২০০৫ সাল থেকে পালিত ‘বিশ্ব নদী দিবসকে’ সামনে রেখে যে প্রশ্নটি অনিবার্য উঠে আসে তা হলো বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা কত? বহু জনশ্রুতিতে আট শতাধিক নদীর কথা শোনা গেলেও বর্তমানে কায়ক্লেশে টিকে আছে ৭১০টি। এর মধ্যে ৩শ’ বড় নদী এবং ৪শ’ শাখা নদী-উপনদী। ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে ৫৩টি ভারত থেকে প্রবাহিত, মিয়ানমার থেকে ৩টি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবাহিত ১টি নদী। সত্যি বলতে কি, কোনটির অবস্থাই ভাল নয়। ফারাক্কা-গজলডোবাসহ নানা বাঁধ ও ব্যারাজে স্বাভাবিক প্রবাহ অবরুদ্ধ প্রায়। তদুপরি প্রতিনিয়ত দখল-দূষণে জর্জরিতÑ দেশে ও বিদেশে সমানভাবে, ভূমিদস্যু ও জনমানুষ কর্তৃক। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে নদীর প্রবাহ সচল রাখাসহ নদী রক্ষায় ন্যূনতম সচেতনতা নেই বললেই চলে। যে কারণে ইতোমধ্যেই শতাধিক নদী বিলীন হয়ে গেছে। বাকিগুলোরও যায় যায় অবস্থা। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত ৪০৫টি নদী অবৈধ দখলদারদের কবলিত হওয়ায় মানচিত্রে সেগুলোর অবস্থান প্রায় হারানোর উপক্রম। ফলে নদ-নদীকে জীবনসত্তা বলে অভিহিত করে সেগুলোকে অবিলম্বে অবমুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশও থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত।
নদ-নদী বহুল ইতিহাসখ্যাত বাংলাদেশকে আর বুঝি ‘নদীমাতৃক দেশ’ অভিধায় ভূষিত করা যায় না। কেননা, কালের প্রবাহে মানুষের অব্যাহত দখল-দূষণে অধিকাংশ ¯্রােতস্বিনী কল্লোলিনী নদ-নদীর অবস্থা মৃতপ্রায় অথবা জীবন্মৃত। ছোট ছোট নদীর কথা বাদ দিলেও বর্তমানে মেঘনা অববাহিকা বাদে একদা সুবৃহৎ কীর্তিনাশা প্রমত্তা পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের অবস্থাইবা কী? সে প্রেক্ষাপটে অন্য নদ-নদীর দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে কৃষকের। বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও পরিবেশে। মরে যাচ্ছে গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ নিসর্গ প্রকৃতি। রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে মৎস্য প্রজাতি, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্য।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী, সর্বোপরি দেশের সব নদী ও শাখা নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করে সারা বছর ধরে নাব্য রাখার জন্য সরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান তথা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে একদিকে যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমান চিরায়ত প্রকৃতি ও রূপ ফিরে আসবে, তেমনি নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ মানুষের যাতায়াতের পথ সহজ, সুগম ও সুলভ হবে। সরকার যে দেশের নদ-নদীকে সারা বছর ধরে নাব্য বজায় রেখে দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে সচেষ্ট এবং আন্তরিক তা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যায় প্রায় নিয়মিতই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। রাজধানীর বাইরেও এই উচ্ছেদ অভিযান চলমান। নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নৌপথ সচলের পাশাপাশি সারা বছর নদীর নাব্য রক্ষাসহ সেচ সুবিধা ও চাষাবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সম্প্রসারিত হবে নিঃসন্দেহে। ইলিশসহ মাছের উৎপাদনও বাড়বে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৮ শতাধিক নদ-নদী এবং ৫৭টি আন্তঃদেশীয় সংযোগ নদী রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, সিকিম, এমনকি চীনও জড়িত। সুতরাং আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা ও সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রেও এসব দেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নয়ন সহযোগী ১২টি দেশের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে ডেল্টা প্ল্যান (বিডিপি) ২১০০’ নামে যুগান্তকারী একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত এই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী এক শ’ বছরে পানির প্রাপ্যতা, এর ব্যবহারসহ প্রতিবেশ ও পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, নদী না বাঁচলে বাঁচবে না বাংলাদেশও।