.
মেয়েটা ঢাকায় নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরছে। তাকে নেয়ার জন্য আনিস রাত সাড়ে ৯টায় স্টেশনে পৌঁছে। ৯টা চল্লিশে আসার কথা থাকলেও রাত দশটার আগে ট্রেনটি স্টেশনে আসে না। রফিক মেয়ের আগমনের অপেক্ষায় এক নম্বর প্লাটফর্মে টাইলস করা আসনে বসে আছে। আগস্টের শুক্রবার। স্টেশনে তেমন ভিড় নেই। একাকী বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। হঠাৎ স্টেশনে ঘটা একটি ঘটনার স্মৃতি-তাড়িত হয়। এ মাসেই ওয়েটিংরুমের কাছে ঘটেছিল ঘটনাটি। সেই পুরনো কংক্রিটের বেঞ্চ এখন আর নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন এসেছে অনেক কিছুতেই।
সেই রাতে ওরা কেন এতটা নির্মম আচরণ করেছিল, তখন বুঝতে পারেনি আনিস। বুঝেছে পরে। সদ্য সৃষ্টি হওয়া এই ভুবনের আকাশ থেকে আলো ছড়ানো উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির পতন ঘটানোর গভীর ষড়যন্ত্র চলছিল সেনা ঘাঁটিতে। কতিপয় বিপথগামী সেনা অফিসারের নেতৃত্বে দেশের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। তিনি কি শুধু ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন? ছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের স্থপতি এবং জাতির পিতা। সিআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কি বিপথগাদীদের এতটা সাহসী করে তুলেছিল?
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নক্ষত্র-পতন ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে এই ভুবনে নামে কালো অন্ধকার। পরদিন আতঙ্কের ছায়া নেমেছে চারদিকে। থমথমে পরিবেশ। তখন ময়মনসিংহ শহরে আত্মীয় বাড়িতে অবস্থান করছে আমজাদ। রফিক তার শহরতলীর লজিং বাড়িতে। দেশের এমন ভয়াল পরিস্থিতিতে রাতের ট্রেনেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয় আমজাদ ও সহপাঠী রফিক।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে পিনপতন নীরবতা। সারিবদ্ধ মিলিটারি ময়মনসিংহ জং-স্টেশনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সতর্ক টহল দিচ্ছে। ভয়ার্ত রাতের স্টেশন প্রায় জনশূন্য। মাঝে মধ্যে রেল ইঞ্জিনের দানবীয় হুঙ্কার সামগ্রিক পরিবেশকে আরও ভীতিকর করে তুলছে। রফিক ও আমজাদ শেষ রাতের ট্রেনে বাড়ি ফেরার জন্য স্টেশনে এসেছে। কংক্রিটের বেঞ্চে হেলান দিয়ে ট্রেনের প্রতীক্ষা করছে রফিক। আমজাদ ঠাঁই নিয়েছে বিশ্রামাগারে। রাত আরও গভীর হয়।
গভীর রাতে ঘুমের ছোঁয়া রফিককে ক্রমশ তন্দ্রালোকে নিয়ে যায়। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে মাথার লম্বা চুলে কঠিন হাতের হিংস্র থাবা। আচম্বি^ৎ চোখ খুলে দেখে, চুল ধরে তাকে শূন্যে টেনে তুলছে একজন মিলিটারি। পায়ের পাতা দুটো কোনরকমে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে বলে, শালা মুজিববাদ করিস, বন্ধুকের নলটা পাছা দিয়ে ... ইত্যাদি।
কিছু বুঝার আগেই ঘাড়ের উপর ধরাস করে বাটের প্রচ- আঘাত করার জন্য উঁচিয়ে ধরে উদ্যত রাইফেল। করুণ আর্তনাদ করে রফিক হয়তো বা ঢলে পড়বে কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর। প্রতিক্রিয়ায় অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাবের ক্ষীণ স্রোতধারা দু’পা বেয়ে গড়িয়ে স্টেশনের মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। অভাবিত এ ঘটনায় রফিক বেঁচে যায়। কী আর বয়স রফিকের। পনেরো বা ষোলো।
ভয়ার্ত কিশোর রফিকের পেশাবকা- দেখে রাইফেলের বাটের আঘাতটি আর করেনি। কিছুক্ষণ পর ঘোর কাটলে রফিক দেখল, টহল দলটি ততক্ষণে সামনে অনেকটা দূরে চলে গেছে। প্রায় প্লাটফরমের পূর্বপ্রান্তে...। ঘাড়ের চুলে হ্যাঁচকা টানের যন্ত্রণায় কাতর রফিক আত্মধিক্কারে মনে মনে বলল, জাতির জনক যেখানে সপরিবারে অরক্ষিত অবস্থায় নিহত হয়, সেখানে জনজীবনের নিরাপত্তা আসবে কী করে?
রফিক বেঞ্চে বসে মাথা ঘুরিয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমের দিকে তাকায়। ওদিকে চোখ ফেরাতেই ওয়েটিং রুমের দরজার আড়াল থেকে তাকে ডাকল কিশোর বন্ধু আমজাদ। বিপদ আঁচ করে বিশ্রামাগারে লুকিয়েছিল। রফিকের উপর নির্যাতনের দৃশ্যটা ওয়েটিং রুমের জানালাা পথে আড়িপেতে দেখেছে আমজাদ। রাইফেলের উদ্যত বাটের আঘাতের ভয়ে সেও আৎকে উঠেছিল। আগেই রফিককে ওদের দৃষ্টির গোচরে যেতে বারণ করেছিল আমজাদ। রফিক কথা শুনেনি। কারণ, রফিকের ধারণা, তার তো কোন অপরাধ নেই। নেই কোন পাপ। রফিক ভাবে যে, নিরপরাধ হয়েও তাকে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
আমজাদের হাতের ইশারায় এবং চাপাস্বরে বেপরোয়া ডাকা-ডাকিতে রফিক উঠতে চেয়েও উঠে না। ভাবে, কোথাও গিয়ে লুকালে যদি আবার ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। রফিকের সংশয়ের জট খোলার আগেই আমজাদ ছুটে এসে তার পাশে বসে। চারদিকে তাকিয়ে টহলরত মিলিটারির অবস্থান লাখ করে এক ফাঁকে তড়িঘড়ি রফিকের বাহু ধরে টেনে ওয়েটিংরুমে নিয়ে যায়। বিশ্রমাগারে ঢুকেই বলে, আগেই না করছিলাম, ওগর সামনে পড়িস না। অহন ক্যামন অইল?
শেষরাতে মিলিটারির নজর এড়িয়ে ঝারিয়ার ট্রেনে উঠে ওরা। ট্রেনটা সময়মতই ছাড়ল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ওরা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ভোর বেলায় ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছল। ট্রেন থেকে নেমে কংস নদী পার হয়ে বিরিশিরির বাসে চাপে।
রফিক কলেজে ভর্তি হবে। তাই শহরতলির একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাসের প্রশংসাপত্র সংগ্রহসহ কোন কলেজে ভর্তি হবেÑসেসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে এসেছিল। বাল্যবন্ধু আমজাদও আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ায় দেশে মুক্তিযুদ্ধের মতো কোন হাঙ্গামা আবার দানা বাঁধতে পারে কিংবা সৃষ্টি হতে পারে অরাজক পরিস্থিতি- এমন আশঙ্কায় ওরা তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরছে।
বাস থেকে বিরিশিরি নামলে সোমেশ^রী নদী। খেয়া নৌকায় নদী পার হয় ওরা। নদীটার জলের অংশ পার হলেই বালুময় কিছুটা পথ। পথটি থানার পাশ দিয়ে দুর্গাপুর বাজারে ঢুকেছে। পাশের রাস্তা ধরে বাজারের দিকে পা বাড়াতেই থানা থেকে কর্কশকণ্ঠে বাজখাই আওয়াজ ছুড়ে বলা হয়, এই- তোমরা সবাই থানায় আস।
অসহায় বাসযাত্রীরা সবাই বাধ্য হয়ে থানায় যেতে থাকে। রফিক অতটা ভাবেনি, যতটা সমস্যা হয়েছে থানায়। পাঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট। থানায় প্রতিটা যাত্রীকে তল্লাশি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভ্রমণ ব্যাগ, পুটলা-পুটলি তালাশ করার পর ওসি সাহেবের কাছে একেক জনকে পাঠানো হচ্ছিল। ওসি সাহেব তার কক্ষে বসে রুক্ষ মেজাজে সাপের জিহ্বার মতো লিকলিকে বেত উঁচিয়ে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল প্রত্যেককে। ওসি সাহেবের জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে নানা ধরনের ধমকে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ভয়ে তটস্থ। ওদের দুজনের মধ্যে রফিকের আগে আমজাদই প্রথমে ওসি সাহেবের কক্ষে ঢুকে।
ওসি সাহেবের লক্ষ্য উঠতি বয়সের তরুণদের প্রতি। হয়ত বা ওপর থেকে নির্দেশ ছিল, সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে দেশের কোন তরুণ যেন ভারতে ঢুকতে না পারে। আমজাদ এবং রফিক সে বিবেচনায় তরুণ না হলেও উত্তীর্ণ কিশোর। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে প্রায় দশ মিনিট পর অনেকটা বিধ্বস্ত অবস্থায় আমজাদ ফিরে আসে।
এবার রফিকের পালা। রফিক ভয়ে ভয়ে ওসি সাহেবের কক্ষে ঢুকে। অমনি কর্কশ ভাষায় চিৎকার করে রফিকের প্রতি প্রশ্নবান ছোড়া হয়, এই কোথা থেকে এসেছিস, বাড়ি কোথায়?
রফিক জবাব দেয়। ফের ওসির প্রশ্ন, কেন গিয়েছিলি?
ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নবানে তাকেও জর্জরিত করা হয়। রফিক বিনয়ের সঙ্গে সবগুলো প্রশ্নের জবাব দেয়। ওসি সাহেব তাতেও সন্তুষ্ট নন। উঠতি কিশোর রফিক। তাই তাকে নিয়ে সন্দেহপ্রবণ ওসি জিজ্ঞেস করে, এখানে-এই দুর্গাপুর বাজারে কী তোর পরিচিত কেউ আছে?
জি, সাবেক ওসি সালাম সাহেবের মেয়ের জামাই মিজান আমার পরিচিত।
তার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কী?
জি, একই গ্রামে আমাদের বাড়ি।
রফিকের মনে হল স্টেশনে মিলিটারির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আবার থানায়, এ যেন উত্তপ্ত কড়াই থেকে জলন্ত উনুনে এসে পড়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খনুরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর রফিককে ছাড়া হয়। থানা থেকে রফিককে বাইরে আসতে দেখে আমজাদের চোখে-মুখে থাকা আতঙ্কের ছায়ায় আবার আশার আলো ঝিলিক দেয়। মলিন ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় ক্ষীণ হাসির রেখা। কিন্তু রফিক ভাবলেশহীন। সে কোন কথাই বলে না। কথা বলে না আমজাদও। কিছুক্ষণ পর আমজাদ সরব হয়ে বলে, চল! এখনই বাড়ি রওনা হই।
গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় আরও ত্রিশ হাঁটার পথ তখনও বাকি।