
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২
২৭ জুলাই, ২০২২ তারিখে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২২ নামে জনশুমারি, গৃহগণনা এবং ব্যক্তির জনমিতিক ও আর্থ-সামাজিক তথ্যের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দশ বছর অন্তর পরিচালিত এ জনশুমারি-২০২১ সালে সম্পাদনের কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে বর্তমান বছরের ১৫-২১ জুন, ২০২২ সময়কালে এ জনশুমারির আয়োজন করা হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ শুমারি নিয়ে চলছে লেখা ও আলোচনা।
জনশুমারি সম্পূর্ণ নির্ভুল হয়েছে কিনা, প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যা সঠিক কিনা, কেউ গণনায় বাদ পড়েছে কিনা- এসব নিয়ে আলোচনা বিস্তর। মাত্র ৭ দিনে জনমিতিক বিভিন্ন তথ্যসহ জনসংখ্যার চিত্র সম্পূর্ণ নির্ভুল হবে, তা প্রত্যাশা করা যৌক্তিক নয়। শুমারিকৃত জনগণের তথ্য ডাটাবেজে আছে। কেউ বাদ পড়লে অন্তর্ভুক্তির যেমন সুযোগ আছে তেমনি দ্বিতীয়বার অন্তর্ভুক্তি হলে বাদ দেয়ারও ব্যবস্থা আছে। এ সুযোগ রেখেই শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
জনগণনায় কেউ বাদ পড়তেই পারেন, যা সংশোধনের সুযোগ আছে। এটা খুব জরুরী বিষয় নয়। বরং জনমিতিক যে বহুমাত্রিক ও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করাই বেশি জরুরী। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬.৫২ কোটি, যা ২০১১ এর জনসংখ্যার চেয়ে ১.১২ কোটি বেশি। গড়ে প্রতিবছর জনসংখ্যা বেড়েছে দশ লাখ।
জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষের (৮.১৭ কোটি) চেয়ে নারী জনসংখ্যা (৮.৩৩ কোটি) বেশি। দেশে এখন পুরুষের চেয়ে নারীর গড় আয়ু বেশি (৭৪.৯ বছর)। বিদেশে এক কোটি প্রবাসী কর্মীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কাজেই জনশুমারির চিত্রে নারীর সংখ্যা একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
জনমিতিক পরিবর্তনের এ ধাপের মধ্য দিয়েই সব দেশ অগ্রসর হয়। এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় শিশু বয়সী জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও সংখ্যাধিক্য ঘটে, যা দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে না। একটা পর্যায়ে তা আবার কমতে থাকে এবং বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। এজন্য কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্য কোন দেশে শুধু একবারই আসে। এজন্য এ ধাপকে বলা হয় ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল।
বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বৃদ্ধি ২০০০ সাল থেকে দৃশ্যমান হয়। কোন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ বছরের বেশি স্থায়ী হয় না। কারণ, কর্মক্ষম জনসংখ্যা বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। বয়স্ক জনসংখ্যার জন্যস্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে খরচ বৃদ্ধি পায়।
জনশুমারির বর্তমান প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশু বয়সী (০-১৪ বছর) জনসংখ্যা ২৮.৬১% তে নেমে গেছে। ২০১১ সালে এ হার ছিল ৩৪.৬৪%। বেড়েছে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (৬৫.৫৩%)। যদিও কোন কোন সমীক্ষায় এ হার আরও বেশি বলে উল্লেখ আছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশু বয়সী জনসংখ্যা ২০৪০ সালে ১৯.৫% এবং ২০৫০ সালে ১৭.৩% এ নেমে যাবে।
তখন বয়স্ক জনগণের হার হবে ২২.৫%। কাজেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমবে, বহু স্কুল বন্ধ হবে, স্বাস্থ্য খাতে চাপ বাড়বে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ, ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল হচ্ছে চায়ের কাপে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার শামিল। পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একটু বিলম্ব হলে এ সুযোগ আর কখনও ফিরবে না।
জনশুমারি প্রতিবেদনে টিএফআর ২.৩ উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ২০১১ সালে একই রূপ ছিল। তবে কোন কোন বিভাগে এটি অনেক কমে গিয়েছে। টিএফআর ২.১ থাকলেই একে রিপ্লেসমেন্ট লেভেল বলা হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যার বৃদ্ধি সেখানে ঘটে না। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে রাজশাহী ও রংপুর ডিভিশনে টিএফআর ২.১ এবং খুলনা বিভাগে ১.৯ এ নেমে গেছে। অর্থাৎ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে জনসংখ্যা খুব একটা বৃদ্ধি ঘটবে না।
খুলনা বিভাগের জনসংখ্যা কমবে। সে বিবেচনায় এখনই পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। স্বাধীনতার পরে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনজন পরিবার কল্যাণ সহকারী, একজন পরিদর্শক এবং একজন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর কাজ করছেন। এখনও তাই আছে, যার কোন যৌক্তিকতা নেই। সিলেট বিভাগে টিএফআর ২.৬। খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তৃণমূল পর্যায়ে জনবলের চিত্র একইরূপ থাকার কোন কারণ নেই। জনবল কাঠামো, কর্মসূচী ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন জরুরী। শিশুর সংখ্যা কমছে।
কাজেই সুস্থ শিশুর জন্মগ্রহণের জন্য প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবার কল্যাণ সহকারীদের মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ প্রদান করা যৌক্তিক। অবসর ও অন্য কারণে পরিবার কল্যাণ সহকারীর পদ শূন্য হলে সেখানে মিডওয়াইফ বা নার্স নিয়োগ করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিডিএইচএস-এর প্রতিবেদনে জনগণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উচ্চ হারে বৃদ্ধির তথ্য আছে। তাদের মধ্যে শতকরা ৫০% জানেন না যে, তাদের এ রোগ আছে। যারা জানেন, তাদের একটি বড় অংশ রোগ নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না।
ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ এবং অন্যান্য রোগে বাড়ছে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা। বয়স্ক লোক বৃদ্ধির সঙ্গে এ রোগের প্রকোপ আরও বাড়বে। ফলে উৎপাদনশীলতা কমবে। অথচ পাবলিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার রিভিউ ২০১৫ বলছে, আমাদের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যয় বৃদ্ধির সুপারিশ থাকলেও তা অনেক কমে গেছে। দেশে অসংক্রামক রোগের বৃদ্ধি ঘটছে দ্রুত গতিতে। জনমিতিক পরিবর্তনের সঙ্গে এর একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। কাজেই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গতি বাড়াতে হবে।
কৃষি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। দেশের ৪ কোটির বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে স্ব কর্মসংস্থান এবং দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মোটকথা, জনশুমারিতে প্রতিফলিত জনমিতিক পরিবর্তনের যে বহুমাত্রিক চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে, সেসব দিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং অন্যান্য খাতে কর্মসূচী, জনবল কাঠামো, বাজেট এবং অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই জনশুমারির প্রচেষ্টা সফল ও সার্থক হবে।
লেখক : সাবেক সচিব