ইদানীংকালে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণের অবসর গ্রহণের পরে রায় প্রদান নিয়ে অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির বিজ্ঞচিত আলাপ ও আলোচনা অহরহ শোনা যাচ্ছে এবং অবসর গ্রহণের পর যে বিস্তারিত রায় লেখা যায় না এর সম্পর্কে অনেক যুক্তি বা অপযুক্তি অহরহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ক্রমাগত আসছে।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত আইন বিশেষজ্ঞ ব্যতীত আইন বা উচ্চ আদালতের রায়, যা প্রায়শই জটিল আইনের বিষয়ের মধ্যে আবর্তিত হয়, তা নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না। তবে সাধারণ জনগণ যদি তাদের আদালত সম্বন্ধে জানতে চান বা ওয়াকিবহাল থাকতে চান তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন আপত্তি দেখি না। জনগণের টাকায় পরিচালিত বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের যে কোন বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা ও প্রয়োজনে তার সমালোচনা করা সার্বভৌম জনগণের অধিকার ও ক্ষমতাভুক্ত। তবে আমাদের দেশ এখনও উন্নয়নশীল দেশ এবং এখনও আমরা যে কোন মুদ্রিত জিনিসকে স্বতঃসিদ্ধ (sacrosanct) মনে করি। অনেকটা গল্পের সেই প-িতের মতো, যিনি মুদ্রণ প্রমাদ সত্ত্বেও মুদ্রিত শব্দকে স্বতঃসিদ্ধ বুঝাবার জন্য ছাত্রকে পড়িয়েছিলেন ‘কপাল ভাসিয়া গেল দুই নয়নের জলে/ পা দুটি বাঁধা ছিলো কদম্বেরই ডালে’। ফলশ্রুতিতে সাধারণ জনগণ সমস্ত বিষয়টি সম্পর্কে একটি ভ্রমাত্মক ধারণা পেতে পারেন। সে কারণে শুধু দেশের মালিক সাধারণ জনগণের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্যই এ প্রচেষ্টার অবতারণা।
এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও আমি বিচার বিভাগের সঙ্গে নানাভাবে বহুদিন জড়িত ছিলাম, তবে এখানে প্রদত্ত বক্তব্য শুধু একান্তই আমার ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে। অবসরের পরে বিস্তারিত রায় লেখা বেআইনী এর স্বপক্ষে যে সকল যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তার যতগুলো মনে আছে এক এক করে সেগুলো বিশ্লেষণ (ফবধষ) করা হচ্ছে।
প্রথমেই আসে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের কাজী মেহের দিন বনাম মোসাম্মাত মুরাদ বেগম (১৬ উখজ ঝঈ ১৯৬৪ ৩৯২) মামলার প্রসঙ্গটি। এ রায়টিকে উল্লেখ করে অনেক বিজ্ঞজন বলেছেন যে, লর্ড কর্নওয়ালিশ এর ঐ রায়টি দ্বারা, প্রথমত, অবসর গ্রহণের পর কোন রায় লেখা বেআইনী এবং দ্বিতীয়ত, এ রায়টি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের উপর বাধ্যকর; কাজেই অবসর গ্রহণের পর সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণ প্রদত্ত সকল রায় বেআইনী।
এখন পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের উক্ত রায়টি পর্যালোচনা করা যাক। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার যে, পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট-এ লর্ড কর্নওয়ালিশ নামে কোন বিচারক কোনকালেই ছিলেন না। যতদূর মনে পড়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিসমূহের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ভারতের গবর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি কোনদিনই পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের বিচারক ছিলেন না, বরং পাকিস্তান জন্মের বহু পূর্বেই ১৮০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট রায়টি লিখেছিলেন বিচারপতি এস.এ. রহমান। অবশ্য উক্ত বেঞ্চে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ. আর. কর্নেলিয়াস (Alvin Robert Cornelius) একজন সদস্য ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত, এ রায়টি পড়লে সংশ্লিষ্ট বিচারপতি সৈয়দ গোলাম মুর্তজা শাহ কোন তারিখে রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপব) করেছিলেন, কোন তারিখে বিস্তারিত রায় লিখেছিলেন, কোন তারিখে অবসর গ্রহণ করেছিলেন এবং কোন তারিখে তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছিলেন- কোন তারিখই বোঝা যায় না। কেননা, উক্ত রায়ে তারিখগুলো উল্লেখ করা হয়নি। অথচ উক্ত তারিখগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক (ৎবষবাধহঃ) এবং উক্ত রায়টির ৎধঃরড় ফবপরফবহফর বুঝতে হলে ঐ তারিখগুলো জানা প্রয়োজন ছিল এবং সেক্ষেত্রে ঐ রায়টি সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট অভিমত ব্যক্ত করা যেত। পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের বিশিষ্ট, বিজ্ঞ ও প্রবীণ বিচারকগণ কর্তৃক লেখা হলেও বিনীতভাবে বলব যে, রায়টিকে সুলিখিত বলা যায় না।
তৃতীয়ত, উক্ত রায়ে Code of Civil Procedure এর Order XX rule 2 এর রেফারেন্স দেয়া হয়েছে কিন্তু উক্ত ৎঁষব এর heading n‡”Q ÒPower to pronounce judgment written by judges’ predecessor’। কাজেই উক্ত ৎঁষবটি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিদের পদে থাকা অবস্থায় ফলাফল সংবলিত সংক্ষেপে ঘোষিত রায় প্রদানের ধারাবাহিকতায় অবসর গ্রহণের পরে নিজেদেরই ঘোষিত রায়টির কারণ সংবলিত বিস্তারিত রায়ের ক্ষেত্রে successor wePviK KZ©…K predecessor বিচারক কর্তৃক প্রদত্ত রায় এর ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য নয় বলে প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে, কোড্ এর উক্ত ৎঁষবটি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারকদের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থাৎ অবসর গ্রহণের পরে বিস্তারিত রায় প্রদানের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ ৎঁষব ২টি ঢ়ৎবফবপবংংড়ৎ বিচারক কর্তৃক লিখিত রায় তার ংঁপপবংংড়ৎ বিচারক কর্তৃক প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
চতুর্থত, ঈড়ফব ড়ভ ঈরারষ চৎড়পবফঁৎব-এ ঙৎফবৎ ঢখওঢ এর ৎঁষব ৩ এর ঝঁন-ৎঁষব ৫ এর বিধান অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ এর ঙৎফরহধৎু অথবা ঊীঃৎধ ঙৎফরহধৎু ঙৎরমরহধষ ঈরারষ ঔঁৎরংফরপঃরড়হ এর ক্ষেত্রে ঙৎফবৎ ঢঢ এর ৎঁষব ১-৮ রুলগুলো মোটেই প্রযোজ্য নয়। এমতাবস্থায়, পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের উক্ত রায়টি বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। আমরা সবাই যেন সেই কবিতার মতো চিলে কান নিয়ে গিয়েছে এই রব শুনে কান যথাস্থানে রয়েছে কিনা তা যাচাই না করেই অনবরত কল্পিত চিলের পেছনে দৌড়ে চলেছি।
পঞ্চমত, ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট প্রদত্ত রায়গুলো বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের উপর সাধারণভাবে বাধ্যকর হলেও সেই রায়গুলো বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট বা আপীল বিভাগের উপর একেবারেই বাধ্যকর (সধহফধঃড়ৎু) নয়। এমনকি পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টে নিজেদের রায়কে ঢ়ৎবপবফবহপব হিসেবে গৃহীত হলেও তা সবসময় বাধ্যকর ছিল না। যেমন- এৎবধঃ ইৎরঃধরহ এর ঐড়ঁংব ড়ভ খড়ৎফং বা বর্তমান ঝঁঢ়ৎবসব ঈড়ঁৎঃ ইহার যে কোন রায় ঙাবৎ জঁষব করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমান ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের কোন রায় দ্বারা বাধ্য নয় বরং আপীল বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ তাদের নিজস্ব ও স্বাধীন বিবেচনা (ফরংপৎবঃরড়হ) অনুসারে অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ষষ্ঠত, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের জঁষবং ১৯৭৩ সনে সর্বপ্রথম প্রণীত হয়। কাজেই আপীল বিভাগ কখন, কিভাবে রায় দেবে বা না দেবে তা তখন থেকে উক্ত জঁষবং দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৮ সালে The Supreme Court of Bangladesh (Appellate Division Rules) গৃহীত হয়। তৎপর, ২০০৮ সালে আপীল বিভাগের উক্ত জঁষবটি অধিকতর সংশোধিত হয়। কাজেই, অন্তত ১৯৭৩ সাল হতে আপীল বিভাগের রায় প্রদানসহ সকল কার্যক্রম আপীল বিভাগের জঁষবং অনুসারেই পরিচালিত হয় এবং রায় প্রদান বা অন্যান্য কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের কোন রায় কোন ভাবেই প্রযোজ্য হয় না।
সপ্তমত, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের বিচারকগণ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে যদি কোন বিশেষ পদ্ধতি পড়হংরংঃবহঃষু বছরের পর বছর অনুসরণ করেন তা হলে সেটিই আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হবে এবং সকলের উপর বাধ্যকর হবে। পাকিস্তান বা ভারতের সুপ্রীমকোর্টের কোন রায় বা অনুসৃত প্রথা বা বক্তব্য বা মন্তব্য এক্ষেত্রে কোনভাবেই বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট বা ইহার বিজ্ঞ বিচারকগণের উপর প্রযোজ্য হবে না এবং ইহার সার্বভৌমত্বকে খর্ব করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলাদেশে অনুসৃত কোন প্রথা বা কার্যক্রম সংবিধান বা তার আওতায় প্রণীত কোন আইন বা বিধি দ্বারা বারিত করা হয়।
সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণ কর্তৃক লিখিত বিস্তারিত রায় বেআইনী তার স্বপক্ষে পরবর্তী যুক্তি হলো যে, তাঁরা অবসর গ্রহণের পর বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির সময় ব্যক্ত শপথ বাক্যের আওতাধীন থাকেন না, শপথবহির্ভূত হয়ে যান। কিন্তু এ কথাগুলোও সত্য যে, অবসর গ্রহণের পর সংবিধানের বর্তমান ৯৯ অনুচ্ছেদ সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাঁদেরকে অনেক কাজ করা থেকেই বারিত রাখে। অন্য সকল সাধারণ মানুষের মতো তাঁরা সব কাজ করতে পারেন না। কিন্তু প্রথমেই সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকগণ কিভাবে তাঁদের কার্যক্রম অর্থাৎ শুনানি ও রায় প্রদান করেন সে সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু জানা প্রয়োজন।
একটি মামলার শুনানি অন্তে রায় হয়। অনেক সময় দিনের পর দিন শুনানি করতে হয়। তৎপর বিচারক উন্মুক্ত আদালতে রায় তার বেঞ্চ অফিসারকে ডিকটেশন দেন এবং বেঞ্চ অফিসার শর্ট হ্যান্ডে ডিকটেশন নিতে থাকেন। রায়ের শেষ ভাগে আদেশ অংশ থাকে। রায় প্রদান শেষ হলে বেঞ্চ অফিসার তার দৈনন্দিন অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে শর্ট হ্যান্ডে লিখিত রায় টাইপ শেষ করে বিচারকের কাছে খসড়া হিসেবে উপস্থাপন করে। সাধারণত এ কাজ সম্পূর্ণ করতে কয়েকদিন লেগে যায়। বিচারক মহোদয় তার অন্যান্য প্রাত্যহিক বিচারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে উক্ত খসড়া দেখে সংশোধন করেন। অবাক হলেও সত্য, ড্রাফট রায়টি অনেক সময় ৫/৬ বারও সংশোধন করার প্রয়োজন হতে পারে। এখানেই অবশ্যম্ভাবীরূপে অনেকটাই সময় লেগে যায়।
বিচারক যখন সন্তুষ্ট হন যে তিনি বা তাঁরা (ডিভিশন বেঞ্চের ক্ষেত্রে) যেভাবে বিস্তারিত কারণ সংবলিত রায়টি দিতে চেয়েছিলেন সেভাবেই রায়টি টাইপ হয়েছে, তখন নীল কাগজে রায় প্রদানের তারিখসহ টাইপ হয় এবং বিচারকগণ আবারও ভালভাবে দেখে ও পড়ে তখন তাঁর বা তাঁদের স্বাক্ষর প্রদান করেন। কাজেই উন্মুক্ত আদালতে রায় প্রদান ও উক্ত স্বাক্ষর প্রদানের মাঝখানে অনেক লম্বা সময় চলে যায়।
স্মর্তব্য যে, রায় যখনই চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত এবং স্বাক্ষর হোক না কেন, রায়ের তারিখ সব সময়ই হবে যে তারিখে উন্মুক্ত আদালতে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল সেই তারিখটি এবং তা মূল রায়ের প্রারম্ভের উপরে লিপিবদ্ধ থাকে এবং সেটিই রায়ের তারিখ। অনেক সময়, বিশেষ করে হাইকোর্ট ভ্যাকেশনে যাবার আগে বিচার প্রার্থীদের আইনজীবীগণের তাড়াহুড়া থাকে, ভয় থাকে যে বেঞ্চ বদলে যেতে পারে এবং তাতে শুনানিটাই বিফলে যাবে, কারণ পুনরায় শুনানির দরকার হতে পারে। এ কারণে অনেক সময় বিচারক বিচার প্রার্থীগণের স্বার্থ বিবেচনা করে শুনানি অন্তে রায়ের প্রাথমিক বক্তব্যের পরেই রায়ের চূড়ান্ত আদেশ অংশ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে বিচারক উক্ত আদেশের সমর্থনে বিস্তারিত রায় লেখা শেষ করেন। এভাবে রায় দিলে বিচারকের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়লেও তুলনামূলক কম সময়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।
উপরে বর্ণিত উভয়ভাবে প্রদত্ত রায়ই আইন সংগত। কারণ, ইহা বারিত করে কোন আইন বা রুলস নেই। বরঞ্চ বিচার প্রার্থীগণের স্বার্থ বিবেচনা করেই বিচারকগণ এ পদ্ধতিতে রায় চূড়ান্ত করেন। মূল কথা হল রায় ঘোষণা বা ‘ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ’ অর্থাৎ চূড়ান্ত আদেশ অংশ উন্মুক্ত আদালতে হতেই হবে। ইহাই প্রিভি কাউন্সিল ও ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টেরও মত। কিšুÍ উক্ত আদেশের স্বপক্ষে মত ব্যক্ত করার কারণাবলীসহ বিস্তারিত বক্তব্য পরবর্তীতে লেখা নিয়ে আইনগত কোন বাধা হাইকোর্ট রুলসে নেই বিধায় কোনভাবেই বারিত নয়।
অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি মনে করেন যে রায় প্রদানের পর পরই বিচারক রায়ে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু তা কখনই সম্ভবপর নয়। কারণ তাৎক্ষণিক স্বাক্ষর যদি করতেই হবে তবে বেঞ্চ অফিসার কর্তৃক লিখিত শর্টহ্যান্ডের ‘ইকড়ি মিকড়ির’ মধ্যে না বুঝেই স্বাক্ষর করতে হবে। উল্লেখ্য, এ প্রসঙ্গে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর হতে আজ পর্যন্ত যে সকল মাননীয় বিচারপতিগণ বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেছেন তাঁদের মধ্যে একজনও পাওয়া যাবে না যিনি অবসর গ্রহণের পর কোন না কোন রায় বা আদেশে স্বাক্ষর করেননি।
কোন বিচারপতি যদি মৌখিক রায় ঘোষণার পর মারা যান, সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নির্দেশ অনুসারে অন্য বিচারপতি পূর্বে ঘোষিত রায়ের আদেশটি ঠিক রেখে বিস্তারিত রায় লিখে প্রয়াত বিচারপতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন। রায়টি প্রয়াত বিচারপতির নামেই প্রচারিত করা হয়। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে কয়েকবারই ঘটেছে। একবার একজন বিচারপতি অনেক রায় মৌখিকভাবে ঘোষণা করলেও বিস্তারিত রায় লেখার পূর্বেই পদত্যাগ করেন। সেই মামলাগুলো পুনঃশুনানি না করে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অন্যান্য বিচারপতিগণ ঘোষিত রায়ের আদেশটি ঠিক রেখে বিস্তারিত রায় লিখে পদত্যাগকৃত বিচারপতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন এবং তার নামেই রায়গুলো প্রচারিত করা হয়। এবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে কি পদ্ধতিতে রায় প্রদান করা হয় তা আলোচনা করব।
রায় প্রদানসহ আপীল বিভাগের কার্যক্রম The Supreme Court of Bangladesh (Appellate Division) Rules অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। ১৯৮৮ সালের ১১ই মে তারিখে উক্ত রুলসটি বাংলাদেশ গেজেটে নিম্নরূপে প্রকাশিত হয় :
“বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৭(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, আপীল বিভাগের রীতি ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত বিধিসমূহ প্রণয়ন করে :-
১। এই বিধিসমূহ The Supreme Court of Bangladesh (Appellate Division) Rules, ১৯৮৮ নামে অভিহিত হইবে।
২। এই বিধিসমূহ ২১শে মে, ১৯৮৮ ইং/৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৫ বাংলা তারিখ হইতে কার্যকর হইবে।”
২০০৮ সালে উক্ত বিধি অধিকতর সংশোধন করা হয়। আপীল বিভাগের রায় প্রদান সংক্রান্ত বিধানগুলো উক্ত বিধির প্রথম ভাগের ১০ অর্ডার-এ বর্ণিত হয়েছে। রায় ঘোষণা সংক্রান্ত বিধানটি ১ রুলে বর্ণনা করা হয়েছে। ১ রুল নিম্নরূপ :
“The Court, after the case has been heard, shall pronounce judgment in open court either at once or on some future day, of which due notice shall be given to the parties or their Advocate-on-Record and the decree or order shall be drawn up in accordance therewith.” (অধোরেখা প্রযোজ্য)
এই বিধানেও মূল বা চুম্বক বক্তব্য হচ্ছে যে উন্মুক্ত আদালতে রায় ঘোষণা বা ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ করা হবে। Blacks Lwa Dictionary Abymv‡i Pronounce A_© ÔTo announce formally। আপীল বিভাগ তা-ই করে থাকে।
শুনানি অন্তে তাৎক্ষণিকভাবে বা ভবিষ্যত কোন এক তারিখে আপীল বিভাগ তার রায় ঘোষণা করে। সাধারণভাবে নিম্নলিখিতভাবে রায় ঘোষণা করা হয়:
I. Appeal allowed
II. Appeal dismissed
III. Appeal partly allowed
IV. Appeal allowed (or dismissed) with observations
আপীল বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ প্রয়োজন অনুসারে অন্যভাবেও রায় ঘোষণা করতে পারেন।
রায় ঘোষণার পর মাননীয় প্রধান বিচারপতি বা ঢ়ৎবংরফরহম বিচারপতি নিজেও রায় লেখার জন্য নিজেকে মার্ক করে দিতে পারেন অথবা তাঁর সঙ্গীয় অন্য যে কোন একজন বিজ্ঞ বিচারককে রায় লেখার জন্য দায়িত্ব দিতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিচারক তাঁর দৈনন্দিন প্রাত্যহিক বিচারিক অন্যান্য দায়িত্ব ও কার্যাবলীর ফাঁকে ফাঁকে উক্ত রায় ডিকটেশন দিতে থাকেন। যদি সিভিল পিটিশন হয় তবে হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে ড্রাফট শেষ হয়। কিন্তু আপীলের রায় হলে স্বভাবতই অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয়। ড্রাফটও কয়েক দফা সংশোধনের পর তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে সব থেকে কনিষ্ঠ বিচারকের কাছে প্রেরণ করেন। তিনিও তাঁর নিজের অন্যান্য বিচারিক কাজের অবসরে নিরীক্ষণ করতঃ নিজস্ব পর্যবেক্ষণসহ পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারকের কাছে প্রেরণ করেন। যে বেঞ্চে যত বেশি বিচারক থাকেন, যেমন, ২০০৯ সালে ১১ জন বিচারক ছিলেন, ড্রাফট রায়টি প্রত্যেকের কাছে যেতে হবে এবং প্রত্যেকে একই প্রক্রিয়ায় নিরীক্ষণ করবেন। যিনি ফরংংবহঃরহম রায় দেবেন তিনি সধলড়ৎরঃু বিচারকগণের রায় প্রাপ্তির পর তাঁর নিজস্ব রায় লেখেন। অনেক সময় একমত পোষণ করেও অনেক বিচারপতি নিজস্ব রায় লেখেন। আবার বিশেষ কোন আইনের মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণের জন্য বিচারকগণকে তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক সময় পড়হভবৎবহপব করার প্রয়োজনও দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট সকল বিচারককে নিয়ে একত্রে বসতেও অনেক সময় লেগে যায়।
উপরের প্যারাগ্রাফটি পড়তে দুই মিনিটের বেশি সময় প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সমগ্র কার্যক্রম শেষ করতে প্রায়শই মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, সুপ্রীমকোর্টের রায় দেশের আইন নির্ধারণ করে বিধায় বিচারকগণ সাধারণত রায় নিয়ে তাড়াহুড়া করেন না, বরঞ্চ যথেষ্ট সময় নিয়ে অধিকতর সতর্কতার সাথে (রিঃয সঁপয ফবষরনবৎধঃরড়হং) তাদের রায় চূড়ান্ত করেন। তাঁদের কাছ থেকে সকলের এটাই প্রত্যাশা (বীঢ়বপঃধঃরড়হ)।
অনেক সময় আপীল বিভাগ উপর্যুক্তভাবে উন্মুক্ত আদালতে আদেশ ঘোষণার (ঢ়ৎড়হড়ঁহপব) সঙ্গে নিজেদের বিবেচনা অনুসারে একটি সংক্ষিপ্ত আদেশও প্রদান করতে পারে। তবে তা খুব কম সময়েই করা হয়ে থাকে। সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে সংবিধান অষ্টম সংশোধনী রায়ের ক্ষেত্রে আপীল বিভাগ এই ধরনের আদেশ প্রদান করেছিল। তবে যেভাবেই রায় হোক না কেন রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ) হবে উন্মুক্ত আদালতে।
আমাদের দেশে অষ্টম সংশোধনী মোকদ্দমায় ১৯৮৯ সালে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সকলের পক্ষে সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত আদেশ অংশ ঘোষণাও তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে বসেই স্বাক্ষর করা হয়নি বা সেরকম কোন বিধানও নেই। তাও পরবর্তীতে স্বাক্ষর হয়েছে। তৎপর, পরবর্তীতে অনেক সময় নিয়ে চার জন বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দই তাদের নিজ নিজ রায় লিখেছেন, বারংবার সংশোধন করেছেন, এক এক করে সকলে পড়েছেন, সকলে একত্রিত হয়ে ঙৎফবৎ ড়ভ ঃযব ঈড়ঁৎঃ লিখেছেন। তৎপর সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অফিসে জমা হয়েছে, যদিও রায়ের তারিখ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে উন্মুক্ত আদালতে আদেশটি ঘোষণার তারিখটি। কিন্তু বিস্তারিত রায় কেউ কখনও আবার পুনরায় উন্মুক্ত আদালতে পড়ে শোনাননি বা সেরকম কোন বিধানও নেই।
কাজেই ‘ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ’ অর্থ আপীল মঞ্জুর হলো কি খারিজ হলো তা প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করা বা ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান। এর বাইরে আপীল আদালতে কোন রায় পড়ার কোন বিধান নেই। তাহলে আপীল বিভাগের ১০ আদেশের ১ রুলে ‘ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ’-এর যে কথা রয়েছে তা কি? তা কি কারণ ও ব্যাখ্যা সংবলিত বিস্তারিত রায়? নাকি শুধুমাত্র আপীল মঞ্জুর বা আপীল খারিজ বা সে সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আদেশ? এটা অবশ্যম্ভাবী যে, আপীল বিভাগের বিধির ১০ নং আদেশের ১ রুলে যে ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ-এর কথা বলা আছে তা ঐ সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কে, কবে, কখন বিস্তারিত রায় লিখল বা কখন আপীল বিভাগের অফিসে জমা হলো তা আপীল বিভাগের বিধান নিয়ন্ত্রণ করে না বিধায় এ সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকগণের নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। তবে সর্ব্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণের এই স্বাধীনতা বা ৎবষধীধঃরড়হ রাখা হয়েছে অবশ্যম্ভাবীরূপে ন্যায় বিচারের স্বার্থেই। এর অর্থ এই নয় যে বিচারকগণ স্বেচ্ছাচারভাবে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর রায় চূড়ান্তকরণ দেরি করবেন। তবে ফবপরফবফ ঢ়ড়রহঃ এ সময় কম লাগে কিন্তু সাংবিধানিক বিষয় থাকলে স্বাভাবিকভাবেই তুলনামূলক অনেক বেশি সময় লাগতে পারে। তা বিচারকগণ ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না। দেশের সুদূরপ্রসারী কল্যাণ ও প্রকৃত সাংবিধানিক চেতনা সমুন্নত রাখার স্বার্থে করেন, অন্য কোন পার্থিব বা পারলৌকিক স্বার্থে করেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্টের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ রায় ইৎড়হি ঠং. ইড়ধৎফ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ ড়ভ ঞড়ঢ়বশধ গং। এই মামলাগুলো ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে শুনানি সম্পন্ন হয় কিন্তু রায় ঘোষিত হয়নি। ১৯৫৩ সালের ৮ জুন তারিখে মামলাগুলো পুনরায় শুনানির জন্য লিস্টে (ফড়পশবঃ) আনা হয় এবং কতকগুলো নির্দিষ্ট প্রশ্ন আদালত হতে উত্থাপন করতঃ সেগুলোর উত্তরসহ ১৯৫৩ সালের ১২ই অক্টোবর পুনঃশুনানির জন্য ফড়পশবঃ-এ আসার তারিখ ঠিক করা হয়। ইতোমধ্যে ৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি ঠরহংড়হ মারা যান। নতুন প্রধান বিচারপতি হন ঊধৎষ ডধৎৎবহ। ৭ ডিসেম্বর শুনানি আরম্ভ হয়ে ১০ ডিসেম্বর শুনানি শেষ হয়। ৫ (পাঁচ) মাস পরে ১৭ মে ১৯৫৪ তারিখে শুধু তাত্ত্বিকভাবে আইন নির্ধারণী প্রশ্নে ৫/৬ পৃষ্ঠার রায় প্রদান করা হয়। কিন্তু বাদী ও অন্য সকলকে কি পদ্ধতিতে প্রতিকার দেয়া যায় সে প্রশ্নে লিখিত উত্তর ১ অক্টোবর ১৯৫৪ তারিখের মধ্যে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
ইৎড়হি ঠং. ইড়ধৎফ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ মামলার দ্বিতীয় দফা শুনানি ১১ এপ্রিল ১৯৫৫ তারিখে করা হয়। ৩১ মে ১৯৫৫ তারিখে মাত্র ৭ (সাত) প্যারাগ্রাফে ২য় রায় শেষ হয়। চলবে...
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি