ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

শোকাবহ ১৫ আগস্ট প্রথম প্রতিবাদের গান

ড. বিশ্বজিৎ রায়

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১৪ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২১:১৮, ১৫ আগস্ট ২০২২

শোকাবহ ১৫ আগস্ট প্রথম প্রতিবাদের গান

.

একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে এ লেখাটি লিখবার তাগিদ অনুভব করলাম। বিষয়টি সম্পর্কে আমার মোটামোটিভাবে জানা ছিল। তবুও লেখার পূর্বে দেশের প্রথিতযশা গীতিকার বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের মহাসচিব ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে কিছুটা আলোচনা করে নিলাম।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকা-ের শিকার হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন। ঘটনার আকস্মিকতায় শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে সারা জাতি, স্তম্ভিত বিশ্ববিবেক। এ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে একত্রিত হলেন গণসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ সুখেন্দু চক্রবর্তী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বহুল প্রচারিত হৃদয়স্পর্শী গান ‘হায়রে কিষাণ, তোদেরই শীর্ণ দেহ দেখেযেরে অশ্রু মানে না’- গানের লেখক ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণসঙ্গীতের নিজস্ব ধারা তৈরি ও ভিত্ রচনায় এ দু’জনের রয়েছে বিশেষ অবদান। দেশের যে কোন ক্রান্তিকালে দু’জনের কথা ও সুর আম জনতার চেতনায় ঢেউ জেগেছে। যা হোক দু’জন একমত পোষণ করেন যে হত্যা, দমন, নিষ্পেষণ, কারফিউ এবং জেল-জুলুম দিয়ে বেশিদিন জনগণকে ঘরে আটকানো যাবে না। এ নৃশংসতা এবং সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নতুন প্রেক্ষাপটে কিছু গণসঙ্গীত তৈরি করে রাখবেন। এরই মাঝে ঘটল আর এক নৃশংসতম হত্যাকা-। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। সুখেন্দু চক্রবর্তী এবং ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া তাঁদের চিন্তা ভাবনা নিয়ে মাঝে মাঝে একত্রে বসেন। এরই মাঝে ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক মঞ্জুর আলী নন্তু সুখেন্দু চক্রবর্তীর বাসাবোর বাসায় দেখা করেন। সুখেন্দু চক্রবর্তীকে নিয়ে সোজা চলে আসেন ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়ার মালিবাগের বাসায়। তিনজনে মিলে চলে আসেন প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকে একটি রেস্তোরঁাঁয়। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল আনুমানিক তিনটে হবে। রেস্তোরাঁয় তখন তেমন একটা ভিড় ছিল না। সেখানে বসেই নন্তু প্রস্তাব করলেন নতুন প্রেক্ষাপটে কমপক্ষে পাঁচটি গণসঙ্গীত প্রয়োজন। খুব সহসাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে মিছিলে নামবো। নন্তু আরও জানালেন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে ভেতরে ভেতরে সংঘটিত হচ্ছে। যতই জুলুম আসুক সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই।
সুুখেন্দু চক্রবর্তী বললেন ফেরদৌস, আম জনতার বোধগম্য ভাষায় গান লিখবে। এবং বার্তাটি যেন স্পষ্ট হয়। রেস্তোরাঁয় একটু বেশিক্ষণ বসার জন্য পর্যায়ক্রমে চা-সিঙ্গাড়া, চা-পুড়ি এবং মোগলাই পরোটার অর্ডার দেয়া হলো। রেস্তোরাঁ থেকে চেয়ে কয়েক টুকরা কাগজ নিয়ে ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া প্রথমে লিখলেন- মা হারাইলাম ভাই হারাইলাম পদ্মা হইল লাল/ বর্গী আবার বায়না ধরে পাইত্যা মরণ জাল। অন্তরায় লিখলেন- মায়ের চাইতে মাসির দরদ কালনাগিনীর কাল/ সোনার মাঠে কাইট্টা রাখছে সর্বনাশের খাল/ আবার বর্গী হাসে পিশাচ নাচে ভাঙো তার চোয়াল। সুখেন্দু চক্রবর্তী গানটি হাতে নিয়ে বললেন ঠিক আছে এবং বাকি অন্তরাগুলো লিখ। গান বড় হোক অসুবিধা নেই। ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া বললেন দাদা সব অন্তরার সুরতো একই রকম হবে। আপনি মনে মনে সুর করতে থাকুন। আমি বরং আর একটি গান লিখি।
একটু চিন্তা ভাবনা করে এবার ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া লিখলেন- এই পৃথিবীটা যদি বদলে যেতো/ গল্পের মতো সব সত্যি হতো/ মিথ্যেটা আজ যদি অক্কা পেতো/ এক ঝাঁক পায়রায় শিবির হতো।। প্রথম অন্তরা লিখলেন এ ভাবে- যদি যুগ হতো জীবনের কাব্য তিথি/ পাল তোলা নৌকার স্বপ্ন গীতি/ যদি দম্ভের দ্বন্দের দুর্গগুলো বজ্রের ধমকে চূর্ণ হতো। সুখেন্দু চক্রবর্তী হেসে বললেন ঠিকই আছে। কৌশল করে নৌকার কথাও লিখেছ। এই বৈরী পরিবেশে এতটুকুও কম নয়। ঠিক আছে আজকের মতো তাহলে উঠি চলো। রাতে বাকি অন্তরাগুলো লিখে রেখো। আগামী দিন সকাল এগারটার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে চলে এসো। এবার নন্তু বললেন দাদা আমি কিন্তু দুদিনের মধ্যে রিহার্সেল শুরু করতে চাই। সেদিনের মতো তিনজন উঠে গেলেন।
পরের দিন ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের কার্যালয়ে সুখেন্দু চক্রবর্তীর হাতে দুটো গানের বাকি অন্তরাগুলো তোলে দিলেন। খুশি হয়ে সুখেন্দু চক্রবর্তী বললেন একদম ঠিক আছে। আমি কিন্তু গানের সুর করে ফেলেছি। এবার তুমি ‘ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাঘডাসে’- এ বহু প্রচলিত প্রবচন নিয়ে একটি গান লিখতে পারো কিনা দেখো।
বাসায় ফিরে এবার ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া লিখলেন- ‘ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাঘ ডাসে।’ প্রথম অন্তরায় লিখলেন- এক দেশেরই গরিব চাষি কালা মিয়া নাম/ সবার মুখে ভাত যোগাইতে ক্ষেতে ঝরায় ঘাম/ ও তার ছাওয়াল কান্দে ক্ষুধার জ্বালায় মহাজনরা হাসে।। পাঁচটি অন্তরায় সাজানো এ গানে তিনি কৃষক-শ্রমিক, তাঁতী বিভিন্ন শ্রেণীর দুর্দশা তোলে ধরে শেষ অন্তরায় লিখলেন- চারদিকে মিছার দম্ভ মিছারই বড়াই/ সেই মিছা সমাজ ভাঙতে মোরা করবোরো লড়াই/ রাইতের আন্দার না কাটিলে/ সুরুয কি আর হাসে।
চতুর্থ গানটি লিখলেন- অন্ধকার থেকে আলোর পৃথিবী/ হাতছানিতে ঐ ডাকছে/ বিলাসের মরীচিকা, হতাশার শৃঙ্খল/ আমায় শুধু পিছু টানছে।। প্রথম অন্তরায় লিখলেন- পথে পথ ভুল হলে/ থামবার মানে নেই/ ঠিকানাতো জানা আছে মুক্ত সীমানা মিলবেই/ একই কেন্দ্রিক ভাবনায় ধ্বংসের জাল শুধু বুনছে।
যথাসময়ে সুখেন্দু চক্রবর্তীর হাতে গান তোলে দিলেন। সুখেন্দু চক্রবর্তী বাণীর প্রতি দৃষ্টি রেখে গানগুলো সুর করে ফেললেন।
স্মৃতি থেকে ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া যদ্দূর মনে করতে পারলেন ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে মঞ্জুর আলী নন্তু রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হল ও চারুকলা ইনস্টিটিউট ও উদীচী থেকে প্রায় দশ-পনেরো জন শিল্পী নিয়ে রিহার্সেল আয়োজন করলেন। রিহার্সেল শুরু হলো কার্জন হলে মূল বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে। শিল্পীদের মাঝে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং চেতনায় টগবগ করছে। কয়েকজন শিল্পীর নাম মনে পড়ে সিরাজুস সালেকীন, দুলাল ভৌমিক, শংকর শাওজাল, ছন্দা হাজরা এমন আরও অনেকে। সুখেন্দু চক্রবর্তী এক একটি করে গান তোলে দিচ্ছেন। শিল্পীদের চোখে মুখে অগ্নি। পারলে তখনই হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে মিছিলে নেমে পড়ে।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন চত্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীরা যখন এ গণসঙ্গীতগুলো গেয়ে ওঠেন তখন এক অভূতপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও হাততালি দিয়ে গাইতে থাকেন ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাঘডাসে। দাবানলের মতো গানগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে।
একই বছরে ডিম পারে হাঁসে খায় বাঘডাসে গান ও গানের ভাবার্থ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সম্মেলন কেন্দ্রে সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে একটি বেলে ড্রামা পরিবেশন করা হয়।
উল্লিখিত গানগুলোর পুরো অংশ তোলে ধরতে পারলাম না। গানগুলোর প্রতি ছত্রে ছত্রে ছিল নৃশংসতা, অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রচ- দ্রোহ ও ক্ষোভ। সেদিনের সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের গান লেখা ও সুর পরিবেশন করা যেমন ছিল দুঃসাহসের পরিচয় তেমনি ছিল ঝুঁকি। জাতির প্রয়োজনে শিল্পী সমাজ এ ধরনের ঝুঁকি সব সময়ই নিয়েছে।
জাতির সে ক্রান্তিকালে রচিত সে গানগুলো শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সভামঞ্চে আজও গাওয়া হয়। কিন্তু নতুন প্রজন্ম জানে না এর নেপথ্য কাহিনী। ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে রচিত এ গানগুলো নৃশংসতা, অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকবে।    

 

 

 

সম্পর্কিত বিষয়:

×