ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

শোক ও শক্তির উৎস

সেলিনা হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ১৪ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২১:১৬, ১৫ আগস্ট ২০২২

শোক ও শক্তির উৎস

.

বাঙালী, বাঙালীত্বের নির্যাসে যুক্ত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উচ্চারণ ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’ এই উচ্চারণের সঙ্গে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বাঙালীকে উজ্জীবিত করে বাঙালীত্বের গৌরবকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই সময়ে তার মৃত্যু বিশ্বজোড়া বাঙালীর সামনে শুধু শোকের দিন নয়। গৌরব এবং মর্যাদার জায়গা থেকে তিনি বাঙালীর সামনে মৃত্যুহীন মানুষ। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখন্ড নানা নামে পরিচিত হয়েছিল। বলা হতো বঙ্গ-পুন্ডসূক্ষ্ম-গঙ্গাঋদ্ধি-বজ্রভূমি-বরেন্দ্র-প্রাক-জ্যোতিষপুর সমতট-হরিকেল-তাম্রলিপ্ত চন্দ্রদ্বীপ-রাঢ়-গৌড়-বাগঢ়ী ইত্যাদি নাম ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের। ইতিহাসবিদ মহম্মদ আমীর হোসেন তার ‘বঙ্গ বঙ্গাল-বাঙ্গালা বাঙালী বিনির্মিত নির্মাণ বইয়ে বলেছেন, পাল ও সেন বংশের শাসনকালে বর্তমানের বাঙ্গলা অঞ্চল সাধারণভাবে গৌড় বলেই পরিচিত হয়েছে। আর ওই বর্ণহিন্দু সমাজ সাধারণভাবে নিজেদের ‘গৌড়জন বা ‘গৌড়বাসী’ বলেই চিহ্নিত করতে চেয়েছে স্থানবাচক জাতিত্ব পরিচিতির বিষয়ে। বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি তার এই ব্যাকরণের নামকরণ করেন ‘গৌড়ীর ব্যাকরণ’। বাঙালী, বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেই বাঙালী শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদরা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার বিচারে বাঙালী জাতি একই নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার বংশধর নয়। বাঙালী একটি সংকর জাতি।

একাধিক নৃগোষ্ঠী ও রক্তের সংমিশ্রণে বর্তমানের বাঙালী জাতির (Race) উৎপত্তি। ইতিহাসবিদরা আরও বলেছেন, ‘এই জাতিসত্তার মানুষরা মূলত পূর্ববঙ্গীয় ভূমিপুত্র।’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘বাঙ্গাল’ শব্দের অর্থ হিসেবে লিখেছেন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী। বাঙালীর পরিচয় খুঁটিয়ে দেখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে এটা সত্য যে, সে সময়ের পূর্ববঙ্গ আজকের বাংলাদেশ। যে বাঙালী সংকর জাতি হিসেবে অবজ্ঞাত ছিল তার পরিচয়ের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙালী। আজ আমি বলতে পারি, বাঙালী একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি, বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই।’ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘গৌড় নাম লইয়া বাংলার সমস্ত জনপদগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয়নি। সেই সৌভাগ্য লাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত এবং যে বঙ্গ-নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই; তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হইল। ইংরোজ আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, যদিও আজিকার বাংলাদেশ আকবরী সুবা বাংলা অপেক্ষা খর্বীকৃত।’
বিশ্বজুড়ে বাংলার যে পরিচিতি সেই অর্থে এই ভূখন্ডকে শুধু ভৌগোলিক আকারে খর্বীকৃত বলার সুযোগ নেই। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অপেক্ষায় সময়ের পরিসর অতিক্রম করেছে। তিনিই উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যিনি উপমহাদেশের মানচিত্রে একটি স্বাধীন। রাষ্ট্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এই অর্জনে নিজেদের নিবেদন করেছেন বীরদর্পে। মানুষের ভালবাসার অবিস্মরণীয় চেতনাবোধে সিক্ত হয়েছে তার নেতৃত্বের দৃঢ়তা। তার মৃত্যুদিবস মৃত্যুর উর্ধে জীবনসত্যের বড় পরিচয়। বিশ্বের অনেক নেতা যেভাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আছেন অজেয় প্রেরণায় তেমনি বঙ্গবন্ধু আছেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি পরিচয়ের মুগ্ধতা নিয়ে বলেন, আমার হিমালয় দেখা হয়নি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে এই মানুষটিই হিমালয়সম। এতেই আমার হিমালয় দেখা হলো। এভাবে বাংলাদেশ নামের ছোট ভূখন্ড বিশ্বের সামনে বিশাল হয়ে উঠেছিল। শুধু ভৌগোলিক আকারের খর্বতা কাটিয়ে উচ্চতার শীর্ষে ওঠার যে দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধু সেই অসাধ্য কাজটি পূর্ণ করেছিলেন। বিশ্বের অন্য অনেক নেতার মতো তিনি দেশের পরিচিতি বিস্তৃত করেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, হো চি মিনের নামের সঙ্গে ভিয়েতনাম, সুকর্নের নামের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মিসরের সঙ্গে কর্নেল নাসের, প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইয়াসির আরাফাত এমন আরও অনেকে। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান। তার নাম উচ্চারণ না করে বাঙালীর আত্মপরিচয় কখনও পূর্ণ হবে না।
এই সূত্র ধরে উল্লেখ করতে হয়, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর মননশীল চিন্তা। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বলেছিলেন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দুহাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। আমাদের সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মর্যাদাকে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন : ‘আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনভাবে কোন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করেছি, এখন করছি, ভবিষ্যতে যা কিছু করব জনগণকে নিয়েই করব। সুধী বন্ধুরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদনআমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানেই আবদ্ধ হয়ে না থাকে।

বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দনও তাতে প্রতিফলিত হয়। আজকের সাহিত্য সম্মেলনে যদি এসবের সঠিক মূল্যায়ন হয় তবে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হব।’ বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে নিজের দেশের শিল্প-সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় তিনি পাননি। সেই সময় তিনি পেলে আজকে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য বিদেশে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। এভাবে গণমানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করার কথা বলেছেন। জাতির সাংস্কৃতিক বোধে মনুষ্যত্বের বোধকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তাও উচ্চারণ করেছেন তিনি। বিশ্বজোড়া মানুষের শান্তিতে থাকার স্বপ্নও ছিল তার মধ্যে। ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন। নিজের মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি বাঙালী জাতিসত্তার দিগন্ত প্রসারিত করেছিলেন। অন্যদিকে বিশ্বের মানুষের জন্য শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। উদ্ধৃতি : ‘জনাব সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালী জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য বাঙালী জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সক্ষী ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালী জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তার মৃত্যুদিবস শারীরিক মৃত্যুর সত্য। ইতিহাসে তিনি মৃত্যুহীন অমর মানুষ। তার জন্ম না হলে বাঙালীর হাজার বছরের উপেক্ষার জায়গাটি প্রশমিত হতো না।

বাঙালী বিশ্বজুড়ে বাঙালী হয়ে উঠতে পারত না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুহীন জন্মদিন বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট বাঁকবদলের ইতিহাস। স্বাধীনসার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের খর্বীকৃত ভূখ- নয়। বিশ্বের মানচিত্রে অবিনাশী নাম- উচ্চতায় বিশ্ববাসীর সামনে মাথা তুলেছে। বিশ্বের সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের সঙ্গে তিনি বাঙালী জাতিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন। এই প্রতিশ্রুতি থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন-নিপীড়ন-গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে বাঙালীর এগিয়ে চলার পথপ্রদর্শক হিসেবে অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানবতার বার্তাটি ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সামনে থেকে মুছে দেননি। এখানেই বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘের ভাষণের পূর্ণতর রূপ উঠে এসেছে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের দিকে। তাকে বাংলাদেশের সাহিত্যে অনবরত স্মরণ করেছেন দেশের লেখকরা। শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খানের একটি কবিতার নাম ‘মুজিব’। উদ্ধৃতি : সবুজ শ্যামল বনভূমি মাঠ নদীতীর বালুচর সবখানে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘর। সোনার দেশের মাঠে মাঠে ফলে গোনাধান রাশি রাশি। ফসলের হাসি দেখে মনে হয় শেখ মুজিবের হাসি। শিশুর মধুর হাসিতে যখন ভরে বাঙালীর ঘর, মনে হয় যেন শিশু হয়ে হাসে চিরশিশু মুজিবুর। আমরা বাঙালী যুদিন বেঁচে রইব এ বাংলায় স্বাধীন বাংলা ডাকবে : মুজিব আয় ঘরে ফিরে আয়। তিনি বাঙালীর জীবনে হিরন্ময় জ্যোতি। ইতিহাসের পাতায় তার অবস্থান বঙ্গ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা। সংকর বাঙালী তার নেতৃত্বে আজ জাতিসত্তার মর্যাদায় আসীন।

 

 

 

সম্পর্কিত বিষয়:

×