.
বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন ১৫ আগস্ট। এ মাসে আমাদের জীবনে ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা ও ট্র্যাজেডি। হিংস্র ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারই লড়াই-সংগ্রাম ও স্বপ্ন থেকে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায়। রক্ষা পায়নি শিশু রাসেলসহ নববিবাহিতা বধূ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীও। এটি নিছক কোন হত্যাকা- নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই এই মর্মন্তুদ হত্যাকা-ের লক্ষ্য ছিল না। এটি ছিল মূলত একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের সুগভীর চক্রান্তে সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড ।
যার লক্ষ্য ছিল এই দেশ থেকে চিরতরে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসÑ সব মুছে দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত করা। বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে একাত্তরের পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
জনগণের প্রতি প্রচন্ড ভালবাসা এবং আস্থা-বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূলভিত্তি। জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে তিনি প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রজ্বালন ঘটিয়ে অন্ধকারের শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করে সকলের ঐক্যবদ্ধতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ। তাঁরই দূরদর্শী নেতৃত্বে ও অনুরোধে স্বাধীনতা অর্জনের তিন মাসের মাথায় ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ আমরা লাভ করি।
মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই স্বল্প সময়ে জাতীয় সংবিধান প্রণয়নসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পরিশীলিত, ক্ষুরধার ও জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে, মুক্তির লড়াইয়ে সংগ্রামরত মানুষের পক্ষে।’ এ ভাষণের পর কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্র্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সেদিনের কথাটি সত্য হয়ে যায় ঠিক দু’বছরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে বিচারের পথ অবরুদ্ধ, ঘাতকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করাসহ দীর্ঘ ২১ বছর (১৯৭৫-১৯৯৬) ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতির মাধ্যমে বাংলার মাটি থেকে বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার অনেক অপচেষ্টা চালিয়েছে। এতদসত্ত্বেও তারা সফল হয়নি।
কেননা, সারা বাংলাদেশই ধারণ করে রয়েছে শেখ মুজিবের অবয়ব। তাঁর অস্তিত্ব কখনও মুছে ফেলা সম্ভব নয় ইতিহাস থেকে।
১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ওইদিন লালবাগ থানায় মামলা করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা গ্রহণ করেনি। দীর্ঘ ২১ বছর পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হলে তিনি ২ অক্টোবর ১৯৯৬ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে ধানম-ি থানায় মামলাটি দায়ের করেন। আ ফ ম মুহিতুল ইসলামের সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা-সাক্ষাত হয়েছে। তার চাওয়া পাওয়ার কিছুই ছিল না, একমাত্র ইচ্ছা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখে যাওয়া। শেষবার যখন সঙ্গে দেখা হয় তিনি আমাকে বলেন, ‘আল্লাহ্ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। এখন আমার যাবার পালা।’ প্রায় দুই বছর আগে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এবং যশোরের গ্রামের বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনে তিনটি দিক উল্লেখযোগ্য- (১) রাজনৈতিক মুক্তি, (২) অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি ও (৩) প্রশাসনিক মুক্তি। এসব বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু যখনই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়। তবে তাঁর দর্শন বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের সনদ হিসেবে চিরকাল থাকবে।
মাত্র ৫৫ বছরের যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন তার পুরোটাই ছিল সংগ্রামমুখর। উক্ত সময়ে তিনি খোকা থেকে মুজিব ভাই, অতঃপর বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতায় অভিষিক্ত হন। রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু যেমন অসামান্য ও অপ্রতিরোধ্য, তেমনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও ছিলেন সফল ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু পরম্পরা। যে দেশটির তিনি জন্ম দিয়ে গেছেন, সেই দেশটিকে গড়ে তোলার সময়টুকু তাকে দেয়া হলো না। বঙ্গবন্ধুর রক্তে রঞ্জিত হলো এ অভাগা দেশের মাটি। কত অপচেষ্টা হয়েছে তাঁর নামটি মুছে ফেলার। কিন্তু যে মানুষটি বাঙালীর হৃদয়ের গহীনে অবস্থান করে আছেন, কার সাধ্য আছে তাঁকে অপসারণ করার? বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে সশরীরে উপস্থিত নেই সত্য; তবে রয়েছে অমর নেতার অক্ষয় কীর্তি-নীতি ও আদর্শ, যা আগামীতে বাঙালী জাতিকে পথ চলতে নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাঙালীর হৃদয়ে তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল।
যতদিন বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ থাকবে, বাংলায় চন্দ্র-সূর্য উদিত হবে, নদীর কলতান ও সাগরের গর্জন থাকবে, ততদিন বাংলার মানুষের হৃদয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটির জয়ধ্বনি চলতে থাকবে। দোয়েল-শালিক তাদের প্রভাতী গানে আজও তাঁকে স্মরণ করে চলেছে। শুধু বাংলার মানুষই নয়; জাতিসংঘও ১৬ আগস্ট ২০১৯ বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দি ওয়ার্ল্ড বা বিশ্ববন্ধু’ আখ্যা দিয়ে উচ্চাসনে বসিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন, চিন্তা-চেতনা, নীতি-আদর্শ প্রবহমান থাকবে আজীবন। যার ধারক হব আমরা আর বাহক হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
যেদিন রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত হবে, দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত হবে, দেশের প্রতিটি মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে, সেদিনই বঙ্গবন্ধুসহ ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। এই হোক শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন