ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ ॥ ফিরে দেখা

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২৮ অক্টোবর ২০২১

জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ ॥ ফিরে দেখা

১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী ভাষণ প্রদান করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে সরকারপ্রধান বক্তব্য দেয়ার রীতি প্রচলিত থাকলেও বিরোধীদলীয় নেতা এই প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন। এই ভাষণ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ভাষণ সম্পর্কে আলোচনা খুব একটা শোনা যায় না। এ ভাষণই ছিল মূলত বাঙালীর ভাবি স্বাধীন রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন। বঙ্গবন্ধু রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনগণের কাছে বক্তব্য পেশের সুযোগকে জনগণের সংগ্রামের প্রাথমিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ থেকে এর বিকাশের পথে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করেছিল। ‘প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগের জন্ম। আর সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের বিকাশ’- বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে এ কথা বলেন। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের ফলে ১৯৭০ সাল অবধি অনেক রাজনৈতিক দল বিলুপ্তির মুখে পড়েছিল। এ ভাষণের প্রারম্ভিক পর্বে জনগণের ক্ষমতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে স্বাধীনতার ইঙ্গিত ছিল। ১৯৭১ সালে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং জনগণের ওপর শক্তি প্রয়োগের যে ঘটনা ঘটেছিল ’৭০-এর ২৮ অক্টোবরের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যে শক্তিশালী চক্র গত ২২ বছর ধরে পাকিস্তান শাসন করছে, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তারা সম্ভাব্য সব রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এরা সেই সব গোষ্ঠী-যারা সাধারণ নির্বাচন বানচালের সক্রিয় ষড়যন্ত্র করছেন। এমনকি নির্বাচনের পরেও তারা শোষণের অবসান ঘটানোর প্রত্যেকটা প্রচেষ্টা নস্যাত কারার জন্য সক্রিয় থাকবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে তারা বিপুল সম্পদ নিয়োজিত করবে। তাদের অর্থ আছে, প্রভাব আছে, জনসাধারণের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও রয়েছে।’ একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সংকল্পবদ্ধ মানুষের আপোসহীন সংগ্রামে জনগণের জয় অবশ্যম্ভাবী বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী যেমন ভবিষ্যত বলে দেন; বঙ্গবন্ধুও তেমনই পাকিস্তানের রাজনীতিতে কি ঘটতে চলেছে তা আগাম জানিয়ে দিলেন। শুধু কি তাই, পরিণতি কি হবে তাও বলে দিলেন। আর ঘটনা ঘটলও ঠিক সেরকমই। বঙ্গবন্ধু জ্যোতিষী ছিলেন না, পরাবিদ্যা অনুসন্ধানীও ছিলেন না, রাজনীতিক তত্ত্বানুসন্ধানে সময় নষ্ট করার কোন আগ্রহ তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন তত্ত্বের নির্মাতা কর্মের মাধ্যমে। রাজনীতির নিরেট বাস্তবতার গভীরে প্রবেশ করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। যেন এক রাজনীতির জাদুকর। বক্তব্যের ঐন্দ্রজালিক আবেশে মানুষকে মোহাবিষ্ট করার এক অসাধারণ ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ম্যান্ডেট দিয়ে দিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নির্ধারিত। আর কর্মপন্থা তৈরি হতো সময়ের পরিমাপে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছিলেন- জনগণের রাজনৈতিক অধিকারহীনতা, নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অর্থনৈতিক বঞ্চনা আর আঞ্চলিক বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলিত-বঞ্চিত মানুষের কথা উল্লেখ করতেও তিনি ভুলে যাননি। ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্র’ আর ‘মৌলিক স্বাধীনতা’ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক সুরক্ষার মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি- সে কথা তিনি বলেছিলেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ আর অবিচারের কাঠামো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তিনি দেখিয়েছিলেন- মোট শিল্প সম্পদের ষাট ভাগের বেশি, ব্যাংকিং সম্পদের আশি ভাগ, বীমা সম্পদের পঁচাত্তর ভাগ দুই ডজন পরিবার কুক্ষিগত করে রেখেছে। সরকারের গৃহীত নীতির ফলে আয় বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে সংবাদপত্র আর শিক্ষার পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। এ বিষয়টি আজও প্রাসঙ্গিক। স্বৈরতান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দুষ্টচক্র এ দুটি বিষয়কে ভয় পায়। সে কারণে হীরক রাজাও তার রাজ্য থেকে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারও শিক্ষাব্যবস্থায় পাকিস্তানী ভাবধারার সন্নিবেশকরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবদমন করে রাখাসহ বাঙালী সংস্কৃতি বিদ্বেষী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। সুষ্ঠু ও জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে যেমন সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণমাধ্যম প্রয়োজন; ঠিক তেমনই সংবাদ-কর্মীদের কর্মক্ষেত্রেও স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু নিজে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনায় একদিকে যেমন শিক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতার কথা ছিল, অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের ধারণার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত শিক্ষা নীতিতে এ ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তিনি তাঁর শিক্ষাপ্রশাসন সাজিয়েছিলেন শিক্ষকদের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন, ‘আগামী নির্বাচন জাতীয় মৌলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ করে ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোটরূপে আমরা গ্রহণ করেছি।’ আওয়ামী লীগের জনসভায় নয়, তিনি সরকারী গণমাধ্যমে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ ঘোষণা প্রদান করেন। ৬-দফার ভিত্তিতে যে শাসনতন্ত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন তাতে ফেডারেল ইউনিটের মধ্যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক রূপকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে কৌশলে জনগণের সামনে উপস্থাপন করলেন। পাকিস্তানের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে একটি ‘ভারসাম্যমূলক ফেডারেল’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, নিখিল পাকিস্তান সার্ভিস ব্যবস্থা বিলোপ করে ফেডারেল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে ফেডারেল অঞ্চল থেকে লোক নিয়োগ করে বৈষম্য দূর করার কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান না বলে- এ অঞ্চলকে বাংলাদেশ ও বাংলা বলে সম্বোধন করেন। এ শব্দচয়নের মাধ্যমে নিশ্চয় তিনি একটি বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি তুলনামূলক তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখান যে, নিত্যপণ্য-মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে শতকরা পঞ্চাশ থেকে একশ ভাগ বেশি। আবার কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, চা, তামাক, ও ইক্ষু উৎপাদন বৃদ্ধি, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বণ্টন, পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, ফলচাষ, পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খামার তৈরি- ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করার কথা বলেছিলেন। পল্লী এলাকায় শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে ‘বিজলি’ পৌঁছে দিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প, জামালপুর কয়লা প্রকল্প- ইত্যাদি বাস্তবায়নসহ পাঁচ বছরে পঁচিশ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। যমুনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী নদীতে সেতু নির্মাণ করে সারাদেশে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলেছিলেন। অবশেষে তাঁর কন্যা এ বক্তব্যের একান্ন বছর পর পিতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পদ্মা-যমুনাসহ দেশের সকল নদীর ওপর সেতু, কর্ণফুলীতে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, কয়েকটি কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়ন তথা সব গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার কাজ প্রায় শেষ করেছেন। তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, দেশভাগের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার হারে অবনমন ঘটেছে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, শিশুশিক্ষার জন্য ‘ক্রাস প্রোগ্রাম’, মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ও উন্নয়ন বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৭০ সালে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারক। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশ গঠনে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তিনি বেঁচে থাকলে আশির দশকে বাংলাদেশের যে রূপপরিগ্রহ করত- তা শেখ হাসিনার বর্তমান বাংলাদেশ- যেখান থেকে শুরু হতে পারত ভিন্ন কোন সাফল্যের গল্প। বঙ্গবন্ধুর ’৭০-এর ভাষণের পূর্ণবাস্তবায়ন হলে আজও বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম সুষম-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×