
পুলিশের দায়িত্ব
Police মানে (Polite, Obedient, Loyal, Intelligent, Courageous, Energetic)- অর্থাৎ একজন মানুষের মধ্যে যখন এ ধরনের অসাধারণ গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে থাকে তখন তিনি পুলিশ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে উল্লিখিত গুণগুলোর সমন্বয় ঘটানো খুব জরুরী। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যের মধ্যে এ ধরনের গুণাবলীর সমন্বয় রয়েছে কিনা? সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এর কোথাও কোনরূপ ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। পুলিশ হচ্ছে একটি সরকারী বাহিনী, যার মূল কাজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখা এবং সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করার মহান কাজটি পুলিশ বাহিনীকেই করতে হচ্ছে। তৎপ্রেক্ষিতে যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত। পুলিশ ২৪ ঘণ্টা জনগণের জীবন ও মালামাল হেফাজত রক্ষার্থে সর্বদা বদ্ধপরিকর। যদিও পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক খবরের অভাব নেই, তথাপি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের নিকট জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য ভরসাস্থল হচ্ছে পুলিশ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে যখন আন্দোলন, সহিংস আচরণ, ভাংচুরের পরিস্থিতি দেখা দেয় তখন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশকেই এগিয়ে আসতে হয়। পুলিশ বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও বিশ^বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য কাজ করে থাকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ সদস্যরা গুরুতর আহত হয়ে থাকেন, তবু দায়িত্ব পালনে পিছপা হন না। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সকলের জন্য নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে পুলিশ সদস্যদের আত্মাহুতি দানের অজস্র নজির রয়েছে।
অপরাধ ও অপরাধীদের শনাক্তকরণের কাজটি পুলিশ সদস্যদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। এ তাৎপর্যময় কাজটি করতে গিয়ে তাদের বিভাগীয় বিভিন্ন রকমের ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও পেশাগত পারিপার্শ্বিকতাকে পাশ কাটিয়ে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে হয়। যদি অপরাধ তদন্তের কথাই উল্লেখ করেন তাহলে দেখবেন, অপরাধটি নথিভুক্ত হওয়ার পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে সাযুজ্যপূর্ণ ঘটনাক্রম ও উৎসগুলোর অনুসন্ধান করবেন। এতে কিন্তু খুব কম সময় লাগতে হবে। না হলে প্রমাণাদি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে।
তাছাড়াও প্রকৃত অপরাধী কিংবা কারণকে খুঁজে বের করার যাবতীয় অনুষঙ্গকে প্রস্তুত করতে হয়। ক্রাইম সিন এরিয়াকে সংরক্ষণ করতে হয়। সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হয় পুলিশকে। পরবর্তীতে ক্রাইম ল্যাবরেটরিতে সেগুলোর বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে রিপোর্টটি আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। সহজেই বোঝা যায়, একটি ঘটনার সম্পূর্ণ তদন্তের দায়ভার পরিপুর্ণ করতে একজন তদন্তকারী অফিসারকে প্রচুর বেগ পেতে হয়।
রাস্তায় আমরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করি। রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ও কলুষমুক্ত রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশ পুলিশের। রাস্তায় দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের মিডিয়া ট্রায়ালেরও স্বীকার হতে হয়। পুলিশ হাইওয়ে সড়ক, মহাসড়কে রাস্তা নিরাপদ রাখতে কাজ করে। সন্দেহজনক স্পটে নিয়মিত টহল দেয় পুলিশ।
নিরাপত্তা চৌকিও নির্মাণ করা হয় ক্ষেত্রবিশেষে। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পুলিশ সদস্যদের ট্রাফিকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিম্নমানের। দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও প্রদান করা হয়। এছাড়াও পথচারীদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে তাচ্ছিল্যের স্বীকারও হতে হয়। তবু জনগণের কল্যাণের স্বার্থে পুলিশ সদস্যদের নিরলস পরিশ্রম করে যেতে হয়।
রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বিরাজ করেন, তাদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানের কাজটি বাংলাদেশ পুলিশকেই করতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ ও অন্যান্য যারা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন, প্রত্যেককে নিরাপত্তা প্রদানের কাজটি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশকেই।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। অন্যদিকে বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, বিদেশী দূতাবাস ও কূটনৈতিক পাড়ায় নিরাপত্তার দায়িত্বও বাংলাদেশ পুলিশের কাঁধেই বর্তায়।
বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান সময়ের অপরাধীরা কৌশলী হচ্ছে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সেসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদেরও আধুনিক কৌশল ও নবতর অস্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে। কেননা, পুলিশ সদস্যদের অভিলক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
কাজেই পুলিশকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অপরাধীদের নিবৃত্ত করার মনোবাসনা থেকেই আধুনিক ও কৌশলী হয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী হতে হচ্ছে। অর্থাৎ অপরাধীরা যেন বুঝতে পারে অপরাধ করে কোনভাবেই তাদের পার পাওয়ার কোনরূপ সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমরা সকলেই অবগত। এর বিরূপ পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয় নির্বাচনকালীন সময়ে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। নির্বাচনে কঠোর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য পুলিশ সদস্যদের নিহত হওয়ার খবরও দেখা যায়। শুধু তাই নয়, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ডামাডোল থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টায় নিবেদিতপ্রাণ পুলিশের সদস্যরা।
বাংলাদেশের সকল সঙ্কটের ত্রাতা হয়েও আবির্ভাব ঘটে পুলিশের, বিশেষ করে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হয়। আর্থিকভাবেও পুলিশের সকল সদস্য বিভিন্ন সঙ্কটে অনুদান প্রদান করে মানবিক দায়িত্ব পালন করে থাকে।
করোনা মহামারীর সঙ্কটেও আমরা দেখেছি মানবিকতার নজির স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা। করোনকালে নিজের আত্মীয়স্বজনরা যখন একে একে দূরে সরে যায়, তখন পুলিশের সদস্যরা জীবনের মায়া উপেক্ষা করে আন্তরিকভাবে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করেছেন।
কারও বাসায় খাবার পৌঁছে দিয়েছে, দিয়েছে মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি, লাশ দাফন করতেও পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এ ধরনের মানবিক কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করায় পুলিশের সদস্যরা বিভিন্নভাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছেন।
অপরাধ প্রতিকারে সরকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকা- করে থাকে। যে কোন সমস্যায় উপনীত হলে মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হয় এবং এটি পুলিশের নৈমিত্তিক কাজের অংশ। অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও পুলিশ সদস্যদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে বর্তমানে। অর্থাৎ অপরাধ যেন না ঘটতে পারে, সে ধরনের কৌশল অবলম্বনের জন্য কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বেশ মুন্সিয়ানার ছাপ দেখিয়ে চলেছে পুলিশ বাহিনী।
উঠান বৈঠকের মাধ্যমে যেমনিভাবে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে ভবিষ্যতে যেন উল্লিখিত সমস্যার উদ্ভব না ঘটে সে জন্য কৌশল অবলম্বনের ক্ষেত্রেও নির্দেশনার কাজটি পুলিশ সদস্যরা করে যাচ্ছে। ৯৯৯ এ কল করে যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য পুলিশ সদস্যরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। পুলিশের এ সার্ভিসটি চালুর পর অসংখ্য মানুষ এতে উপকৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন পুলিশের সদস্যরা।
বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কৃতিতে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা প্রদান ব্যতিরেকে সমাবেশ আয়োজনের চিন্তা করাই দুরূহ। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশ আয়োজনে সর্বদা একটা ভীতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। সেক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার ঢাল হয়ে সমাবেশ পরিচালনা তথা রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।
উৎসব আয়োজনেও পুলিশ সদস্যদের সরব উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় রীতিনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বস্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি তদারক করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিট পুলিশিং প্র্যাকটিস চালু হওয়ার পরে নির্দিষ্ট এলাকায় জনগণের চাহিদামাফিক পুলিশিং করার চেষ্টা চালায় পুলিশের সদস্যরা। এতে করে উক্ত এলাকায় অপরাধ প্রতিরোধে একটি মাইলফলক হিসেবে পুলিশের সদস্যরা কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত টহল ও নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করে থাকে।
এছাড়াও বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা সমগ্র বিশে^ রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। বিশে^র বহু দেশ তাদের স্ব স্ব দেশে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ইউনিট বিশেষ করে সিটিটিসি, সোয়াট, র্যাব জঙ্গীবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। আমরা যদি বলি কেন পুলিশের প্রয়োজন কিংবা পুলিশ আমাদের কিভাবে সহযোগিতা করছে, সেক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশের অপরিহার্যতাই মূলত তার যৌক্তিকতাকে নিরূপণ করে থাকে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়