expected to win, The Economist asked her, in an interview in her northern Virginia hotel suite, what ambitions she had left.”
শেখ হাসিনার বাংলাদেশে গণতন্ত্র, দুর্নীতির অভিযোগ আছে সত্য, কিন্তু বাংলাদেশের যে অবিশ্বাস্য উন্নতি তা-ও যে তাঁর নেতৃত্বে হয়েছে, সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনার উন্নয়ন নিয়ে শীর্ষ দেশগুলোর আপত্তি না থাকলেও তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থের বাইরে বিদেশী প্রভাব অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা তা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গুণের এই বিষয়টি বুঝতে আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। পরিবার, কর্মক্ষেত্রসহ চারপাশে তাকালেই আপনি বিষয়টি দেখতে পারবেন।
যখন কেউ নতজানু হয়ে ভালো করে, উন্নতি করে তখন যার প্রতি নতজানু হয় সে একধরনের তৃপ্তি অনুভব করলেও একসময় যদি যে নতজানু হয় সে স্বতন্ত্র হয়ে যায়, নিজের রাস্তা খুঁজে পায়, তবে তাকে অবদমিত করার তাড়না অনুভব করেন আগে যারা তার মুরুব্বি ছিলেন তারাই। আমেরিকার সঙ্গে শেখ হাসিনার দুরত্ব সৃষ্টির মূল কারণও এটি।
এখন যদি আমরা এইসব গভীর বিষয় অগ্রাহ্য করে সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনের টুইটারটি দেখতে চাই, তবে দেখব যে তিনি সেখানে একটি নতুন ভিসানীতির উল্লেখ করেছেন, যার আওতায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করায় কেউ জড়িত থাকলে তাকে এবং তার পরিবারের যে কারও ভিসা আবেদন আমেরিকা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার এই নাক গলানো একটু অস্বস্তিকর হলেও বিস্ময়কর নয়। শক্তিশালী রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না রেখে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ধরনের অবস্থান নিয়ে থাকে।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের বিষয়ে আমেরিকা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার, যে কোনো নতুন নীতি প্রণয়ন না করেও আমেরিকা যে কোন সময়ে যে কারও ভিসা প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং করে এসেছে। তাহলে এই নতুন নীতি ঘোষণার মাজেজা কী ভিসা প্রত্যাখ্যান করা, নাকি সারাবিশ্বে বাংলাদেশ নিয়ে একটি নেতিবাচক মতবাদের প্রচার ঘটানো, এই বিষয়টি খেয়াল করা জরুরি। সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনের এই টুইট বা ভিসানীতি কি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করার বিষয়? অবশ্যই। খেয়াল করুন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে বা করবে আবার একই সঙ্গে আমেরিকায় ভিসা নিয়ে যাবে এমন মানুষের সংখ্যা কত হতে পারে?
আমেরিকায় যে লাখ লাখ বাংলাদেশী থাকেন, কাজ করেন বা পড়েন, তাদের সঙ্গে এই ভিসানীতির কোনো সম্পর্ক নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে আপাত দৃষ্টিতে এই নীতির আওতায় কেউই পড়বেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আমেরিকার এই টুইটের অর্থ হচ্ছে, তারা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আসন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ বাধা দিতে পারে, কিংবা কেউ কেউ ইতোমধ্যে বাধা দিচ্ছে এবং তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে প্রবেশে বাধা দেবে। উল্লেখ্য, নির্বাচনে বাধা দেওয়ার মতো প্রভাবশালীরা বরাবরই দেশ ছেড়ে গেলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং সম্প্রতি কানাডায় গিয়ে থাকেন। এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে, আমেরিকার এই ভিসানীতির প্রভাব ইংল্যান্ড ও কানাডার সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করবে। কিন্তু যারা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক পারমিট কিংবা স্টাডি পারমিট নিয়ে যেতে চান, তাদের ক্ষেত্রে এর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব থাকার কথা না।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা একটি নীতি ঘোষণা করতেই পারে। বর্তমান সরকারের যদি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছা না থাকে, তাহলে এতে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই নীতি যদি স্বচ্ছ ও ‘ড়নলবপঃরাব’ হতো তাহলে বরং বাংলাদেশের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরকে খুন, জখম, নির্যাতনের জন্য বিএনপি জামায়াতের আতঙ্কিত হওয়ার কথা ছিল। ২০১৩-১৪ মৌসুমে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় বিএনপি-জামায়াত আগুনে পুড়িয়ে দেশের যে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, মানুষ মেরেছে, তাতে তাদেরই আতঙ্কিত হওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তা হয়নি।
বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা দেশের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছে। কারণ, এটি স্পষ্ট যে এই নীতির অধীনে আদৌ কারও ভিসা প্রত্যাখ্যাত হবে কিনা আমরা জানি না, কিন্তু সুস্পষ্টভাবে একটি দেশকে আলাদা করে, চিহ্নিত করে আমেরিকা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর তাদের অনাস্থা নির্দেশ করেছে। সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও সত্য। আমেরিকার এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান ও আগামী নির্বাচন আদৌ প্রভাবিত হবে কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও দেশের বিরুদ্ধে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের এমন নীতি, যাতে আদতে কোনো সাধারণ নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তা যখন ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে উল্লসিত করে, তা কেন জানি আমাকে বারবার ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, আমাকে হতাশ করে।
আবার আমেরিকা সংক্রান্ত জটিলতায় প্রথম যে বিষয়টা হয়, সেটা হচ্ছে যাদের সঙ্গে আমেরিকার ঝামেলা, তাদের পক্ষের হাজার হাজার মানুষ পোস্ট দেওয়া শুরু করেন আমেরিকার ভিসা না পেলে কী হয়? আমেরিকায় কে যেতে চায়? যারা এগুলো বলেন, আমি বিশ্বাস করি তাদের অনেকেই আমেরিকায় যেতে চান না। আমেরিকায় যেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার এদের অনেকে আমেরিকায় যাওয়ার জন্য জীবন যৌবন দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন, এখন সেই দুঃখে বলেন আমেরিকায় যেতে চাই না। আমেরিকায় যেতে চাওয়া না চাওয়া ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও আগ্রহের বিষয়।
কিন্তু এই যে হাজার হাজার মানুষ সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনের একটি টুইটের পরিপ্রেক্ষীতে ‘তোদের আমেরিকায় গেলাম না’ বলছেন, তারা আদতে নিজেদের সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী হিসেবে ঘোষণাও করছেন। কেননা, আমেরিকা বলেছে কেবল যারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবে তাদের ও তাদের একান্ত পরিবারকে ভিসা না-ও দিতে পারে আমেরিকা। তাহলে এই যে হাজার হাজার মানুষ আমেরিকার ভিসা অগ্রিম প্রত্যাখ্যান করছেন, তারা আগ বাড়িয়ে মেনে নিচ্ছেন যে তারা আসন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবেন? আমি জানি বিষয়টা ঠিক তা নয়। অনেকে দেশপ্রেম থেকেও এটি বলছেন। পৃথিবীর দুশ’টিরও বেশি দেশ, যার প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু নয়, সেখানে কেবল বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকার এই উদ্বেজন, তাদের আহত করেছে।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নয়ন এবং আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য না মেনে মেরুদন্ড সোজা রাখায় নির্বাচন নিয়ে তাদের এই উদ্বেগ। বাংলাদেশ যদি আগের মতো দরিদ্র্য ও ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতির দেশ হতো, তাহলে একটি অগণতান্ত্রিক নির্বাচনে অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আপোসরফায় আমেরিকা বেশি আগ্রহী, যা ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে আমরা দেখেছি।
আমেরিকার ভিসানীতি নিজের কাঁধে নেবেন না। আপনি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করেন না, এর দায় আপনি কেন নেবেন? আবার হাজার হাজার ডিভি পরবর্তী আমেরিকাপ্রেমী যে এই ঘোষণায় খুশি, তাদের পুরো শরীর তো দূরের কথা, দু’একটা কেশও কয়েক যুগ চেষ্টার পর আমেরিকা পৌঁছুতে পারেনি, সামনেও পারবে না।
বে অনেককে আবার দেখেছি, যারা আমেরিকায় থেকে দেশের পক্ষে কথা বলেন, তাদের অপমান করার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের বিনয়ের সঙ্গে বলি, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির দেশ, যার ভিত্তি অভিবাসী নাগরিক, সেখানে টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। একজন বাংলাদেশী আমেরিকান, তিনি প্রফেসর কিংবা বিজ্ঞানী, ট্যাক্সি ড্রাইভার কিংবা হোটেলের কর্মচারী, ছাত্র কিংবা গবেষক- যেই পেশায় নিযুক্ত থাকুন না কেন, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে কর্মঠ মানুষগুলোর সঙ্গে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকেন।
এর মাঝেও যারা দেশ নিয়ে পজিটিভলি ভাবেন, তাদের প্রশংসা করুন। বিদেশে এসে হীনম্মন্যতায় ভোগা কোটি কোটি মানুষ নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য দেশের সব খারাপ, সরকার খারাপ এই প্রচারণায় মেতে ওঠে। এর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক মানুষ যারা দেশের পক্ষে থাকে, তারা সালাম পাওয়ার যোগ্য, তিরস্কার নয়। এছাড়া দেশের সব মানুষ যদি দেশের পক্ষে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াত, তাহলে হয়ত প্রবাস জীবনের কঠিন যুদ্ধ শেষে তাদের ভিসা ও নাগরিকত্বকে ঝুঁকির মুখে রেখে এত প্রবাসীকে দেশপ্রেমে নিয়োজিত থাকতে হতো না। প্রায়ন এই অভিযোগটা আকারে ইঙ্গিতে শুনে থাকি যে, কানাডায় বসে এত বড় বড় কথা কেন বলি? পারলে দেশে এসে বলতে।
দেশ নিয়ে আমার প্রথম লেখা ভোরের কাগজে ছাপা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে যখন স্কুলে পড়ি। দেশে থাকা এবং বিদেশে আসায় আমার দেশপ্রেমে কোনো ছেদ পড়েনি। দুঃখজনক হলেও সত্য দূরের মানুষ কেউ কখনও এমন প্রশ্ন করেননি, করেছেন কাছের মানুষরাই। অথচ তারাই সবচেয়ে ভাল জানেন স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে এসেও কেন এখনও কানাডায় আছি। আমি কানাডায় বসে দেশের পক্ষে কাজ করি। কথাগুলো কখনও বলতে হবে ভাবিনি, কিন্তু অত্যন্ত ভারী হৃদয়ে বলতে বাধ্য হলাম। অনেকে বিদেশে থেকে যান নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, হয়তো সংসার, স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের কথা ভেবে। কেউ স্বাস্থ্যসেবার জন্য, কেউ সামাজিক নিরাপত্তা আর কাউকে কাউকে দেশ আগলে রাখতে পারে না বলে। দয়া করে তাদের সদিচ্ছাকে ছোট করে নিজেকে খেলো প্রমাণ করবেন না।
সবাই হুমায়ূন আহমেদ হতে পারেন না, কাউকে কাউকে জাফর ইকবাল হতে হয়। কেউ হন নভেরা আহমেদ। আবার কেউ হন আবদুল মোতালেব, যাকে কেউ কখনও চেনে না, দেশকে ভালোবেসে বিদেশের মাটিতেই তার মৃত্যু হয়। চরপশ ুড়ঁৎ ভরমযঃ রিংবষু. ভুল মানুষকে ভুল জায়গায় শত্রু বানাবেন না। দেশপ্রেম এত খেলো না। দেশপ্রেমের জন্য পল্টন ময়দানে দিবারাত্রি দাঁড়িয়ে থাকা জরুরি না।
টরন্টো
২৮ মে ২০২৩