ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে করণীয়

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:২৩, ২৫ অক্টোবর ২০২২; আপডেট: ১৩:০৯, ২৬ অক্টোবর ২০২২

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে করণীয়

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার দিবাগত অর্ধরাতে আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশে এর আগে ২০২২ সালের ১১ মে থেকে অনেকদিন পর্যন্ত ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বিপর্যস্ত হয়েছে সিলেট। সিলেটের প্রায় অধিকাংশ এলাকা তখন পানিতে তলিয়ে যায়। ১৯৮৮, ১৯৯৮ বা ২০০৪ সালের বন্যার মতো অবস্থা হয়নি। তারপরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবারের বন্যায় সিলেট জেলার অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীসহ অন্যান্য নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি পয়েন্টেই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সিলেটে বন্যার পেছনে কারণ- সিলেটে সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। যে কারণে নদী তার নাব্য হারিয়ে ফেলছে।

ফলে পানি তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ফেলছে। অর্থাৎ একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায় এলাকায়। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে সিলেটসহ অনেক জেলায় বন্যা হয়। সিলেটে বন্যায় প্রায় ২৩০ জন লোক মারা যায়। কয়েক হাজার গবাদিপশুও মারা যায়। বন্যায় আর্থিক ক্ষতি হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা।  প্রায় ৪১ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যায় সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অনেক কালভার্ট ভেঙে যায়, যা পুনরায় মেরামত করতে হবে।

আগামী বর্ষায় পানি যেন শহরে ঢুকতে না পারে সেজন্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। সেজন্য দেশের অভ্যন্তরে যেসব নদী রয়েছে সেসব নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি নদী ড্রেজিং করতে হবে। নদী যদি তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসতে পারে তাহলে বন্যার পানি সহজে সড়ক বা স্থলপথ থেকে নেমে যাবে। যা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে রাখবে ব্যাপক ভূমিকা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় পটুয়াখালী, বরগুনা এবং বাগেরহাট জেলায়। যা নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি। কি যে করুণ অবস্থা ছিল তখন। বাড়িঘর পানিতে ডুবে যায়। তখন কয়েক হাজার লোক মারা যায়। শুধু বরগুনায় মারা যায় ১ হাজার ৩৪৫ জন। সিডরে ছিল ৮ নম্বর সতর্ক সংকেত। সিডরে দেশের প্রায় ৬ লাখ টন ধান এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। প্রায় দুই লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে আর্থিক মূল্যে ৫৩৬ কোটি  ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়। ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে আর্থিক মূল্যে ২৬৩ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সুন্দরবনে।
ইউএনডিপির হিসাব অনুযায়ী ১৯৮০-২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ২১৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। এতে ১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তো মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনহানি, সম্পদহানিসহ আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারি।
এবারও ঘূর্নিঝড় সিত্রাং-এর কারণে দেশের উপকূলের অন্তত ১৫টি জেলা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এক্ষেত্রে মংলা এবং পায়রা বন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত ছিল। যা দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জন্য চরম হুমকি। হুমকি মোকাবিলায় সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর সময় অমাবস্যা থাকায় জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৮ ফুট পর্যন্ত হয়েছে। তবে এর আঘাতে অন্তত ৯টি তাজা প্রাণ আমরা হারিয়েছি। যা খুবই বেদনাদায়ক।

দেশে ২০১৯-২০২২ পর্যন্ত যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার প্রতিটিতেই দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফণী, আম্পান, ইয়াস, বুলবুল ইত্যাদি। এসব ঝড়ে যেমন প্রাণহানি ঘটছে, তেমনি ফসলের ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত সোমবার আঘাত হেনেছে সিত্রাং। সিত্রাং-এ ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এই ঝড়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত তা এখনো জানা যায়নি। তবে অঙ্কের হিসাবে অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং হবেও।

যেহেতু গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তাই দুর্যোগ প্রতিরোধে সরকারকে সঠিক এবং  দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। এর মধ্যে অসময়ে ঘূর্ণিঝড়। এটা দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।  
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় আরও যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ক্ষতি কম হয়। সরকারের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। ৬০-এর দশকের উপকূলীয় বাঁধের পরিকল্পনা আজ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের গলার ফাঁস। ঘূর্ণিঝড় ও উচ্চ জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে বারবার মানুষ তার সহায়সম্বল হারাচ্ছে এবং মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের অভিঘাত মোকাবিলায় স্থায়ী ও মজবুত বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। সরকার উপকূলীয় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দুটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু এখনো সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়নি। জনস্বার্থে দ্রুত ওই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে হবে। উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জীবন-জীবিকা রক্ষায় সরকারের নেয়া অন্যান্য প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন দিতে হবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিশ্চিত করতে হবে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।
প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উত্তরাঞ্চলে বোরো ধান এবং দক্ষিণাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যায় আমন ধান। ক্ষতি অপরিমেয়। এ দায় কার? পানি উন্নয়ন বোর্ড  এ দায়ভার এড়াতে পারে না। এক্ষেত্রে ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করার বিকল্প নেই। ডেল্টা প্লান সম্ভবত কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। করোনা পরবর্তী বিশ্বে নিজেদের খাদ্যপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেই টিকে থাকতে হবে। যত বেশি পণ্য উৎপাদন হবে ততবেশি পণ্য রপ্তানি বাড়বে এবং আমদানি কমবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। দেশপ্রেমিক যোগ্য প্রতিনিধিত্ব দরকার সকল সেক্টরে। উপকূলীয় ও হাওড় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে কেউ দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় সামান্য দুর্যোগের কারণেও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। তখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া সরকারের আর করার কিছুই থাকে না। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় এবং উপকূলের সার্বিক উন্নয়নে আগামী জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের পাশাপাশি উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা সুরক্ষায় বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×