জ্বালানি তেল এক অত্যাবশ্যক নিত্যপণ্য
জ্বালানি তেল এক অত্যাবশ্যক নিত্যপণ্য। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রাণশক্তি, অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এ কারণেই দৈনিক ১০ কোটি ব্যারেলের বেশি তেল বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যত্র পরিবহন করা হয়। বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটের দুঃসময় পার করছে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাসাবাড়ি। বেশিরভাগ সময় গ্যাস ও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়, বাড়ছে উৎপাদন খরচ, আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার।
দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান টেক্সটাইল এবং পোশাক শিল্প প্রধানত গ্যাস ও বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে ৬০ শতাংশ ঝুঁকির মধ্যে এবং অন্যান্য শিল্প খাতে উৎপাদন ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই হুমকির মুখে পড়েছে ১ কোটি ৬০ হাজার ডলারের বিনিয়োগ। সংকটের কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের গলদঘর্ম অবস্থা।
গত কয়েক মাস ধরে জ্বালানির যে সংকট চলছে তা অব্যাহত থাকলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। ফলে রপ্তানিতে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। এতে আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা দেখা দেবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বছরে মোট ৯৯৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, যার ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, ১৫ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ার শিল্প, ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি, ৫ শতাংশ সার-কারখানায়, ৪ শতাংশ সিএনজি, ১ শতাংশ বাণিজ্যিক এবং দশমিক ১০ শতাংশ ব্যবহার হয় চা বাগানে।
ব্যবহৃত এসব জ্বালানির ৮০ শতাংশের বেশি সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিদেশী যেসব কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয় সেগুলো হলো- সৌদি আরবের সৌদি আরাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো), সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এডিএনওসি), কুয়েতের কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (কেপিসি), পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিসিএল) মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমিরাত জাতীয় তেল কোম্পানি (ইঙ্ক), চীনের পেট্রোচায়না (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড এবং ইউনিপেক (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকু (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড, ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল)।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন প্রধান এবং সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান, যা পেট্রোবাংলা কর্তৃক পরিচালিত। এ সংস্থার অধীনে আছে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী, মেঘনা, কামতা এবং সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র। এগুলো থেকে মোট ২০.২% গ্যাস উৎপন্ন হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ৬২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাসের মাধ্যমে। এর মধ্যে স্থানীয় আবিষ্কৃত গ্যাসের মাধ্যমে পূরণ হয় ৫০ শতাংশ। আর এলএনজির মাধ্যমে হয় ১২ শতাংশ।
সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ৬০ শতাংশ তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সেজন্য চলতি বছর বিদ্যুতের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিদ্যুতের দাম গত পাঁচ বছরের তুলনায় গড়ে ৭৫ শতাংশ বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান কয়লা ও মার্কিন প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম প্রায় চারগুণ বেশি হতে পারে (সূত্রÑবিশ্বব্যাংক)। এসবের প্রথম ধাক্কা পড়েছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ফলে দেশে শিল্প,-কলকারখানা, খাদ্য, এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্যাসের ওপর একক নির্ভরতায় জ্বালানি নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের সংকট এমন আকার ধারণ করেছে যে, পাইপলাইনের গ্যাসের আশা ছেড়ে দিয়ে বাসাবাড়িতেও রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আছে আনুমানিক ১২.৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। যা হয়তো আগামী ১০ বছর চলবে। আছে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির প্রবণতাও। এমতাবস্থায় দেশে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় জুলাই মাস থেকে চলছে লোডশেডিং। আবার উচ্চমূল্যের কারণে গত আগস্ট মাস থেকে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনাও বন্ধ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে এলএনজি আমদানির দ্বিগুণ। এখনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার এবং ওমান থেকে এলএনজি কেনা অব্যাহত আছে, যেখান থেকে বছরে প্রায় চার মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানি হয়। কাতারের সঙ্গে এই চুক্তি শেষ হবে ২০৩২ সালে। ওমানের সঙ্গে ২০২৯ সালে।
চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠতে আরব বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের কাছে অন্তত ১২টি খাতে সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। সে লক্ষ্যে ৩০-৩১ অক্টোবর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ১৪তম জেসি বৈঠকে ‘জ্বালানি সহায়তা ফ্রেমওয়ার্ক’-এর আওতায় বেশ কয়েকটি প্রকল্পের চুক্তির সম্ভাবনা আছে।
সেগুলো হলো- পেট্রোবাংলার সঙ্গে এলএনজি আমদানি চুক্তি, ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে কারিগরি সহায়তা, মাতারবাড়ী দ্বিতীয় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সোলার ও উপকূলে বায়ু বিদ্যুতে সহায়তা ইত্যাদি। ডেনিস সরকারও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করতে এ বছরের এপ্রিলে ’সাসটেইনেবল অ্যান্ড গ্রিন ফ্রেমওয়ার্ক এনগেজমেন্ট’ শীর্ষক চুক্তি করেছে।
যেখানে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরির সম্ভাবনা। বিশ্বে ব্যবহৃত মোট জ্বালানির ১৬% আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে।
সফলভাবে উপরোক্ত চুক্তি সম্পাদিত হলে প্রথমে যা করতে হবে তা হলো এক. বিদেশ থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করা দুই. নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করা। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের যে ২৬টি ব্লক রয়েছে- সেগুলোর ১৩টি অগভীর সমুদ্রে এবং ১৩টি গভীর সমুদ্রে। ২০১৩ সালে ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হলেও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের অনুসন্ধান চালানো হয়নি।
অথচ মিয়ানমার বেশ দ্রুততার সঙ্গেই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। যা হোক, গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দেশী এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে জরিপ করে কোথায় কোথায় গ্যাসক্ষেত্র আছে তার একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মিয়ানমারে কাছে সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি।
এছাড়া সাশ্রয়ী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত উদ্যোগ নিতে হবে– এক. দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপকভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব কয়লার ব্যবহার বাড়ানো, তিন. প্রযুক্তিভিত্তিক সাশ্রয়ী জ্বালানি কৌশল অবলম্বন করা, চার. শিল্প-কারখানায় কয়লা, এলপিজি, বায়োগ্যাসের ব্যবহার কমানো, পাঁচ. সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো, ছয়. স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয়ে প্রাইভেট কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া, সাত. ইপিজেডের কারখানাগুলোর ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহজতর পন্থা অবলম্বন করা, আট. সিস্টেম লসসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, নয়. গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা এবং পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া, দশ. ফ্রিজ, এসি এবং অপ্রয়োজনে লাইট ফ্যান বন্ধ রাখা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ২৮ লাখ ইউনিট শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে এবং শুধু ঢাকাতেই প্রতিবছর ২০ শতাংশ করে এসির ব্যবহার বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব, বিশেষ করে ইউরোপও নিজস্ব সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘জেইটেনওয়েন্ড’ বা ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র দিকে নজর দিচ্ছে। এলএনজি এবং পর্যাপ্ত গ্যাসের মজুদ ও সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে জার্মান সরকার। গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সচলে ব্যস্ত তারা।
ইউরোপের অন্যান্য দেশও একই পন্থায় এগোচ্ছে। ফ্রান্স ছয়টি নতুন পরমাণু চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছে ব্রিটিশ সরকার। আরও তেল, গ্যাস ও কয়লার সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার খনিতেও কাজ করবে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ। ইসরাইল ও মিসরের সমুদ্রসীমায় থাকা বিপুল মজুদের পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাসক্ষেত্রও আছে তাদের নজরে। দূষণহীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি মজুদে জোর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নতুন উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়েও মনোযোগী হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব।
স্পেনে সরকারি কর্মচারীদের এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার না করে যতটা সম্ভব বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে সরকার। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে ৮০ লাখ নাগরিককে দিনে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ইতালি, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানগুলোকে দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশ আছে। অমান্য করলে ৭৫০ ইউরো জরিমানার বিধান আছে।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়