
জুমাতুল বিদা মানে পবিত্র রমজান মাসের বিদায়ের বার্তাবাহী জুমা। মুমিন মুসলমানগণ পরম আহলাদ ও বিশেষ মর্যাদায় পালন করে থাকেন এ দিবসটি। রমজানুল মুবারক ক্রমাগত শেষ হয়ে আসলে দুটি দিবসের প্রতি তারা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। একটি হলো পবিত্র শবে কদর, অপরটি হলো জুমাতুল বিদা। আজ পবিত্র জুমাতুল বিদার ফজিলত প্রাপ্তির সময়।
এমনিতেই ইসলাম ধর্মে জুমা বা জুমা দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। দুনিয়ার অনেক উত্থান পতন ও ঘটনার কালসাক্ষী এটি। পৃথিবী সৃষ্টি হয় এই দিনে। কিয়ামতও এই দিনে সংঘটিত হবে বলে বিখ্যাত তাফসির ‘ইবনে কাসীর’ থেকে জানা যায়। এই দিনের জুমার সালাত ও খুতবাকে গরিবের হজ বলা হয়ে থাকে । হাদিস শরীফে এসেছে, এই দিন এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে মানুষ যে দোয়াই করে কবুল হয়।’ আমরা সারাদিন পুতঃপবিত্র থেকে ইবাদত-বন্দেগি আন্জাম দেয়ার মাধ্যমে সে মুহূর্তটি লাভ করতে পারি।
কুরআনুল করীমের সূরাতুল জুমায় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন (ইয়া আইয়্যুহাল লাজিনা আমানু ইজা নুদিয়া লিস সলাতি মিইয়াওমিল জুমা...) অর্থাৎ ‘হে ইমানদারগণ, জুমার দিনে যখন আজান দেয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে ত্বরা করো এবং বেচাকেনা বন্ধ রাখ। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ।’
উল্লেখ্য, আয়াতে বর্ণিত ‘ত্বরা করো ’ অর্থ দৌঁড়ানো উদ্দেশ্য নয়। গুরুত্ব দেয়া উদ্দেশ্য। কারণ নামাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি ও ছোটাছুটি করে গমন করতে আঁ-হজরত (স) হাদিসে নিষেধ করেছেন। যেহেতু এর দ্বারা কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এখানে ‘ত্বরা করো ’ এর মর্ম হলো শান্তি ও গাম্ভীর্য সহকারে নামাজের জন্য গমন করা।
রহমত বরকত মাগফিরাতের মাস রমজানে জুমার দিবসের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। কারণ, এ মাসের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব অন্য এগারো মাসের তুলনায় অত্যধিক। বিশেষ করে এ মাসের সমাপনী জুমার আবেদন যে কোন জুমার তুলনায় মুমিন মনে দাগ কাটে বেশি। এ জন্য দেখা যায় , এই দিন জুমার সালাতে প্রধান প্রধান মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামে, রাজপথ হয় লাখো মুমিনের জায়নামাজ। মাহে রমজানের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এ এক মনোমুগ্ধকর সংস্কৃতি।
পবিত্র জুমাতুল বিদার মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে চারটি কারণ মুখ্য বলে ওলামাগণ মনে করেন। প্রথমত, এই দিন পবিত্র রমজানুল মুবারককে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর একটি হৃদয় কাড়া ঐতিহ্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই দিন বিভিন্ন স্থান ও পরিস্থিতি ভেদে সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ ঘোষণা করা হয় এবং তৃতীয়ত, এই দিন মসজিদে মসজিদে আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের করণীয় ও কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াজ- নসিহত করা হয়। আর এ দিবসের আমল, তাৎপর্য সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। চতুর্থত, এ দিনকে বর্তমান বিশ^ মুসলিম আল কুদুস বা জেরুজালেমের পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্তি দিবস ঘোষণা করেছে।
জুমাতুল বিদার খুতবায় থাকে মাহে রমজানের বিদায় বার্তা। মসজিদের ইমাম বা খতিব যখন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তা বর্ণনা করেন তখন দিকে দিকে করুণ ও কাতর দৃশ্যের উদ্ভব হয়। রমজানের বিদায়ী সানাই শোনে মুসল্লিগণ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ইমাম সাহেব বলতে থাকেন (আস্সালাম ইয়া শাহরাল কুরআন) ওহে কুরআনের মাস তোমায় সালাম, (আস্সালাম ইয়া শাহরাল মাগফিরাহ) ওহে গুনাহ মাপের মাস তোমায় সালাম, (আল বিদা আল বিদা ইয়া শাহরা রমাদান), বিদায়, বিদায় ওহে মাহে রমজান। খুতবায় এমনিতর বহুবিধ যথার্থ বাক্য প্রয়োগে উপস্থিত ধর্মপ্রাণ মুসলামানদের হৃদয়-মন আখিরাতের জবাবদিহিতার ভয়ে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। কেননা হে মাগফিরাতের মাস, তুমি তো সাক্ষ্যদাতা। তুমি কি আমাদের পক্ষে সাক্ষী হবে, নাকি আল্লাহর দরবারে আমাদের বিপক্ষে সাক্ষী দেবে। আমরা তো এ মাসের সব হক হুকুম আদায় করতে পারিনি এবং আগামী বছর এমন দিনে বেঁচে থাকব তাও নিশ্চিত নয়।
এসব স্মরণে এনে মুসল্লিগণ ইস্তেগফার ও তাওবায় অংশ নেন। কায়মনোবাক্যে অতীতের ভুলত্রুটির জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করেন। নিজের জন্য ও ময়-মুরব্বি, আওলাদ ফরজন্দ, সর্বোপরি দেশ জাতির মঙ্গল কামনায় সকলে অভিন্ন কণ্ঠে ফরিয়াদ করেন।
তাই জুমাতুল বিদা বস্তুতই ইবাদত-বন্দেগির, তাওবা, ইস্তেগফারের, মাহে রমজানের বিদায় বেলায় আনুষ্ঠানিক আত্মোপলদ্ধির ও বিশেষ মোনাজাতের। আমরা যেন পূর্ণ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে তা উদযাপন করি।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]