ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

আইএমএফের ঋণ ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১২ নভেম্বর ২০২২

আইএমএফের ঋণ ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আগামীতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে

অর্থনীতিবিদ নই। তবে অর্থনৈতিক সংকট ও নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষকে কিভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হয় সে বিষয়ে কিছুটা বাস্তব অভিজ্ঞান অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি। ব্যক্তি জীবনে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে যতটা অগ্রসর হয়েছি তাতে কেতাবী অর্থনীতি পড়ার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এই দেশে যারা বড় বড় অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাতির শিখরে অবস্থান করছেন তারা সবাই কেতাব মুখস্থকারী অর্থনীতিবিদ। তাদের চিন্তা চেতনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে কিভাবে একটা সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে সমান্তরাল অর্থনীতিকে বিকশিত করতে হয় সেটা তারা জানেন বলে বিশ^াস করতে কষ্ট হয়।

কেননা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সীমাহীন আয় বৈষম্যে কথিত অর্থনীতিবিদদের বিবেক এখনো নড়ে উঠেনি। সেজন্যই আমাদের এত দুর্দশা, এত দুর্ভোগ। সম্প্রতিকালে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে দারুণ আলোচনার ঝড় বইছে। গোটা বিশ^ই এমন পরিস্থিতির মুখে। এর কারণ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, অচেনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ^ অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
হ্যাঁ, এটা একটা কারণ বটে, কিন্তু আসল কারণটা অন্য জায়গায়, কিংবা বলতে পারি এটা আপেক্ষিক সত্য, তবে সর্বাংশে সত্য নয়। এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বিগত দুটো বছর করোনা ভাইরাসে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার এরকম অভিঘাতের সুযোগে এক শ্রেণির মানুষ ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন করেছে। কেউ কেউ নিঃস্ব হয়েছে, কেউ কেউ করেছে বিশ^ জয়। টাকার পাহাড় তৈরি করা মানুষগুলো তো কোনো রাষ্ট্রের কাছেই অচেনা নয়। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধেও ক্ষতির মুখে পড়েছে এক শ্রেণি। একই সঙ্গে আরেক শ্রেণি বিপুল ধন-সম্পদ অর্জনের সুযোগ পেয়েছে। কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ।

এমনি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যে সভ্যতা বিকশিত সে সভ্যতা কী মানবিক উৎকর্ষ বিধানে সহায়ক হতে পারে? এর উত্তর কোনো রাষ্ট্রের শাসকই দিতে পারবেন না। অর্থনীতিতে চক্র ধনু আছে। সে ধনুটি কখনো কখনো এদিক-ওদিক হেলে পড়ে। এটি অর্থনীতির এক চমৎকার খেলা। ধনুটি যাদের হাতে থাকে তারাই এটি নিয়ে খেলাধুলা করে। তাদের ইচ্ছায় ঘটে উত্থান-পতন। সাধারণ মানুষ এটা ভালো করেই জানে। বলা হচ্ছে বিশ^ মন্দার কথা। বিশে^র মানুষ মন্দা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে যার যার সামর্থ্য অনুসারে। মন্দার ঢেউ আমাদের এখানেও আছড়ে পড়েছে। এই ঢেউয়ে কত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে তার হিসাব আমাদের জানা নেই।

বিগত করোনাভাইরাসের অভিঘাতে কত মানুষের প্রাণ গেছে এই বিশে^ তার একটি পরিসংখ্যান রয়েছে। মৃতের যে পরিসংখ্যান তা কেবল অভিঘাতে নয়, অন্য কারণেও মৃত্যুবরণ করেছে। সংখ্যার দিক থেকে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন ব্যাপার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বীর বাহাদুর সেনারা পাখির মতো নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চলেছে। যুদ্ধকেন্দ্রিক হত্যাযজ্ঞ কতদিন চলবে সেটাও কারও জানা নেই। এ নিয়ে কথা প্রলম্বিত করতে চাই না।
বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দাকে ঘিরে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনকারী বাংলাদেশ অজানা শঙ্কার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে এমন ধারণায় সরকার এক ভয়ঙ্কর চাপ অনুভব করেছিল। বৈদেশিক রিজার্ভ দ্রুত কমতে শুরু করে। রেমিটেন্স ফ্লো কমে যেতে থাকে। এমন অবস্থার মধ্যে সরকার ঋণ পেতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে আইএমএফের ঋণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ন্যায়সঙ্গত ঋণ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের ভিত্তিতে আইএমএফ সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। যে পরিমাণ ঋণ পাওয়া যাবে টাকার হিসাবে তা ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। ঋণের এক-চতুর্থাংশ পাওয়া যাবে সুদবিহীন। বর্তমান মন্দা পরিস্থিতিতে এটি একটি স্বস্তির সংবাদ বটে।
পাঠকদের জানার উদ্দেশ্যে আইএমএফ সম্পর্কে কিছু বলে রাখতে চাই। আইএমএফ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। ইংরেজিতে বলা হয় ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গড়হবঃধৎু ঋঁহফ। আইএমএফ অর্থ সংকট মোকাবিলায় পরিত্রাতার ভূমিকায় সামনে আসে বটে, কিন্তু বিপদ কতটা মুক্ত হয় সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় আইএমএফ। প্রতিষ্ঠাকালীন ২৯টি দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়। বর্তমানে ১৯০টি দেশ এই সংস্থার কার্যক্রমের আওতাভুক্ত এবং সদস্য।

আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য রাখার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। আইএমএফের মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং দরিদ্র হ্রাসে সহায়তা করার জন্য নীতিমালা ও সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির ভূমিকা রাখে এই প্রতিষ্ঠান। এর কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারগুলো ত্রুটিপূর্ণভাবে কাজ করে। অনেক দেশে আর্থিক বাজারগুলোতে সীমিত প্রবেশাধিকার থাকে। এ ধরনের বাজার অসম্পূর্ণতা এবং ভারসাম্যপূর্ণ পারিশ্রমিক অর্থনীতি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আইএমএফ সরকারি অর্থায়নের ন্যায্যতা প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানটি বিকল্প অর্থের যোগান দেয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর তিনটি প্রধান কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মুদ্রা বিনিময়মূল্য তত্ত্বাবধান করা। যার মাধ্যমে দেশগুলো তাদের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। সদস্য দেশগুলোর আর্থিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সদস্য দেশগুলোর অর্থেই প্রতিষ্ঠিত। এ প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরই উপার্জিত টাকা বা অর্থ। তবে ঋণদানে কতগুলো শর্ত থাকে। এই শর্তগুলো একেক দেশের জন্য একেকরকম। সময়ের ব্যবধানে শর্তের ধরনও পাল্টে যায়। বোর্ড অব গভর্নর এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। আইএমএফ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ প্রদান করে না।

বাংলাদেশ এর সদস্য হলেও কোনো ভোটিং ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ এর আগেও আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল। কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি। ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফ অনেক কঠিন শর্ত আরোপ করে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটানোর জন্য কঠিন শর্তগুলো মেনেই ঋণ গ্রহণ করতে হয়। শর্তগুলোর কারণে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। এর আগে আইএমএফের পরামর্শে ভ্যাট আরোপ করেছে সরকার। জ¦ালানি তেল-গ্যাস-সারের দাম বাড়ানো হয় তাদের পরামর্শেই। তারপরও ঋণ নিতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফের ঋণ কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার হয়। যথার্থভাবে এর সদ্ব্যবহার করতে পারলে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।

কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ রেখে কার্যক্রম চালাতে হবে তার যথার্থতা নিরূপণে ব্যর্থ হলে চলবে না। আইএমএফের টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তবে রিজার্ভে হাত দিতে হবে না। যে কোনো দেশের জন্য রিজার্ভ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ শূন্য হলে সে রাষ্ট্র দেউলিয়া হতে পারে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই খেটে খাওয়া। গুটিকয়েক চরিত্রহীন মানব রাক্ষসের খপ্পরে পড়ে অনেক সময় নেমে আসে বিপর্যয়। বর্তমানে বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি খুব আলোচিত। যারা টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি তৈরি করেছে এবং স্ত্রী-পুত্র পাঠিয়ে দিয়েছে তারা অচেনা কেউ নয়। পাচারকৃত টাকাটা যদি ফেরত আনা যায় তাহলে সমস্যার অনেকটাই মিটে যায়।
আগামীতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মানুষের পেটে যখন খাবার না থাকে তখন মানুষ আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না। অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে টাকা রোজগারে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দিতে যে কোনো অন্যায় করতেও সে দ্বিধা করে না। সুতরাং বাংলাদেশের উর্বর ভূমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। এখনো অসংখ্য জমি পতিত পড়ে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর খাস জমি রয়েছে, যেখানে ইচ্ছা করলেই ফসল উৎপাদন করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা সে কথাটিই বলছেন বারবার। সরকারি কর্মকর্তাদের চুরিচামারি, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার পথ রুদ্ধ করতে হবে। যেসব বিত্তবান অতিমাত্রায় বিলাসী জীবনযাপন করেন তাদের রাশ টেনে ধরে সামাজিক বৈষম্য দূর করা জরুরি। পৃথিবীতে কেন অভাব থাকবে? ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে পারলেই সমস্যা থাকবে না। বিশ্বের ধনবানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বার্থহীনভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারেন। এই দুঃসময়ে তাদের মতৈক্য দরকার। বিশে^র বিলিয়নিয়ারদের বেহিসাবী জীবনধারার জন্যই বর্তমানের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর জন্য কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এককভাবে দায়ী নয়। বিশ^ অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার পেছনে দুশ্চারিত্রিক আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদেরও দায় রয়েছে। তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×