
ড. মিহির কান্তি মজুমদার
মাইক্রোফিন্যান্স অর্গানাইজেশন (গঋও), যারা এনজিও নামে বেশি পরিচিত তাদের সংখ্যা, অবয়ব এবং কার্যক্রম বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। যদিও তারা সকলে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে না। এদের অনেকেরই উদ্যোক্তা ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য এবং অনেকক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ঋণ ক্ষুদ্রঋণের চেয়ে বেশি। তা উদ্যোক্তা ঋণই হোক বা ক্ষুদ্রঋণই হোক কোন প্রতিষ্ঠানই বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া অতি দরিদ্র ব্যক্তি বা পরিবারকে ঋণ প্রদান করে না। ঋণ তাকেই প্রদান করা হয় যিনি ঋণ ফেরত প্রদানের সামর্থ্য রাখেন বা সামর্থ্য অর্জন করেন। বিচ্ছিন্নভাবে কাউকে ত্রাণ বা দান হিসেবে কিছু দেয়া হলেও তা অতি দরিদ্র অবস্থা উত্তরণে সামষ্টিকভাবে তেমন ভূমিকা রাখে না।
এ অবস্থা নিরসনে অতি দরিদ্র পরিবারে দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি সম্পদ (অংংবঃ) প্রদানের কার্যক্রম এদেশে শুরু হয় দুই দশক আগে। এসব প্রকল্প ও কর্মসূচীর মূল্যায়নে দেখা যায় যে, অতি দরিদ্র পরিবারের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি কিছু সম্পদ সহায়তা দেয়া হলে দারিদ্র্য অবস্থা থেকে উত্তরণ অনেকটাই সহজ হয়। এ মূল্যায়নের ভিত্তিতে যমুনার চরে দুই দফায় বাস্তবায়িত ডিএফআইডির অর্থায়নে চর জীবিকায়ন প্রকল্প (CLP-Chars Livelihoods Project) ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইইপি-সিড়ি প্রকল্প অতি দরিদ্র অবস্থা উত্তরণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে- অতি দরিদ্র অবস্থা উত্তরণের সঙ্গে গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংকের সম্পর্ক কি? এরূপ ব্যাংকের অস্তিত্ব, অবস্থান এবং ভূমিকাইবা কি? আলোচ্য গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংকের ইংরেজীতে নামকরণ করা হয়েছে ঈধঃঃষব ঊীপযধহমব ইধহশ। এ ব্যাংক কোন প্রথাগত আর্থিক ব্যাংক ব্যবস্থা নয়। এটি অতি দরিদ্র পরিবারে সম্পদ সহায়তা প্রদানের একটি ছোট উদ্যোগ। উদ্দীপন নামের এনজিও সম্প্রতি তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। উদ্যোগটি এখনও ছোট। তবে ধীরে ধীরে এর চাহিদা ও ব্যাপ্তি বাড়ছে। আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলে এ উদ্যোগ বড় হতে খুব একটা সময় লাগবে না।
গবাদিপ্রাণি উন্নয়নের জন্য সরাসরি ঈধঃঃষব ইধহশ, ঈধঃঃষব ঊীপযধহমব ইধহশ বা অনুরূপ নামের কোন ব্যাংকের অস্তিত্ব নেই। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঈধঃঃষব ইধহশ নামে একটি ব্যাংকের তথ্য পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের চ্যাম্পেইন নামের এলাকার সঙ্গে শিকাগো শহরের রেল যোগাযোগ ছিল উনিশ শতকেই। শিকাগো শহর শত শত বছর ধরে মাংসের জন্য প্রসিদ্ধ। গো-চারণ ভূমির আধিক্যের কারণে চ্যাম্পেইন এলাকায় গবাদিপ্রাণি পালন ছিল অনেক জনপ্রিয়। চ্যাম্পেইন স্টেশন থেকে গবাদিপ্রাণি রেলযোগে শিকাগো প্রেরণ তাই বেশ লাভজনক ছিল।
গবাদিপ্রাণি পালনকারীদের আর্থিক লেনদেনের আকারও বেশি। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড প্রেইরি ব্যাংক ১৮৫৮ সালে চ্যাম্পেইন এলাকায় একটি শাখা পরিচালনা শুরু করে। গবাদিপ্রাণি পালন ও পরিবহনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় ব্যাংকের নাম ঈধঃঃষব ইধহশ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। সেখানে এখন এ ব্যাংকের শাখা নেই। কিন্তু ব্যাংকের ভবনটি ঈধঃঃষব ইধহশ নামেই গত দেড়শ’ বছর ধরে মিউজিয়াম হিসেবে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাক্সা অঙ্গরাজ্যে ঈধঃঃষব ইধহশ ্ ঞৎঁংঃ নামে একটি ব্যাংকের ৫টি শাখা পরিচালিত হচ্ছে ১৮৭৩ সাল থেকেই। ব্যাংকটি এখন সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। শুরুতে গবাদিপ্রাণি পালনে ঋণদানের ভূমিকা থাকলেও ব্যাংকের ওই নাম ছাড়া গবাদিপ্রাণি উন্নয়ন বা সম্প্রসারণে বর্তমানে তাদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই। আলোচ্য গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংক বা ঈধঃঃষব ঊীপযধহমব ইধহশ কোন আর্থিক লেনদেনের ব্যাংক নয়।
এটি সুপ্রাচীন গবাদিপ্রাণি বর্গা প্রথার একটি আধুনিক সংস্করণ। গবাদিপ্রাণি দরিদ্র মানুষের মধ্যে বর্গা দেয়ার প্রচলন ছিল এ জনপদে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। এখনও কোথাও কোথাও এ অবক্ষয়ী প্রথা টিকে আছে। বিভিন্ন জায়গায় বর্গা প্রথার নিয়ম-কানুনে কিছুটা বিভিন্নতা থাকলেও আধাআধি ভাগটাই ছিল প্রধান। গবাদিপ্রাণির বাচ্চা প্রথমটি গবাদিপ্রাণির মালিক পেলে পরেরটি বর্গাদার পাবে। ছাগল/ভেড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে একত্রে বেশি বাচ্চা হয়। সেখানেও প্রতিবছর আধাআধি ভাগ এবং ভাগে অমিল হলে পরবর্তী বছরে সমন্বয় এরূপ শর্তাদি প্রাধান্য পেত। কিন্তু আলোচ্য গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংকে আধাআধি ভাগ তো দূরের কথা, মালিকের কোন ভাগই নেই।
গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংকের নিয়মটা তাই একটু ভিন্ন। এর আওতায় একটি অতি দরিদ্র পরিবারে একটি এক বছর বয়সী বকনা বাছুর বা বকনা ছাগল দেয়া হয়। একটি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এ বকনা বাছুর বা ছাগল প্রদানের শর্ত হলো গ্রহীতা উক্ত গবাদিপ্রাণির প্রথম বাচ্চা এক বছর বয়স হলেই ফেরত দেবেন। ছাগল/ভেড়ার একাধিক বাচ্চা হয় বলে শুধু গ্রহীতা একটা বকনা বাচ্চা ফেরত দেবেন। ফেরত দেয়া এক বছর বয়সী বকনা ছাগল বা বাছুর তখন আর একজন অতি দরিদ্র সদস্যকে দেয়া হয়। গরুর ক্ষেত্রে প্রথম বাচ্চা বকনা না হলে তা বিক্রি করে প্রয়োজনে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে একটি বকনা বাছুর ক্রয় করে অপর একটি অতি দরিদ্র পরিবারে একই শর্তে প্রদান করা হয়।
গবাদিপ্রাণির প্রথম বাচ্চা ফেরত প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহীতা মূল গবাদিপ্রাণির মালিক হয়ে যান। পরবর্তীতে ফেরত দেয়া এক বছর বয়সী বকনা বাছুর/ছাগল যিনি গ্রহণ করবেন তিনিও একই পদ্ধতিতে প্রথম বাচ্চা ফেরত দিয়ে গবাদিপ্রাণির মালিক হবেন। এভাবেই একটা ছোট উদ্যোগ সমাজের অতিদরিদ্র পরিবারে সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। উদ্দীপন এ উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছে মাত্র এক বছর ধরে। কিন্তু ইতোমধ্যে এ উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে গ্রাহকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। এ সম্পর্কিত নীতিমালাও আছে। উদ্দীপনের ৮৮৩টি শাখায় সংরক্ষিত রেজিস্টারে এরূপ গবাদিপ্রাণি গ্রহীতার পরিচিতি এবং অন্যান্য তথ্য আছে।
উদ্যোগটির নাম ‘গবাদিপ্রাণি বিনিময় কর্মসূচী’ দিয়ে শেষ করা যেত। নামের সঙ্গে ব্যাংক শব্দ যোগ করারও একটা উদ্দেশ্য আছে। ব্যাংক বলতে আমরা অর্থ লেনদেনকারী বিধিবদ্ধ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই বুঝি। মুদ্রা ব্যবস্থা সৃষ্টির আগে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য আদান-প্রদান রীতি চালু ছিল। গবাদিপ্রাণি ও শস্যঋণ প্রদানের প্রথাও বেশ জেঁকে বসেছিল। প্রায় ৩৮০০ বছর আগে বেবিলনের রাজা হান্মুরাবীর সময় প্রণীত ‘ঞযব ঈড়ফব ড়ভ ঐধহসঁৎধনর’-কে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখিত বিধি-বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। সে বিধি-বিধানে এরূপ গবাদিপ্রাণি ও শস্যঋণ প্রদান, সুদ আদায় এবং ঋণের বিপরীতে জামানত গ্রহণের অনুশাসন ছিল।
মধ্যযুগে গ্রীক ও রোম সা¤্রাজ্যে বিশেষ করে ইতালির ভেনিস ও ফ্লোরেন্স শহরে বাজারে বেঞ্চ বসিয়ে অর্থ লগ্নিকারী ব্যক্তি বা দলের লেনদেন করার প্রথা তৈরি হয়। সেই বেঞ্চের ইতালীয় শব্দ ইধহপড় বা ইধহয়ঁব থেকে আধুনিক ব্যাংকের নামকরণ হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে অনেক। অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্লাড ব্যাংক, জিন ব্যাংক আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাত্র ২ বছর আগে একজনের রক্ত সংরক্ষণ করে আর একজনের শরীরে পরিসঞ্চালন শুরু হয়। তার আগে একজনের শরীর থেকে অন্য একজনের শরীরে সরাসরি রক্ত পরিসঞ্চালন করা হতো। যুদ্ধে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তার কারণে এ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি হয়। ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রত্যেক দেশে এখন অনেক ব্লাড ব্যংক আছে। জীববৈচিত্র্যের কারণে প্রত্যেক দেশে একাধিক জিন ব্যাংকও তৈরি হচ্ছে সেভাবেই।
গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংকের উদ্যোগটিও যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারেন। উদ্দীপনের বিদ্যমান উদ্যোগেও অংশগ্রহণ করতে পারেন। উদ্দীপন সেক্ষেত্রে সকল ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে। এভাবে আগ্রহী ও উদ্যোগী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণে গবাদিপ্রাণি বিনিময় ব্যাংক কর্মসূচী দ্রুত সম্প্রসারণ হতে পারে, যা হতে পারে দেশের অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পদ সহায়তা প্রদানের একটি ভাল মাধ্যম।
লেখক : সাবেক সচিব, চেয়ারম্যান, উদ্দীপন