ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে রয়েছে নারীর গৌরবগাঁথা অধ্যায়

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার 

প্রকাশিত: ১২:০৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে রয়েছে নারীর গৌরবগাঁথা অধ্যায়

স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে নারীর অবদান

পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করে ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে এনেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিলেন স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবন বাজি রাখার ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নারীরা নানা কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বন্দুক চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপ, ব্যারিকেড তৈরি, আত্মরক্ষাতে মরিচের গুঁড়া শত্রুর গায়ে নিক্ষেপ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো নারীদের। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাহাড় ঘেরা নির্জন জায়গায় ও কোন বাড়িতে এসব প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নারীরা এসব প্রশিক্ষণ দিতেন।

এর মধ্যে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তাতে ছেলেদের পাশাপাশি তরুণী, সচেতন ছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখযোগ্য। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে বহু ছাত্রী অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিয়ে প্রথম সশস্ত্র ব্রিগেড তৈরি করেন একজন নারী কমান্ডার। সেখানে ছাত্রীদের রাইফেল চালানো, শরীর চর্চা, ব্যারিকেড তৈরি ও প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষা দেয়া হয়। ঢাকার কলাবাগান, রাজারবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রথমে নারী ব্রিগেড তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ওই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অনেক নেত্রী সশস্ত্র ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করেন। কলকাতায় একমাত্র মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়।  ট্রেনিং ক্যাম্পটি গোবরা ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত। ক্যাম্পে মোট ৪০০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের আগে নারীদের সাহসিকতা, রাজনৈতিক চেতনা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। তারপর তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হতো। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতেন।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের ভূমিকাও ছিল ঐতিহাসিক। শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম বা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। এভাবে নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অদম্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও পৌঁছে দিয়েছেন সময়ের প্রয়োজনে। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ঔষধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা, রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকান্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ। সুফিয়া কামাল পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারিতে যুদ্ধের নয় মাস ঢাকায় তার বাড়িতেই ছিলেন। ওই অবস্থায়ও তিনি নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। যা তিনি সে সময় দিনলিপিতে লিখেছেন- তা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে অনেক স্বাধীনতাকামী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা নারী নির্যাতন ও পাশবিকতার কথা প্রচার করে নারী সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিসেস নুরজাহান মোর্শেদ এমএনএ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানের পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত করেন। বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ এমএনএ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, চট্টগ্রামের মুশতারী শফী, পাবনার শিরিন বানু মিতিল, সুনামগঞ্জের দীপালি চক্রবর্তী, নেত্রকোনার রেখা সাহা, প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এক মহান আত্মত্যাগ ও বীরত্বকাব্য সংগ্রামে এভাবেই বাংলাদেশের নারী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সাহায্য সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি তাদের গবেষণায় বলছে, এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার। এমনকি ৯ মাসে যে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছে, তার ২০ শতাংশই নারী। নির্যাতনের ধরন ছিল বর্বরোচিত।  একাত্তরে যে সাড়ে চার লাখ নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়, তার ধরন ছিল অমানুষিক। ঘাতকরা কেবল নির্যাতন বা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ৭০ শতাংশ ধর্ষিতার সামনে হত্যা বা নির্যাতন করা হয়েছে তাদের স্বামী বা নিকট আত্মীয়কে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারীকে স্পট ধর্ষণ ও স্পট গণধর্ষণ, ১৮ শতাংশ নারীকে কারাগারে ও ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়েছে। দেশের ৪২ জেলার ৮৫ থানায় নির্বাচিত ২৬৭ জনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা চালানো হয়।গবেষণায় আরো বলা হয়, নির্যাতিত নারীদের মধ্যে বিবাহিত ছিলেন ৬৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং অবিবাহিত ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ভারতে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা হিন্দু নারীদের মধ্যে কুমারী বা অবিবাহিতা ছিলেন ৪৪ শতাংশ। এঁদের অধিকাংশই আর দেশে ফেরেননি। গবেষণায় দেখা যায়,নির্যাতন-পরবর্তী সময়ে নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল প্রকট। এসব নারী আক্রান্ত হয়েছে নানা যৌন রোগে। দীর্ঘদিন আক্রান্ত ছিলেন মানসিক রোগেও। ৮০ শতাংশ নারী বিষাদগ্রস্ততা এবং ৮০ শতাংশ অস্থিরতা, নৈরাশ্য ও মাথাব্যথায় ভুগেছেন দীর্ঘকাল। একইভাবে ৯০ শতাংশ নারী ভুগেছেন গ্লানিতে। আর ৭ শতাংশ নারীকে স্থায়ী ক্ষত নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে সারাজীবন। বেঁচে আছেন এখনো অনেকে। ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং সংস্থার নিজস্ব ল্যাবরেটরি ও নির্বাচিত হাসপাতালে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে নির্যাতিত নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। সে ফলাফলের ভিত্তিতেই উঠে এসেছে এই চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর এই নারীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকা ছিলো দেশকে নতুন করে দাঁড় করানোর জন্য। নারীদের এই বিষয়টিও আজ আলোচনার বাইরে। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের এই দেশের অনেক নারী হারিয়েছিলেন তার নিজের পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্য যেমন বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলেকে।পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত হামলায় কোন পুরুষ জীবিত না থাকায় আমাদের দেশের অনেক গ্রাম পরিচিতি পেয়েছিলো ‘বিধবার গ্রামে’। তখন দেশের অর্থনীতির অনেকাংশের হাল ধরেছিলো এই মহান এবং সাহসী নারীরাই। সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল তাদেরই কাঁধে।

তবে মুক্তিযুদ্ধে যে নারী গৌরবগাঁথা রচনা করেছিল তা ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে অনেকটা। তবে প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার একটি অন্তরায় বলা যায় নিম্নবর্গের নারীরাই ব্যাপকভাবে এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে সর্বমোট ৬৭৬ জন বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম ও অন্যজন তারা ভানু বিবি (তারামন বিবি), যাদের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু নারীদেরকে সব সময় সম্মান দিয়েছেন। যার প্রমাণ মেলে সংগ্রামী জীবনের চিরসাথী স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি তার প্রেম, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আর কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে। তিনি সব বিষয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছার মতামত নিতেন। এমন মহৎ মনের মানুষটি কখনো নির্যাতিত নারী শব্দটি উচ্চারণ করতেন না। যা তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি পড়লে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীদের ত্যাগ যে কোনো কিছু দিয়ে শোধ হবে না, তা তিনি বারবার বলেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অত্যাচারিত নারীরা এ সমাজে যখন নিগৃহীত নিপীড়িত হতে থাকে, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সত্যিকারের পিতার ভূমিকায় থেকে বলেছেন ” ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা লেখ ধানমণ্ডি ৩২…। মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?”

যে নারীদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন পিতা যে, কন্যার সুখ-দুঃখে পাশে থাকে তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু। তিনি ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের বীর শ্রেষ্ঠ, বীর প্রতীক খেতাব দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা নারীদের জন্য দিয়েছেন বীরাঙ্গনা খেতাব। তার এ উচ্চমার্গীয় চিন্তার কাছে শ্রদ্ধায় অবনত হয় দেশ ও জাতি। আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকার পুরুষের রক্তের পাশাপাশি মিশে আছে নারীর রক্ত, নারীর আত্মত্যাগ। সুতরাং আমাদের সকল নারীদের এই মহান আত্মত্যাগের প্রতি যথাযথ সন্মান জানাতে হবে।

লেখক: সহ-সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ 

টিএস

×