যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন ‘বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভ’ নামের একটি ‘পেজ’ যা ধারণ করে আছে ১ মিলিয়নেরও বেশি (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত ১০,০২২,৩৯৫) মানুষের ভালবাসা যাকে আমরা ‘লাইক’ বলে থাকি। এই পেজে আছে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য দুর্লভ ছবি, যেসব ছবির সঙ্গে যুক্ত থাকা ইতিহাসের সংক্ষেপ-বর্ণনা, আছে ভিডিও ও ভিডিওভিত্তিক সাক্ষাতকার যেখানে দেশের সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁদের ভাবনা, অনুভূতি ও অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এই পেজের যারা উদ্যোক্তা তাঁরা এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক বই, প্রবন্ধ, কলাম ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। কালের আবর্তে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ দলিলসমূহ হারিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রিক সকল তথ্য সংরক্ষণ ও সংগ্রামী জীবনের চিত্রপট তুলে ধরতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।’ যদিও এই প্রচেষ্টা যে ক্ষুদ্র নয়, মহতেরও অধিক তার কিছু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিচে উল্লেখ করা হলো।
আমরা সাধারণত সমাজ মানসে সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব নিয়ে তেমন কোন গবেষণা করি না, যা আলোচনা হয় বেশিরভাগই এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। কিন্তু আলাপের আগে আমাদেরও মনে রাখতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে ইন্টারনেট বিস্তৃতি অবশ্যম্ভাবী হলেও এই মাধ্যম ব্যবহার করে (বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) আমরা কী কী কন্টেন্ট সাধারণের মানোজগতে পৌঁছে দেব সেই ‘রেডিনেস’ আমাদের ছিল না। ফলে আজ আমরা ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে যতই নেতিবাচক আলোচনা করি না কেন দায় আমাদেরও আছে, আমরা সেই বিষয়বস্তু বিনির্মাণের চিন্তা করিনি, কেবলমাত্র অবকাঠামো সম্প্রসারণ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, এখনও আছি। ফলে যেসব নাম না জানা তরুণ ‘বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভ’-এর মতো ফেসবুক পেজ তৈরি করে আদর্শ উপস্থাপন ও ইতিহাস শিক্ষার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁদের আমরা সাধুবাদ জানাই। আর যাই-ই হোক আমাদের চিন্তার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান তাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন যেখানে পুনস্থাপিত হয়েছে দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভালবাসা ও অনুভূতি প্রকাশের শান্তি। আমার বিচারে ইতিহাসের কাঠগড়ায় নিরপরাধ জাতির জন্য এই পেজ একটি মুক্তির বার্তা, কারণ দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুকে আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানাতে পারিনি। অপরদিকে তাঁকে খুঁজে পেতে হয়রান হয়েও রাষ্ট্রীয় বাধার কারণে আমরা আর এগুতে পারিনি, ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত দিনগুলোয় বহু মুজিব ভক্ত বাঙালী বুকে কষ্ট ও অভিমান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। এখন অন্তত এই পেজ ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসার গল্প পৌঁছে দিতে পারছে।
বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভের এই পেজে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাঁর ছবি, তাঁর যথাসম্ভব প্রাপ্ত ও সংরক্ষণ করা ভিডিও দিয়ে যেগুলো ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর রয়েছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুখে ৩০-৪০ সেকেন্ডের ভিডিওতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁদের মনের ভাবনা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ। এ রকম ভিডিওগুলো সাজানো হয়েছে ‘আমার বঙ্গবন্ধু’ নামের একটি অ্যালবামে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই এ্যালবামে লক্ষ্য করা গেল মোট ১৭১টি ভিডিও সন্নিবেশ করা হয়েছে যেখানে ‘আমার বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের এ্যালবামে ৩৪ জন মানুষ আলাদাভাবে দু-চারটি বাক্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। বলাবাহুল্য, এই ভিডিওগুলো কোন আয়োজন করে সিনেমা তৈরির জন্য করা হয়নি, পথে চলতে চলতে বা কোন অনুষ্ঠানে দর্শকের সামনে একটি ভিডিও ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ধরে জানতে চাওয়া, বঙ্গবন্ধু আপনার মনে কেমন ঠাঁই করে নিয়েছেন বা হয়ত এ রকমই কোন প্রশ্ন যার উত্তরে মানুষ তাঁর আবেগের প্রকাশ করেছেন। মন দিয়ে শুনলে ছোট ছোট এই উপস্থাপনগুলোয় দেখা যায় দেশের মানুষের আবেগের কোন গর্ব-কোঠায় বঙ্গবন্ধু বসবাস করেন। এক সঙ্গে এমন অনেক মানুষের অনুভূতি জেনে যে কোন দর্শক হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিজের অনূভূতির আলোড়ন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীর কথা শুনলে অবাক হতে হয় বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এই আবেগ কেন এতো স্বতঃস্ফূর্ত যাকে কিনা আমরা একদিন জাতীয় ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম। হয়ত অনেকেই এমন ভাবনা নিয়ে নিজেই নিজের একটা ভিডিও করে ফেলবেন, আমি কেমন দেখি বঙ্গবন্ধুকে, এই নিয়ে।
এই পেজের টাইমলাইনে যুক্ত আছে ১৬২০টি ছবি। ‘অগাস্ট ট্র্যাজেডি’ নামে একটি এ্যালবামে যুক্ত আছে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ভিডিও। এছাড়া আছে ‘বহুমাত্রিকতায় বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি এ্যালবাম যেখানে উদ্ধৃত আছে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ বেশকিছু উক্তি। এগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে যথেষ্ট নান্দনিক সৌকর্যে, অঙ্গশয্যায় কোন বাহুল্য নেই, যে পরিমিতি বোধের কারণে আমার বিশ্বাস মানুষ এগুলো পছন্দ করছে। প্রায় সব ছবি ও ভিডিওর ভিউ হয়েছে অসংখ্যবার যার হিসাব টুকে রাখাও দুষ্কর। একদিন এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক গবেষণা হবে যা হবে মহাকালের জ্ঞান সমাজের দরবারে এক অনন্য সংযোজন।
সাধারণ মানুষের সাক্ষাতকারভিত্তিক ভিডিওগুলো এই পেজের এক অনন্য সংযোজন। কিছু কিছু সাক্ষাতকারে উল্লেখিত আছে অসাধারণ কিছু সংলাপ, যেমন আনোয়ার হোসেন নামের এক চাকরিজীবী তাঁর সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বাংলাদেশের জন্মই হতো না... আমাদের অনুসরণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।’ রামপুরার সাবেকুন রুনা বলছেন, ‘গর্ব হয় উনি আমাদের একজন নেতা, উনি আমাদের জাতির পিতা।’ খুবই সাধারণ করে বলা সাধারণের এই কথাগুলো কতটা অসাধারণ ও মূল্যবান তা কোন বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। একটি ২৮ সেকেন্ডের ভিডিও আছে, ৩ বছরের এক শিশু আরহাব আজাদ আরশ আপন মনে ঘরে খেলেছে আর ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিচ্ছে। নবেম্বরের ১ তারিখে দেয়া এই ভিডিওটি ৩ মাসে দেখেছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। এই ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বিকাশ ঘোষ বলছে, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’ যা দেখে দুই সপ্তাহে উদ্বেলিত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে দেয়া একটি ভিডিও চিত্র এ পর্যন্ত দেখেছেন ১.১ মিলিয়ন দর্শক। আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে বঙ্গবন্ধুকে দেশের মানুষের এত ভালবাসার তাৎপর্য, যা এই দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে মথিত, সেখানে আর উপেক্ষার কোন স্থান হবে না।
এই অনলাইন আর্কাইভ পেজের মূল বক্তব্য যাকে আমরা লিড ম্যাসেজ বলি, তা মূলত বাংলাদেশ ও বাঙালীর হৃৎকমলের উৎসারিত বাণীই, ‘বাঙালীর হৃদয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতির নাম বঙ্গবন্ধু।’ বঙ্গবন্ধুকে এই পেজে ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনার পথ বেছে নিয়ে এর উদ্যোক্তাগণ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সরল ডকুমেন্টেশনের কাজ করছেন যা গ্রামে-গঞ্জে তরুণ সমাজের জীবনে, দেশমাতৃকার জন্য তাদের দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে দর্শন ও আদর্শ নির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এই পেজ একই সঙ্গে যুক্ত আছে ইউটিউব, টুইটার ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে (https:/ww/w.bangabandhuonline.org/)। আমার বিশ্বাস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এই পেজটি ছাড়াও অপরাপর সবগুলো মাধ্যমের উপস্থাপনা অব্যাহত থাকবে। যারা এই কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন তাদের ইতিহাস অন্বেষণের মেধা ও একইসঙ্গে উপস্থাপনা গুণ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।
মার্চ মাস বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ ও ২৫ মার্চের কালরাতের ইতিহাস। বাঙালীর প্রতিটি ঘরে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা এখন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যে কোন মাধ্যমেই এই অনুপ্রেরণার ইতিহাসাশ্রয়ী উপস্থাপন বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রতিদিন নতুন গর্বের জন্ম দেয়। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন আমাদের সকল গর্ব বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ ছুঁয়ে আমাদের সোনার বাংলায় ফিরে আসবে।
লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প
[email protected]