ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ও স্বীকৃতি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ও স্বীকৃতি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণ তাদের সহানুভূতি এবং সমর্থন বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছিল ভারত সরকার, তার জনগণ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, বিশ^জনমত গড়ে তোলাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল। ভারতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পীদের মধ্যে প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ১০ দিন আগে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাকে আমরা কয়েক প্রকারে বলতে পারি। প্রথমত, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের আশ্রয় প্রদান। তাদের জন্য খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, যুব শিবির স্থাপনে সাহায্য ও মুজিববাহিনীতে অংশগ্রহণকারী যুবকদের প্রাাথমিক শিবির ও প্রশিক্ষণ। তৃতীয়ত, নিয়মিত বাহিনী অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডার সেনাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, রসদসহ সর্বপ্রকার সাহায্য।

চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতা। পঞ্চমত, গণসংযোগ এবং গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপনের যৌক্তিকতা এবং আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যায় অন্যায্য আক্রমণ, এগুলোর বিশ্বব্যাপী প্রচারে সাহায্য। ষষ্ঠত, প্রবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারকে সব রকমের সহযোগিতা প্রদান। সপ্তমত, এই সরকারের অধীনস্থ আঞ্চলিক প্রশাসন অর্থাৎ তড়হধষ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ-কে সহযোগিতা করা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি গোটা ভারতে প্রবল হয়ে ওঠে। ২৭ মার্চ ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষ অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা নিয়ে আলোচনাকালে পাকিস্তানিদের পৈশাচিকতার নিন্দা করে বক্তব্য রাখেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ সব দলের সদস্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে ২৭ মার্চ এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ডের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপরে যে নজিরবিহীন নির্যাতন চলছে আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা না করে পারে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের এ মহান সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি সমর্থন ও সহৃদয় সহানুভূতি অব্যাহত থাকবে।’
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের লোকসভায় পূর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভ্যুত্থানকে অভিনন্দিত করেন এবং তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। লোকসভার প্রস্তাবে বলা হয়, শান্তি ও মানবিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ভারত বাংলাদেশের জনগণের ওপর বল প্রয়োগ বন্ধের জন্য পাকিস্তানের প্রতি দাবি জানাচ্ছে।

লোকসভায় উদ্বেগ এবং নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে সেটি গৃহীত হয় সর্বসম্মতিক্রমে। পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যার কঠোর নিন্দা ছাড়াও পূর্ববাংলার মানুষের ন্যায্য সংগ্রামে বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।  
ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ প-িত রবিশঙ্কর ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে ছিলেন। তিনি ও জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে দশ লাখ ডলার তুলে শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য ইউনিসেফকে দিয়েছিলেন। মকবুল ফিদা হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামল দত্ত রায়, গণেশ পাইনের মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকে বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে তার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন।

অন্নদাশঙ্কর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রণব রঞ্জন রায়, তরুণ সান্যাল, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, নির্মল চক্রবর্তী, ড. ফুলরেনু গুহ, দিলীপ বসু, ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, আবদুর রহমান, ডা. গণি, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। নীরেন সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে, বিমল দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা দিল্লী, বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা বাংলাদেশ তহবিলে দিয়েছিলেন।
ওঘউওজঅ এঅঘউঐও - অ চৎড়ভরষব রহ ঈড়ঁৎধমব গ্রন্থের লেখক ঞৎবাড়ৎ উৎরবনবৎম ১৯৭১ সালের অসাধারণ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর এই জীবনীগ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লি আসেন। দিল্লিতে এসে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বিশিষ্ট উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করেন। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে কিন্তু আমেরিকার পক্ষে ভারতকে সমর্থন করা সম্ভব হবে না।

এ ধরনের যুদ্ধের মনোভাব থেকে ভারতের বেরিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ কিছুতেই আমেরিকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে পারছিল না। সেই সময় কিসিঞ্জার কিন্তু ঠিক ভারতে আসবেন বলে আসেননি। তিনি তখন যাচ্ছিলেন চীনে। চীনের সঙ্গে তখন নিক্সন বরফ গলাতে চাইছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ সমর্থন ও স্বীকৃতি এবং কেন ভারত সেটা করছে, তা পৃথিবীর কাছে জানানোর জন্য সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন, যাতে অন্যান্য দেশও ভারতকে সমর্থন করে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের একটি বহুল তাৎপর্যময় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও বলেন, আমরা তড়িঘড়ি করে বা আবেগপ্রবণ হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি।

স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ এবং গণমানুষের সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রাম দেখে আমাদের বিলক্ষণ মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে আর কখনোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না পাকিস্তান। শ্রীমতী গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই পার্লামেন্টে উপস্থিত ভারতীয় সব জনপ্রতিনিধি এককণ্ঠে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলাদেশ’ বলে হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠেন। সবাই নতুন রাষ্ট্রকে অভিনন্দিত করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক পরিচালিত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিকে কূটনৈতিক মাস্টার স্ট্রোক হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার জন্য এবং তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি ও জনমত গঠনের জন্য তিনি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের জনগণের উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার এবং তিনি তা দিয়েছেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের শরণার্থীদের সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠাবো, মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম সাহায্য করবো এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনবো। আমিও আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।’
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যদি আমি ভারত সরকারের বিষয়ে না বলি, তাহলে অন্যায় করা হবে। আমাদের দেশের জনসাধারণ যখন প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষে যায়, তখন ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং আসামের জনসাধারণ, বিশেষ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কারণ তারা আমাদের জনসাধারণকে বুকে টেনে নিয়েছেন। স্মরণ করি, ভারতের সেনাবাহিনীর ঐ সমস্ত জোয়ানকে, যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সূচনালগ্নেই ভারতব্যাপী এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিপরীতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার আবেদন ছিল অনেক তীব্র। যা অনুপ্রাণিত করে ভারতের রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তা, প্রবাসী সরকারকে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে ভারত সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।

লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×