ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১

মতামত

শেখ হাসিনার পতন: আওয়ামী লীগের নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি

শেখ হাসিনার পতন: আওয়ামী লীগের নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি

দীর্ঘ ১৬ বছরের সীমাহীন দুঃশাসন শেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটে, পতনের সাথে মিশে যায় অভূতপূর্ব ইতিহাস। এক সময় সাহসী ভাষণে নিজের শক্ত অবস্থান তুলে ধরলেও, বাস্তবতার চাপে পড়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। কত দম্ভ ছিল তাঁর, কত অহমিকা, সব মাটিতে মিশে গেল। মানুষের দিকে কথাগুলো এখন নিজের দিকে ফিরে ফিরে আসছে তাঁর। অনেক ঘটনারও পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মানুষকে বাড়িছাড়া করতে গিয়ে হয়ত আজ চিরদিনের জন্যই দেশছাড়া হয়ে গেলেন। এটাকে ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলার চেয়ে আমি কর্মফল বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার পথে ছাত্র আন্দোলন, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে জনগণের ক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ভারতের ওপর নির্ভরতা ও সীমান্তে বিএসএফের অত্যাচার উপেক্ষা করা তাঁর জনপ্রিয়তার আরও ক্ষতি করে। সর্বশেষ, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং শেখ হাসিনা পলায়ন করতে বাধ্য হন। রাজা লক্ষ্মণ সেনের পরে দ্বিতীয় রাজা হিসেবে পলায়ন করলেন শেখ হাসিনা। 

মতামত বিভাগের সব খবর

সৈয়দ মুজতবা আলী ॥ পাকিস্তানি এজেন্ট! ভারতের দালাল!!

সৈয়দ মুজতবা আলী ॥ পাকিস্তানি এজেন্ট! ভারতের দালাল!!

শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯২১ সালে স্কুল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে দু’জন বাচুভাই শুক্লা এবং সৈয়দ মুজতবা আলী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। হাতে লেখা তাঁদের সনদপত্র অলংকরণ করেছিলেন নন্দলাল বসু এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিশ্বভারতীর আচার্য গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতঃপর ১৯৩২-এ জার্মানির বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে ডি. ফিল. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মুজতবা আলী সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে মনুষ্যত্বের সাধনার ব্রত নিয়েছিলেন। ধর্ম নয়Ñ মনুষ্যত্বই মানুষের একমাত্র পরিচয়। এই সত্যবোধ অন্যদের মধ্যে জাগ্রত করতে হয়েছেন প্রয়াসী। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দের সেতুবন্ধনের জন্য আমরণ নিরলস সংগ্রাম করেছেন। তার রচনায় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণা, নির্জিত পরাধীন জাতির প্রতি অসীম করুণা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামী চেতনার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন, সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনায় তার আর্তি সুপ্রকাশিত। মুজতবার নিজস্ব শ্রেণিতে সাহিত্য গুরুদের উল্লেখে তার প্রমাণ বর্তমানÑ ‘আমি মুসলমান। আমার শাস্ত্রে আছে বিধর্মীর ভয়ে আল্লাহ রসুলকে বর্জন করা মহাপাপ। আমার সাহিত্যধর্মে গুরু-মুর্শীদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেভ, মাইকেল।’ তার আরেক মুর্শীদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কস্যচিৎ ভাইপোস্যের ভাষায় তিনি আপন রচনাশৈলীর দিকনির্দেশ লাভ করেছিলেন। তাই ‘বীরসিংহগ্রাম’ ‘তার তীর্থভূমি’। দু’শ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুজতবা আলীকে ব্রিটিশের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছিল। ফলে সরকারি স্কুল বর্জন করেছেন, কখনো ইংরেজের অধীনে চাকরি গ্রহণের কথা ভাবতেই পারেননি এবং যে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তিনি মনুষ্যত্ব তথা মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে কামনা করেছেনÑ ‘আমাদের যেন রাজ্য লোভ না হয়। ...পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।’ বিভাগোত্তরকালে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বরে সিলেটে এক বক্তৃতায় আলী সাহেব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেনÑ ‘পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মাও শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবেÑ... ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’ মাত্র চব্বিশ বছরের মধ্যে তার বাণীর ষাথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে জেহাদ ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের মূলমন্ত্র এবং সর্বাবস্থায় মনুষ্যত্বের জয়গানে তার লেখনী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ সাম্প্রদায়িক কাল্পনিক আচ্ছাদনে আবৃত করে তাকে লোকসমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা হয়েছে উভয় বঙ্গে। এই সম্প্রদায় পশ্চিম বাংলায় তার উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট’-এর ‘একটা ‘বুব ধিংয’ বলে অপপ্রচারে মেতে উঠেছিল। তেমনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এদেরই সমগোত্রীয়দের বিচারে তিনি ছিলেন ‘ধুতি-চাদরপরা, তিলক-কাটা এবং নামাবলী গায়ে’ ‘পৌত্তলিকতার এজেন্ট, তেত্রিশ কোটি দেবতার মুসলমান পূজারী’ ‘বাংলা ভাষার হালজামানার খ্যাতিমান লেখক!’  পশ্চিম বাংলার ঈর্ষাকাতর হীনম্মন্যজন তার জীবন বিষময় করে তুলেছিল। তেমনি এ পারের স্বধর্মীয় গোঁড়া কূপমণ্ডূকদের ক্ষমাহীন আচরণ বীভৎস কুৎসিততম রূপ ধারণ করে তাঁর প্রাণ সংহারেও ছিল অকুণ্ঠিত। এরপরেও যেটা সুখের বিষয়, আনন্দের সংবাদ, সুস্থ মনের জন্য প্রত্যাশিতÑ তা হচ্ছে এই মর্কটদের দলই ‘শেষ সত্য’ নির্দেশ করেনি। সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের সাধক মুষ্টিমেয় হলেও আছেন এবং ছিলেন। তারা নির্ভীকচিত্তে অসত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অশ্লীলতার প্রতিবাদ করেছেন, মুজতবা আলীরা বৈরী পরিবেশেও আবিষ্কার করেছেন তারা একা নন, নিঃসঙ্গ মন, সুতরাং ভরসা হারাবার কোনো হেতু নেই। আলী সাহেব পরবর্তীকালে পরম শ্রদ্ধায় দুর্দিনের বন্ধু সমমর্মীদের প্রতি তার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি বাংলার বিদগ্ধ পাঠক সমাজ তাকে হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন একান্ত আপনজন হিসেবেই। যুগে যুগে লাঞ্ছিত হলেও তাদের দুঃখের কারণ নেই। বিশেষ করে মুজতবা আলী অবগত ছিলেনÑ ‘বাঙলাদেশে একটা দল আছে। ... এ দল পরপর রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধাচরণ করে উপস্থিত অন্তঃসলীলা। মোকা পেলে বুজ্বুজ্্ করে বেরুতে চায়।’ এই ‘বুজ্বুজের’ দল বিভিন্ন সময়ে মুজতবা আলীর মর্মান্তিক মানসিক নির্যাতনের কারণ হয়েছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারই ফলে ঢাকায় স্থাপিত হয় ‘বাংলা একাডেমি’। প্রতিষ্ঠানটির মুখপত্র ‘বাংলা একাডেমি পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলে সৈয়দ মুজতবা আলী সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ পঞ্চতন্ত্র কলামে পত্রিকাটির বলিষ্ঠ উদ্যোগের প্রশংসা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সুতরাং তার আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং নিবন্ধকারদের মহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে তিনি আন্তরিক স্বাগত জানিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকায় এমন কয়েকটি প্রবন্ধ ছিল  যার মূল বক্তব্যÑ মাতৃভাষা চর্চায় বাঙালি মুসলমানের অবদান। কারণ সুস্পষ্ট। তখনো পূর্ব পাকিস্তানে সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চলছিল বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো যোগসূত্র নেই এবং ছিল না। এমনকি তাদের মাতৃভাষা বাংলা কি-না সে প্রশ্ন নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উপস্থাপন করা হতো। প্রকাশিত নিবন্ধগুলো ছিল তারই অভ্রান্ত জবাব। সম্ভবত পত্রিকা-পরিচিতিমূলক নিবন্ধটির মূল সুর উপলব্ধি করতে অসমর্থ জনৈক পাঠক মুজতবা আলীকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে ‘দেশ’-এর সম্পাদককে লেখেন, ‘এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর বিবরণ হইতে মনে হইবে যে পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য একমাত্র মুসলমানদিগেরই জিনিস। উক্ত পত্রিকার কর্মকর্তারা ভুলিয়া যাইতে চান যে হিন্দু-মুসলমানের সমবেত চেষ্টার ফলেই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। হিন্দু কবিদের নাম ইচ্ছা করিয়াই এড়াইয়া যাওয়া হইয়াছে। ...অবশ্য কেহ যদি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতার সর্বনাশা সীমারেখা টানিতে চান সে কথা স্বতন্ত্র।’ পত্রিকাটির পীঠস্থান এবং সেখানকার সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হলে সম্ভবত তিনিও পত্রিকাটিকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেন। ১৯৬৪ সালের ৩ অক্টোবর, আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে মুজতবা আলীর একটি ‘সত্য ঘটনামূলক’ কথিকা ‘কোষ্ঠী-বিচার’ নামে প্রচারিত এবং শারদীয় বেতার জগতে গল্পাকারে প্রকাশিত হয়। বন্ধুপত্নী রাধারানী মুখোপাধ্যায় তার কনিষ্ঠা ভগ্নি সরজু গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্ভাগ্যের কাহিনী আলী সাহেবকে শুনিয়েছিলেন। সরজু দেবীর স্বামী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা বর্ষণে বোম্বাই বন্দরে নিহত হন। ঘটনাটি অত্যন্ত নৈপুণ্য এবং সহৃদয়তার সঙ্গে মুজতবা আলী তুলে ধরেছেন ‘কোষ্ঠী-বিচার’এ। ভাগ্যাহত সরজুই হচ্ছে কোষ্ঠী-বিচারের মাধুরী এবং বোম্বাই বন্দর রূপান্তরিত হয়েছে মাদ্রাজেÑএইটুকু মাত্র পরিবর্তন। কথিকাটি শ্রবণ ও পাঠ করে জনৈক বিক্ষুব্ধ শ্রোতা-পাঠক ২৪ অক্টোবর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখেনÑ ‘এরূপ একটি জাতিবিদ্বেষমূলক কথিকা (বেতার জগতে গল্প) প্রচার ও প্রকাশ মোটেই সমীচীন হয়নি, যখন ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। যে কোনো হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক ....লেখকের এই হিন্দু বিদ্বেষমূলক আচরণে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ হবেন। লেখক সাহিত্যের মধ্যে অশ্লীলতাকে যে কিভাবে স্থান দিলেন এবং আবার তা বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে অনুমোদন করলেন, তা চিন্তার কথা। ... হিন্দু ও বাঙালির দেব-দেবীর পূজার উপর লেখকের বিদ্বেষ ও বিদ্রƒপ-কটাক্ষ মোটেই সহ্য করা যায় না। ....‘ওঁয়ারা তো ছিলেন, এঁয়ারাও এসে জুটলেন।’ এই রূপে হিন্দু দেবতা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যকর মন্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? ... এ রকম সাম্প্রদায়িক অসৎ মনোভাবের পরিচয় আরও মেনে।....এরূপ অশালীন ও ধর্ম বিদ্বেষমূলক ‘গল্প’ ‘বেতার জগৎ ও বেতার কর্তৃপক্ষ কী করে প্রকাশ ও প্রচার করলেন।’ ‘মুজতবা আলীর এমন চমৎকার একটি কথিকার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আবিষ্কার করার দৃষ্টান্তে’ ‘স্তম্ভিত’ বিশিষ্ট সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী তীব্রতম ভাষায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তার নয়টি শাণিত যুক্তির অন্যতমÑ ‘আচারসর্বস্বতা যদি হিনডুইজম হয় তাহলে তাতে প্রথম আঘাত হেনেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। সতীদাহ যদি হিনডুইজম হয় তাহলে রামমোহন রায় তার অপমান করেছেন। চিরবৈধব্য রক্ষা যদি হিনডুইজম হয় তাহলে তার ওপর আঘাত হেনেছেন বিদ্যাসাগর। পুরোহিত প্রথা যদি হিনডুইজম হয় তবে বিবেকানন্দ ‘আগে পুরোতগুলোকে দূর কর’ বলে তাকে অপমান করেছেন।’ সবক’টি যুক্তি উপস্থাপন করে মোক্ষম বান ছুড়ে পরিমল গোস্বামী লক্ষ্য ভেদ করেছেনÑ‘আলোচ্যমান গল্পের লেখকের নাম আলী না হয়ে কোনো দেবশর্মা হলে কোনো প্রশ্নই উঠতো না।’ একটি পত্রে মুজতবা আলী একই প্রসঙ্গে পরিমল গোস্বামীকে লিখেছিলেন, ‘ঢাকায় একটি কাগজে বফরঃড়ৎরধষ রূপে সিরিয়াল  বেরুচ্ছেÑ আমি হেঁদু হয়ে গিয়েছি।....ওরা বলে আমি কাফের, এরা বলে আমি নেড়ে। ভালোই রাইকুল শ্যামকুল দুই-ই গেল। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ’৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুজতবা আলীকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ’৬৫ সালে বিশ্বভারতীর চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে বোলপুরের নিচাপট্টিতে চলে আসেন। শান্তিনিকেতনে মুজতবার বিরোধী পক্ষ একটা ছিল। এরাই রটিয়ে দিলো ‘পাকিস্তানি গুপ্তচর’ হিসেবে মুজতবা আলীকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। গুজবটি দিল্লিতেও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ূন কবীর সাহেবের কন্যা সাগরময় ঘোষকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। ১৩ এপ্রিল, ১৯৭৪-এ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকর ‘তুলনাহীন মুজতবা আলীতে’ লিখেছেন ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় অনেকে রটিয়েছে আলী সাহেব পাকিস্তানের সাপোর্টার।’ অতঃপর তার জিজ্ঞাসা, ‘এপার বাংলায় আমরাও বা কী দিতে পেরেছি তাকে।’ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর পশ্চিম বঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় স্মৃতিচারণ করেছেনÑ ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঠিক তিনদিন আগে দিল্লিতে একটা টেলিফোন এলো। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। টেনিফোন করছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি আবদুস সাত্তার। সাত্তার সাহেব বললেন, তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন যে, সেই রাত্রিতেই নাকি পশ্চিমবঙ্গের সব বিশিষ্ট মুসলমানদের গ্রেপ্তার করা হবে। আমি খবরটা শুনে বিস্মিত হলাম। ...আমি তখন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এরপর আমি প্রথম যে কাজটা করলাম তা হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে ওই রাত্রিতেই টেলিফোন করে (পশ্চিমবঙ্গে তখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে) রাজ্যপালকে বললাম, ‘আপনি সাময়িকভাবে গ্রেপ্তারের আদেশ মুলতবি রাখুন; প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমি আবার আপনাকে ফোন করছি।’ তখন মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত। ...গিয়ে শুনলাম ইন্দিরা ঘুমোচ্ছেন। আমি খুব জরুরি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুনেই ইন্দিরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি ওঁকে সব কথা বললাম। শুনে প্রধানমন্ত্রী স্তম্ভিত। ...সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের। তারা জানালেন, গ্রেপ্তারের আদেশের খবর সত্যি। ...শুনে ইন্দিরা রাগে ফেটে পড়লেন। অবিলম্বে এই আদেশ রদ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে অফিসারদের নির্দেশ দিলেন। সেদিন ইন্দিরা বিরক্ত হয়েছিলেন সেই সব সঙ্কীর্ণমনা আমলার ওপর যারা এই আদেশ দিয়েছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিকে তোয়াক্কা না করেই।’ সুতরাং ১৯৬৫ সালের রটনা কিংবা মুজতবা আলীর নজরবন্দির ‘গুজব’ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে অগ্রাহ্য করা চলে না। এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষ্যÑ ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় শান্তিনিকেতনের কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বিদেশী অর্থাৎ পাকিস্তানের দালাল বলে মুজতবা আলীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে চেষ্টা করে। প্রতিটি সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক এজন্য লজ্জিত না হয়ে পারে না। বস্তুত মুজতবা কখনো শান্তিনিকেতন তথা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যেতে চাননি। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও তিনি কোলকাতায় বাস করারই পক্ষপাতী ছিলেন। যদিও শারীরিক কারণে তাকে যেতে হয়েছিল।’ ‘ধাপ্পাবাজদের’ বিরুদ্ধে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন সাগরময় ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী, গৌরি আয়ুব প্রমুখ বিশিষ্টজন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও এক শ্রেণি মুজতবা আলী সম্পর্কে নানাবিধ অপপ্রচারে আত্মসুখজনিত তৃপ্তি পেতো এবং তাদের অপকর্মটি চলেছে ধর্মের নামে। এদের সাফল্য-অসাফল্যের চেয়েও ভয়াবহ সত্যটি হলোÑ আলী সাহেব এ দেশে থাকলে আক্ষরিক অর্থেই এই পাষণ্ডদের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হতো, যেমনটি বাংলাদেশের বহু সুসন্তানের ভাগ্যে ঘটেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে। প্রাক্্ স্বাধীনতাকাল থেকে উত্তর-স্বাধীনতা সময়েও সৈয়দ মুজতবা আলী সংস্কৃত-আরবি-ফারসি ভাষা এবং টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রাসাগুলো রক্ষার জন্য এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের জীবনধারার মানোন্নয়ন করে দেশীয় ঐতিহ্য ও বৈষম্যের ধারাকে চলিঞ্জু রাখার উদ্দেশ্যে কী আপ্রাণ মসীযুদ্ধ চালিয়েছিলেন! আর এই ‘রামপন্টক যে গুহ্য তথ্যের সন্ধান পেলেন তা হলো, পরম বৈদান্তিক আহ্লাদে একেবারে বাগ্বাগ করে বগল বাজিয়ে সৈয়দ সাহেব সবাইকে সংবাদ দিচ্ছেন-‘রাষ্ট্রভাষা হিন্দি তার শব্দভাণ্ডার থেকে লাথি ঝাঁটা মেরে আরবি-ফারসি শব্দ বের করে দিচ্ছেন।.... তার যত আক্রোশ কেবল বেচারা আরবি-ফারসি শব্দাবলীর ওপর।... তিনি তার হিন্দিওয়ালাদের আরবি-ফারসি বিতাড়নে যে প্রক্রিয়ার এবং যে উপকরণের উল্লেখ করেছেন, তাতেই আরবি-ফারসি সম্বন্ধে তার মনোবৃত্তির পরিষ্কার ছায়াপাত ঘটেছে। মুজতবা-জননীর সমাধি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার শহরে। জীবদ্দশায় যে দেশে বাস করতে পারেননি, যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি, জীবনান্তে সেই দেশেরই মৃত্তিকায় মাতৃসান্নিধ্যে অন্তিমশয্যা গ্রহণের বাসনা এবং ড. আলীর বহু কামনা-বাসনার মতো তার অন্তিম ইচ্ছাটিও অপূর্ণ। তবে আমাদের সান্ত্বনা এতটুকু যে, সৈয়দ মুজতবা আলী আজীবন মাতৃভাষার সেবা করেছেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন অগ্রণী সৈনিক, মৃত্যুর পরে তার শেষ শয্যা রচিত হয়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ আবুল বরকত ও শফিকুর রহমানের পাশে।

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার দিনরাত

সারাদেশে গত শনিবার বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ অভিযানের কথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।  এতে আরও বলা হয়, গত শুক্রবার রাতে পতিত স্বৈরাচারের সন্ত্রাসীদের হামলায় কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। গাজীপুরে শুক্রবার গভীর রাতে মারধরের শিকার হন ১৫-১৬ জন। তাঁদের প্রায় সবাই শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, আহত শিক্ষার্থীরা শুক্রবার রাতে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়িতে ডাকাতির খবর পেয়ে তা প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের মারধর করা হয়। এ ঘটনার পর দিনভর গাজীপুরে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাঁদের বিক্ষোভের মুখে গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

সংস্কার প্রতিবেদন

সংস্কার প্রতিবেদন

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে শনিবার সন্ধ্যায় এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠন করেন ৬টি সংস্কার কমিশন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের প্রধান করে সংশ্লিষ্ট কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে লিখিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ছিল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন। এর পরই সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে  আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ৬টি কমিশনের সুপারিশের আলোকে চলতি মাসের মাঝামাঝি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু হবে আলাপ-আলোচনা। সেসব বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র মেরামতের মৌলিক শর্ত পূরণ করতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার অতি জরুরি, সেগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদায় নিতে ইচ্ছুক অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তিন ভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। একটি হলো আশু করণীয়। দ্বিতীয়টি হলো মধ্যমেয়াদি। তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদিগুলো নির্বাচন পরবর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে। জরুরি করণীয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হবে নির্বাচনের আগে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি ৫টি কমিশনের আশু করণীয় কিছু সুপারিশ রয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিটি সুপারিশ গ্রহণ করা হবে কিনা, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ছয় কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’Ñ যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এই কমিশন রাজনৈতিক দল এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে। এরপর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের দাবি ওঠে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনমনে রাষ্ট্র সংস্কারের যে গভীর আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিষয়ক, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কারে বিভিন্ন খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এ ধরনের কমিশন গঠন অপরিহার্য। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে যে কয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের কাছে প্রত্যাশাÑ সংস্কার যেন কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য না হয়, সবার জন্য হয়। সেই সঙ্গে তাদের সুপারিশমালায় যেন জনআকাক্সক্ষা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায় এবং অধিকাংশের মতের প্রতিফলন ঘটে।

অপারেশন ডেভিল হান্ট

অপারেশন ডেভিল হান্ট

বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরমতসহিষ্ণুতার বড়ই অভাব। মতাদর্শিক ভিন্নতায় দলে দলে কোন্দল, অভ্যন্তরীণ দলীয় বিবাদ ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপসংস্কৃতি চলমান বহুকাল থেকে। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যৌথ বাহিনীর অংশগ্রহণে চলছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। সম্প্রতি গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর পতিত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার এ ঘটনায় সংগঠনের জেলা আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ মোহিত বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী আমজাদ মোল্লাকে প্রধান আসামি করে, ২৩৯ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। সারাদেশে ১৩০৮ জন গ্রেপ্তার, আইনশৃঙ্খলার নিবিড় পর্যবেক্ষণে সেন্ট্রাল কমান্ডের যাত্রা শুরু। ডেভিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর ধীরাশ্রম দাক্ষিণখান এলাকায় সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ খবর শুনে গাজীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের নেতারা হামলা প্রতিহত করতে যান। এ সময় স্থানীয় মসজিদের মাইকে ‘মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে’ ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালে একদল লোক বাড়িটি ঘিরে ফেলেন এবং শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে ১৫ জনকে গুরুতর আহত করে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাথার পেছনে ও ঘাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের দাবি, তাদের হত্যার উদ্দেশ্যেই এই নৃশংস  হামলা করা হয়েছে। ডিবি অফিসের সামনে মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীর গুলিতে এক ছাত্র আহত হন। পুলিশকে তৎক্ষণাৎ জানিয়েও ত্বরিত সাহায্য পায়নি ছাত্ররা। এ ঘটনায় গাজীপুর সদর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ক্ষমা চেয়েছেন পুলিশ কমিশনার। পুলিশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী কিন্তু পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েও কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ বহুকালের, কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও যে নেই তাও নয়। আমাদের সন্তানতুল্য নিরীহ ছাত্রদের সুরক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আহত ছাত্রদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।      নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৫ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বুলডোজার কর্মসূচি চালায়। এরপর বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও বিতর্কিত  নেতাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে চারদলীয় জোট সরকার ২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর গভীর রাতে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে। মোট ৮৪ দিনের অভিযানে ১২ হাজার গ্রেপ্তার, ২ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৩০ হাজার গুলি উদ্ধার হয়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশন ক্লিনহার্টে ৪০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়, যার এক-তৃতীয়াংশ বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মী। এ অভিযানে আওয়ামী লীগের কিছু সন্ত্রাসীও নিহত হয়। নিকট ইতিহাসের এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ড. ইউনূস সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অপারেশনে একজন নিরীহ মানুষও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, কোনো অবস্থাতেই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার হারলে, হারবে বাংলাদেশ, জিতবে স্বৈরাচার। এমনটি আমাদের কাম্য নয়।

সংক্রামক রোগে সতর্কতা

সংক্রামক রোগে সতর্কতা

অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার তিনশ’ পঞ্চাশজন লোকের বসবাস। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে চারশ’ বিরানব্বই জন লোকের বাস। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি তুলনা করি তাহলে দেখা যায়, তা যথাক্রমে  মাত্র আটত্রিশ জন, ৩.৫ জন এবং ৪ জন মানুষ প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে। তাহলে বুঝতেই পারছেন মানুষের বসবাসের ঘনত্ব আর জীবনযাত্রার মান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে কেমন বা কতটা উন্নত। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে। ৫ম স্থানে রয়েছে  মালটা, ৪র্থ স্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। একইভাবে ৩য়,  ২য় এবং ১ম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাহরাইন, সিঙ্গাপুর এবং সানাকো। সংক্রামক রোগগুলো বেশি লক্ষ্য করা যায় অপরিচ্ছন্ন, দূষিত পরিবেশে বসবাসরত মানুষের মাঝে। যাদের আবাসিক অবস্থান অতটা উন্নত নয়। নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ জীবাণু ও জীবাণুর বাহকের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। পরিবেশ যত দূষিত হবে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ততই বৃদ্ধি পাবে। সব দিক বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সংক্রামক রোগ-ব্যধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। পরিবেশ দূষণ, জীবন যাপনের মান নিম্নমানের, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের অভাব, স্বাস্থ্য-সচেতনতার অজ্ঞতা, খাবার-দাবার তৈরি, পরিবেশন ও গ্রহণের যে মান রক্ষা করা প্রয়োজন তার স্বল্পতা বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে সংক্রামক রোগের এক অভয়ারণ্যের দিকে। অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিবেশও অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে জীবাণু ও বাহকের অস্তিত্ব রক্ষায়। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে বাহক এবং বাহকের পরিবেশ,  জীবাণু এবং পোষকÑ এদের সধ্যে একটি সুন্দর ও ছন্দময় সুসম্পর্ক থাকে। যদি পরিবেশের উপাদানগুলো বাহকের অনুকূলে থাকে তবে বাহক যেমন অতি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবাণুকে বহন করতে পারে তেমনি জীবাণুও অতি সহজেই তার রেপ্লিকেশন ঘটিয়ে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে মৃত্যু হার বাড়িয়ে দেয়। সেই জন্য পোষক-বাহক- জীবাণুু- পরিবেশ সম্পর্ক বোঝা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এই দেশে ঋতু-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, সূর্যের আলোর তীব্রতা, বাতাসের গতিবেগ প্রভৃতি পরিবেশগত উপাদানের তারতম্য ঘটে। এই তারতম্যের কারণে কখনো বাহকের বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়, আবার কখনো জীবাণুর সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পায়। একইভাবে পরিবেশের দূষণ যেমন জীবাণুর-কর্মক্ষমতা বা সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, তেমনিভাবে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। এই সত্যতা সবাইকে সার্বিকভাবে উপলদ্ধি করেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত হওয়ার হাত হতে নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে নিজেকেই। তাই নির্দিষ্ট সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত এবং নিজ নিজ পরিবেশগত কাঠামোর ভিত্তিতে প্রণীত গাইডলাইন অনুযায়ী সকল প্রকার বিধিনিষেধ মেনেই চলতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় ডেঙ্গু-ভাইরাস একজনের শরীর থেকে অন্য শরীরে পরিবাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাহকের ভূমিকাই প্রধান। তাই বাহকের হাত হতে সুরক্ষার জন্য অবশ্যই মশার প্রজনন প্রক্রিয়া অর্থাৎ জীবন চক্রের ধারা বা জীবন চক্রের ধাপগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। অর্থাৎ বাহক নামক এডিস মশকীর জীবন চক্র ও প্রজনন স্থল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। মশকীর আচরণ, মরফোলজি বা শরীরের বাহ্যিক গঠন, ডিম পাড়ার ধরন, স্থান এবং সানুষের সংস্পর্শে আসার সময় ও সংবেদনশীলতা প্রভৃতি বিষয়গুলো জানতে পারলেই ডেঙ্গুব বাহককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ডেঙ্গুব বাহক নিয়ন্ত্রণে এলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে। আমরা জানি, এখন ডেঙ্গু শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার যে ২টি প্রজাতিÑ এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস এখন সমানতালে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। ২০২৪ সালের প্রি- মুনসন এবং মুনসন এডিস মশা জরিপে শহরে এডিস ইজিপ্টি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এডিস এলবোপিকটাসÑ এর ঘনত্ব লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কৃত্রিম প্রজনন স্থল যেমনÑ নারিকেল মালাই, নির্মাণাধীন বিল্ডিংÑ এর নিচে ফ্লাডিং ফ্লোর, জমানো পানি, কনটেইনার, টায়ার,  অথবা বহুতল ভবনের পানির পাম্প প্রভৃতিতে এডিস ইজিপ্টির উপস্থিতি অত্যন্ত বেশি ও উদ্বেগজনক। প্রাকৃতিক উৎস যেমনÑ কচুগাছ, কলাগাছের পাতার এক্সাইল, গাছের ছিদ্র বা কুঠুরি, ব্যাম্ব ট্রাম্প প্রভৃতির মধ্যে এডিস এলবোপিকটাস এর ঘনত্ব বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে উভয় প্রজাতিই ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে চলেছে। সেইজন্যই আর শহর ও গ্রামাঞ্চলে আক্রান্ত মশার ঘনত্ব নির্র্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তা হলো গ্রামাঞ্চলে পড়ে থাকা এডিস এলবোপিকটাস কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত সহজ। এখন যোগাযোগ মাধ্যম অত্যন্ত সহজ হওয়ার ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চলাচলে অত্যন্ত সহজেই গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। এই আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যখন এডিস এলবোপিকটাস পান করে তখন খুব সহজেই মশাটি আক্রান্ত হয় এবং সমান্তরাল ও ভার্টিক্যালÑ দুদিকেই ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করে। ভার্টিক্যাল বিস্তার অর্থাৎ, এক জেনারেশন হতে অন্য জেনারেশনে বিস্তার লাভ খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলে। এটা আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে যথার্থ কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের অভাবে। পুরোপুরিভাবে যদি আক্রান্ত রোগের রোগীর সত্যিকারের ঠিকানা অনুসন্ধান করা না যায়, তাহলে বিনা বাধায় আক্রান্ত মশা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াবে। এক্ষেত্রে যেমন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, একইভাবে বাড়ছে আক্রান্ত মশার সংখ্যা। বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্ত এলাকা। ক্রমেই সংক্রামিত মশা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নির্বিঘ্নে বাড়িয়ে চলছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন রোগীর প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগ। নিজ নিজ দায়িত্বে নিজের এলাকায় সকল অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সমন্বিতভাবে আই পি এম এবং আই ভি এম এর সমন্বয়ে আইপিভি-এ অর্থাৎ, সমন্বিত বালাই ও বাহক ব্যবস্থাপনা জরুরি। বাঁদুড় দ্বারা একইভাবে শীতকালে নিপাহ ভাইরাসের যে প্রাণঘাতী আবির্ভাব, মূল্যবান জীবন কেড়ে নিচ্ছে তা  থেকে পরিত্রাণের উপায় হলোÑ সচেতনতা। কাঁচা খেজুর রস বাঁদুড়ের বিষ্টা হতে রক্ষা করা এবং কাঁচারস পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাঁদুড়ের দ্বারা অর্ধ-খাওয়া ফল কখনই খাওয়া যাবে না। রস উৎসবসহ এমন সামাজিক উৎসবগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের মতো দেশের মানুষদের মধ্যে সংক্রামক রোগের বিস্তার খুব সহজেই হতে পারে উন্নত দেশগুলোতে তত সহজে সম্ভব নয়। তাই সচেতনতার বিকল্প নেই। রোগের জীবান বা প্যাথোজেনের যেমন আধিক্য তেমনি বাহকের আধিক্য ও তৎপরতা ব্যাপক। পানিবাহিত, বায়ুবাহিত, খাবারবাহিত সংক্রামক রোগগুলোর বিস্তার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের যে পরিমাণ ডার্স্ট পার্টিক্যাল রয়েছে তা শুধু সংক্রামক রোগই ছড়াচ্ছে না, অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এনসিডি বা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ছড়াতেও। সিওপিডি, ল্যাং ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট-ডিজিজসহ অসখ্য মারাত্মক রোগ ছড়াচ্ছে। এতে মানুষের আউট পকেট এক্সপেনডিচার-অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের মানুষের অতি দারিদ্র্যতার মূল কারণ ২টি । একটি হলো মামলা সংক্রান্ত ব্যয় এবং অন্যটি হলো চিকিৎসা ব্যয়। পরিবর্তিত পরিবেশে আমরা যদি সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে রোগ-জীবাণ প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ইমার্জিং এবং রি-ইমার্জিং হতেই থাকবে। মূলবান জীবন অকাতরে ঝড়তে থাকবে। তাই আসুন ভয় বা গুজবে কান না দিয়ে নিজেকে সচেতন করি এবং অন্যকে সতর্ক হতে উদ্বুদ্ধ করি। একটি সুস্থ সাবলীল  সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলি।

সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের আধুনিক পদ্ধতি

সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের আধুনিক পদ্ধতি

মাইক্রোসার্ভিসেস আর্কিটেকচার সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে ছোট এবং স্বাধীন পরিষেবাতে ভাগ করার একটি পদ্ধতি। প্রতিটি সার্ভিস একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক ফাংশন বা লজিক সম্পাদন করে এবং অন্যান্য সার্ভিসগুলির সঙ্গে API বা মেসেজ কিউ ব্যবহার করে যোগাযোগ করে। ঐতিহ্যগত মনোলিথিক আর্কিটেকচারে পুরো অ্যাপ্লিকেশনটি একটি ইউনিট হিসেবে চলে, যা কোড বেসটিকে অত্যন্ত জটিল করে। ফলে একটি ছোট পরিবর্তনের জন্য সমগ্র সিস্টেম আপডেট করতে হয় এবং আপডেট প্রক্রিয়া চলাকালীন পুরো সিস্টেমটিকে নিষ্ক্রিয় রাখতে হয়। অন্যদিকে, মাইক্রোসার্ভিসেস আর্কিটেকচারে প্রতিটি সার্ভিস স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। ফলে পুরো সিস্টেম আপডেট করা এবং আপডেট প্রক্রিয়া চলাকালীন সম্পূর্ণ সিস্টেমটিকে নিষ্ক্রিয় রাখার প্রয়োজন হয় না। এতে সিস্টেমের কর্মক্ষমতা এবং পরিষেবা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের জটিলতা এবং রিকোয়ারমেন্ট বৃদ্ধি প্রথাগত মনোলিথিক আর্কিটেকচারের সীমাবদ্ধতাগুলো স্পষ্ট করে তুলছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় সফটওয়্যার সিস্টেমগুলোর জন্য উচ্চ রিকোয়ারমেন্ট, কার্যক্ষমতা, সহজে পরিবর্তনশীল এবং উন্নত স্কেলেবিলিটির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই প্রয়োজন মেটাতে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার একটি আধুনিক টেকনিক, যা বড় সফটওয়্যার সিস্টেমকে ছোট এবং স্বাধীন পরিষেবাগুলোর মধ্যে ভাগ করে, যেখানে প্রতিটি পরিষেবা একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে এবং অন্য পরিষেবাগুলো থেকে আলাদা থাকে। এই পদ্ধতি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টকে আরও সহজ করে তোলে এবং উন্নত স্কেলেবিলিটি ও দ্রুত ডেলিভারির সুযোগ তৈরি করে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের ব্যবহার সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট আর্কিটেকচারের বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জটিল সফটওয়্যার সিস্টেমগুলিকে আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার প্রয়োজনে নতুন কৌশলগুলোর উদ্ভব হয়েছে। যদিও এর শিকড় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শুরুর দিকে পাওয়া যায়, তবে এর বিকাশ শুরু হয় ২০০০ সালের গোড়ার দিকে। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন- আমাজন এবং নেটফ্লিক্স তাদের সফটওয়্যার সিস্টেমে মাইক্রোসার্ভিস ধারণা বাস্তবায়ন শুরু করে। তারা বুঝতে পারে যে, মনোলিথিক পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, যা সিস্টেম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। নেটফ্লিক্স তাদের শুরুর পর্যায়ে মনোলিথিক পদ্ধতি ব্যবহার করত। তবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ার কারণে তাদের সিস্টেম বারবার ক্রাশ হচ্ছিল। এই সমস্যার সমাধানে তারা ২০০৯ সালে তাদের সিস্টেমকে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে রূপান্তর করতে শুরু করে। নেটফ্লিক্সের এই পদক্ষেপের কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়। ঠিক একই সময়ে, আমাজন তাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে ছোট ছোট পরিষেবায় ভাগ করে, যেখানে প্রতিটি পরিষেবা একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে। ২০১৩ সালের পর Docker এবং Kubernetes- এর মতো কন্টেইনার প্রযুক্তি মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রযুক্তিগুলো মাইক্রোসার্ভিস ভিত্তিক সিস্টেমের ডিপ্লয়মেন্ট এবং স্কেলিং প্রক্রিয়াকে সহজ ও কার্যকর করে তুলে, যা ডেভেলপারদের জন্য সময় ও শ্রম সাশ্রয়ী সমাধান প্রদান করে।   বর্তমানে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার সফটওয়্যার উন্নয়নের মূলধারার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। এটি ক্লাউড-নেটিভ আর্কিটেকচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখন মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোও মাইক্রোসার্ভিস গ্রহণ করছে। কারণ এটি উন্নত স্কেলেবিলিটি ও রেজিলিয়েন্স নিশ্চিত করে। বর্তমানে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার সফটওয়্যার উন্নয়নের মূলধারার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব কোডবেস ও ডেটাবেস ব্যবহার করে। ফলে এটি অন্য কোনো পরিষেবার ওপর নির্ভর করে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে ‘প্রোডাক্ট ক্যাটালগ’ এবং ‘পেমেন্ট গেটওয়ে’ দুটি পৃথক পরিষেবা হতে পারে। একটি পরিষেবার পরিবর্তন বা আপডেট করলে অন্য পরিষেবা এতে প্রভাবিত হয় না। প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক সমস্যার সমাধান করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশনে ফান্ড ট্রান্সফার, ব্যালেন্স চেক এবং লোন অ্যাপ্লিকেশন আলাদা মাইক্রোসার্ভিস হতে পারে। এভাবে ডিজাইন করলে সফটওয়্যার পরিবর্তন এবং ব্যবসার চাহিদা অনুযায়ী সহজ হয়। প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস আলাদাভাবে ডিপ্লয় করা যায়। এটি সফটওয়্যার এর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ করে। কোনো নির্দিষ্ট সার্ভিসকে আপডেট করতে চাইলে খুব সহজে তা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, নেটফ্লিক্স তাদের মাইক্রোসার্ভিসে নতুন ফিচার যুক্ত করতে পারে ব্যবহারকারীদের কোনো অসুবিধা ছাড়াই। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার স্কেলেবিলিটির জন্য আদর্শ। নির্দিষ্ট পরিষেবা আলাদাভাবে স্কেল করা সম্ভব, যা সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, পেমেন্ট প্রসেসিং পরিষেবার চাহিদা বাড়লে কেবল সেই অংশটি স্কেল করা যায়। প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস ভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা প্রযুক্তি স্ট্যাক ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি  সার্ভিস C++ দিয়ে তৈরি হতে পারে, অন্যটি javascript বা লধাধ দিয়ে। এটি ডেভেলপারদের পছন্দমতো প্রযুক্তি ব্যবহার করার স্বাধীনতা দেয়। প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস নিজস্ব ডেটাবেস ব্যবহার করা যায়। মানে প্রতিটি সার্ভিসের জন্য আলাদা ডাটাবেস ব্যবহার করা যায়। ফলে এটি ডেটার সামঞ্জস্যতা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সার্ভিস MongoDB ব্যবহার করতে পারে, আরেকটি PostgreSQL। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ডেভঅপস পদ্ধতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি কন্টেইনার প্রযুক্তি (যেমন Docker Ges  Kubernetes) ব্যবহার করে অটোমেশনকে সহজতর করে তোলে। ফলে CI/CD(Continuous Integration/Continuous Deployment) প্রক্রিয়াগুলো আরও কার্যকর হয়, যাতে ডেভেলপারদের জন্য খুবই সুবিধা হয়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো রেজিলিয়েন্স। যদি কোনো একটি পরিষেবা ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি পুরো সিস্টেমকে অকার্যকর করে না, অন্যান্য পরিষেবাগুলি চালু থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ইমেইল সার্ভিস’ ব্যর্থ হলে ‘অর্ডার প্রসেসিং’ পরিষেবা অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে ইউজাররা তাদের প্রয়োজনুযায়ী বাকি পরিষেবগুলো পেয়ে থাকে। মাইক্রোসার্ভিসগুলো অচও এর মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এটি পরিষেবাগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজ, সিকিউর এবং কার্যকর করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ‘অর্ডার ম্যানেজমেন্ট’ সার্ভিস অচও ব্যবহার করে ‘ইনভেন্টরি’ সার্ভিসের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে পারে।   প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস ছোট এবং নির্দিষ্ট কাজের ওপর ফোকাস করে। এটি ডেভেলপমেন্ট, টেস্টিং এবং ডিপ্লয়মেন্ট দ্রুততর করতে সহায়তা করে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে, যেগুলো সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টকে আরও সহজ এবং কার্যকর করে তোলে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো এটি অত্যন্ত স্কেলেবল। বড় সফটওয়্যার সিস্টেমে, প্রতিটি সার্ভিস আলাদা হওয়ায় নির্দিষ্ট সার্ভিসগুলোকে আলাদাভাবে স্কেল করা যায়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে প্রতিটি সার্ভিস ছোট ছোট অংশে বিভক্ত এবং সেগুলো আলাদাভাবে কাজ করে। ফলে একাধিক টিম একযোগে বিভিন্ন সার্ভিসের ডেভেলপমেন্টর এবং আপডেটের কাজ করতে পারে। এটি ডেভেলপমেন্টের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং প্রজেক্টের দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে প্রতিটি পরিষেবা ছোট এবং নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি। এর ফলে, কোনো একটি পরিষেবায় সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব এবং সমাধান করা যায়, যা পুরো সিস্টেমের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। ইউজাররা বাকি সেবা গুলো নির্বিঘ্নে পেতে পারে। মাইক্রোসার্ভিস পদ্ধতিতে প্রতিটি সার্ভিস আলাদাভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, ফ্রেমওয়ার্ক বা টেকনোলজি স্ট্যাক ব্যবহার করতে পারে। এটি ডেভেলপারদের সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং সর্বোত্তম প্রযুক্তি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে যদি একটি সার্ভিস ব্যর্থ হয়, তবে পুরো সিস্টেম অকার্যকর হয়ে যায় না। অন্যান্য সার্ভিসগুলো কাজ চালিয়ে যেতে পারে, যা সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে শুধু সার্ভিসগুলোর স্কেলিং নয়, কাজের চাহিদা অনুযায়ী রিসোর্স বরাদ্দও সহজে করা যায়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের আরেকটি বড় সুবিধা হলো এর স্বাধীন ডিপ্লয়মেন্ট ক্ষমতা। প্রতিটি সার্ভিস আলাদাভাবে ডিপ্লয় করা যায়, যার ফলে কোনো একটি সার্ভিসে পরিবর্তন আনলে পুরো সিস্টেমকে ডিপ্লয় করার প্রয়োজন হয় না। এটি সময় সাশ্রয় করে এবং ডিপ্লয়মেন্টের ঝুঁকি কমায়। ফলে ইউজাররা নির্ভিঘ্নে সিস্টের বাকি সার্ভিসগুলো ব্যবহার করতে পারে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের প্রতিটি সার্ভিস ছোট এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে, যা টেস্টিং এবং ডিবাগিংকে সহজ করে তোলে। একটি সার্ভিসে কোনো সমস্যা থাকলে, সেটি দ্রুত চিহ্নিত করা এবং সমাধান করা সম্ভব হয়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যবসার বিভিন্ন বিভাগের জন্য আলাদা পরিষেবা তৈরি করার সুযোগ দেয়। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ক্লাউড-নেটিভ আর্কিটেকচারের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। ক্লাউড প্ল্যাটফর্মের যেকোনো সফটওয়্যার ডেভেলপ করা জন্য মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটকচার খুবই পপুলার। কারণ ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে প্রতিটি সার্ভিস আলাদাভাবে ডিপ্লয় এবং স্কেল করা যায়, যা সিস্টেমকে আরও কার্যকর ও খরচ সাশ্রয়ী করে তোলে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। যেখানে একাধিক দল একসঙ্গে কাজ করে, ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক এবং প্রতিটি দল একটি নির্দিষ্ট ফিচারের জন্য কাজ করে থাকে, সেখানে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার কার্যকর। হাই-পারফরম্যান্স অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য এটি আদর্শ। যেখানে সার্ভিসগুলোকে স্বাধীনভাবে স্কেল করার প্রয়োজন হয়। যেসব অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক এবং এর পরিষেবাগুলোর নির্ভরযোগ্যতা প্রয়োজন, মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার সেখানে ব্যবহৃত হয়। বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম যেমন- আমাজন, বইধু এবং আলিবাবা মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ব্যবহার করে। পণ্য ক্যাটালগ, অর্ডার ম্যানেজমেন্ট, পেমেন্ট প্রসেসিং এবং গ্রাহক পরিচিতি ব্যবস্থাপনা- এই সব কাজ মাইক্রোসার্ভিসের মাধ্যমে আলাদাভাবে পরিচালিত হয়, যা তাদের ম্যানেজমেন্ট এবং আপডেট করার সুবিধা দেয়। নেটফ্লিক্স, স্পোটিফাই এবং ইউটিউব মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে তাদের সিস্টেম পরিচালনা করে। স্ট্রিমিং কন্টেন্ট ডেলিভারি, রিকমেন্ডেশন সিস্টেম, ইউজার ম্যানেজমেন্ট এবং সাবস্ক্রিপশন সিস্টেম মাইক্রোসার্ভিসের মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়। মাইক্রোসার্ভিসের মাধ্যমে তারা নিরবচ্ছিন্ন স্ট্রিমিং এবং রিয়েল-টাইম ডেটা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে।   মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে বিশেষ কৌশল, দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তি প্রয়োজন। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের কারণে একটি বড় সিস্টেম ছোট ছোট পরিষেবায় বিভক্ত হয়ে যায়, যা পরিচালনা করা জটিল হয়ে ওঠে। প্রতিটি সার্ভিসের নিজস্ব কাঠামো এবং সিস্টেমের মধ্যে সমন্বয় রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। প্রতিটি সার্ভিসের মধ্যে অচও ভিত্তিক যোগাযোগের প্রয়োজন হয়, যা অতিরিক্ত ওভারহেড তৈরি করে। এর ফলে সিস্টেমের পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে যদি যোগাযোগের সংখ্যা বেশি হয়। যেহেতু প্রতিটি পরিষেবার নিজেস্ব ডেটাবেস থাকে, তাই ডেটার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। একাধিক সার্ভিসের মনিটরিং করা এবং সমস্যা শনাক্ত করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল হতে পারে। সার্ভিসগুলোর মধ্যে যোগাযোগ এবং পারফরম্যান্সের বিভিন্ন স্তরের কারণে ডিবাগিং আরো কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য বিশেষ মনিটরিং টুল (প্রমিথিউস, গ্রাফানা, কিবানা ইত্যাদি) এবং ডিবাগিং প্রযুক্তি প্রয়োজন। মাইক্রোসার্ভিস সিস্টেমে বিভিন্ন সার্ভিস ডিপ্লয় করতে হলে ডকার এবং কুবারনেটসের মতো কন্টেইনার টুলের ব্যবহার প্রয়োজন। এর জন্য দক্ষ জনবল এবং সঠিক টুল ব্যবস্থাপনা দরকার, যা কখনও কখনও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে চ্যালেঞ্জ থাকলেও মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের ব্যবহার বিভিন্ন বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে করতে দেখা যায়, যা তাদের সিস্টেমকে আরো কার্যকর এবং স্কেলেবল করে তোলে। বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আমাদের সবার পরিচিত নেটফ্লিক্স তাদের সিস্টেমে বিভিন্ন প্রকার মাইক্রোসার্ভিস ব্যবহার করে, যা ব্যবহারকারীর স্ট্রিমিং অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়ক। আমাজন, বিশ্বের বৃহত্তম ই-কমার্স কোম্পানি, এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা মিলিয়নের ঘরে এবং তা ক্রমবর্ধমান, আমাজন মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের মাধ্যমে তাদের সিস্টেম পরিচালনা করে। পেমেন্ট, প্রোডাক্ট ক্যাটালগ এবং অর্ডার ম্যানেজমেন্টের মতো কার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। উবার, জনপ্রিয় রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম, মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ব্যবহার করে তৈরি করা, যেখানে তাদের রাইড বুকিং, পেমেন্ট এবং লোকেশন ট্র্যাকিং পরিষেবাগুলোকে সহজ ও কার্যকরভাবে পরিচালনা করে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ই-কমার্স ওয়েবসাইট দারাজ সম্পূর্ণ মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে তাদের সিস্টেমের মেইনটেইন এবং আপডেট করা সহজ হয়। এইসব উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে বড় সিস্টেমগুলোতে যেখানে তাদের ইউজার অনেক বেশি। এছাড়াও তাদের স্কেলেবিলিটি , রেজিলিয়েন্স প্রয়োজন। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার আধুনিক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হয়ে উঠেছে। স্কেলেবিলিটি এবং স্বাধীন পরিষেবা পরিচালনার সুবিধার কারণে এটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির মধ্যে জনপ্রিয় সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন- ক্লাউড কম্পিউটিং, এআই এবং সার্ভারলেস আর্কিটেকচারের সঙ্গে মাইক্রোসার্ভিসের সংমিশ্রণ এটিকে আরও কার্যকর এবং শক্তিশালী করে তুলবে। ক্লাউড কম্পিউটিং মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের ভবিষ্যতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ক্লাউড সেবাদাতা যেমন- AWS, Google Cloud এবং Microsoft Azure মাইক্রোসার্ভিস ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য উন্নত টুল এবং অবকাঠামো সরবরাহ করছে। ভবিষ্যতে ক্লাউড-নেটিভ আর্কিটেকচার এমনভাবে উন্নত হবে, যাতে মাইক্রোসার্ভিসগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্কেল এবং সেল্ফ-রিপেয়ার করতে পারবে। কন্টেইনার অর্কেস্ট্রেশন টুলস, যেমন- Kubernetes আরও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হয়ে উঠবে, যা মাইক্রোসার্ভিস অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে দ্রুত ডিপ্লয় এবং পরিচালনা করতে সহায়ক হবে। সার্ভারলেস কম্পিউটিং যেমন- AWS Lambda এবং Google Cloud Functions মাইক্রোসার্ভিসের ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সার্ভারলেস পদ্ধতিতে ডেভেলপাররা নিজেদের কোডে মনোযোগ দিতে পারবেন। কারণ সার্ভার ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ক্লাউড সরবরাহকারীদের উপর থাকবে। সার্ভারলেস প্রযুক্তি এবং মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের সমন্বয়ে ভবিষ্যতে আরও হালকা, দ্রুত এবং কম ব্যয়বহুল সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি মাইক্রোসার্ভিস একটি নির্দিষ্ট কাজ শেষ করার পর ডাউন হয়ে যাবে, যা রিসোর্স ব্যবহারে আরও দক্ষতা আনবে। এআই এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে মাইক্রোসার্ভিস সিস্টেমগুলোতে এআই-চালিত অ্যানালিটিকস এবং স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রযুক্তি যুক্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো সার্ভিস ব্যর্থ হয়, তবে এআই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্যাটি সনাক্ত করে এবং তা সমাধান করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর চাহিদার পূর্বাভাস দেওয়া এবং সিস্টেমের স্বয়ংক্রিয় অ্যাডজাস্টমেন্ট সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে মাইক্রোসার্ভিস ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনগুলো মাল্টি-ক্লাউড এবং হাইব্রিড পরিবেশে আরও কার্যকরভাবে কাজ করবে। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান একাধিক ক্লাউড সার্ভিস প্রদানকারীর সেবা ব্যবহার করছে। এই পদ্ধতিতে একটি মাইক্রোসার্ভিস অ্যাপ্লিকেশন বিভিন্ন ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে বিতরণ করা যায়। ভবিষ্যতে মাল্টি-ক্লাউড ব্যবস্থাপনায় আরও উন্নত টুলস এবং অর্কেস্ট্রেশন প্ল্যাটফর্ম আসবে, যা মাইক্রোসার্ভিস সিস্টেমের স্থিতিশীলতা এবং পারফরম্যান্স বাড়াতে সহায়ক হবে। ডেভঅপস মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচারের অপরিহার্য অংশ। ভবিষ্যতে ডেভঅপস টুলগুলো আরও উন্নত হবে, যা CI/CD (Continuous Integration/Continuous Deployment) প্রক্রিয়াগুলোকে আরও সহজ এবং দ্রুত করবে। অটোমেশন প্রযুক্তি মাইক্রোসার্ভিস ভিত্তিক সিস্টেমের ডিপ্লয়মেন্ট, স্কেলিং এবং মনিটরিংকে আরও কার্যকর করে তুলবে। মাইক্রোসার্ভিস ভিত্তিক সিস্টেমে প্রতিটি সার্ভিস স্বতন্ত্র হওয়ায় সিকিউরিটি ব্যবস্থা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতে মাইক্রোসার্ভিস সিকিউরিটির জন্য উন্নত অ্যান্টি-হ্যাকিং প্রযুক্তি এবং ডেটা এনক্রিপশন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। এছাড়া, জিরো ট্রাস্ট আর্কিটেকচার মডেল মাইক্রোসার্ভিসের সুরক্ষায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এই প্রযুক্তিগত উন্নতিগুলোর মাধ্যমে মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ভবিষ্যতে আরও কার্যকর এবং শক্তিশালী হতে চলেছে, যা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতি, যা বড় এবং জটিল সিস্টেমগুলোকে আরও সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার সুযোগ প্রদান করে। যদিও এতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সঠিক পরিকল্পনা,দক্ষ জনবল এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠবে। কন্টেইনার টেকনোলজি, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং সার্ভারলেস আর্কিটেকচারের মতো প্রযুক্তির সমন্বয়ে এটি আরও উন্নত হবে। এ ছাড়া এআই এবং মেশিন লার্নিং সিস্টেমগুলোতেও মাইক্রোসার্ভিস পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে, যা পুরো সিস্টেমকে আরও নমনীয় এবং দক্ষ করে তুলবে। মাইক্রোসার্ভিস আর্কিটেকচার আজকের এবং আগামী দিনের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের চাহিদা মেটানোর জন্য একটি উদ্ভাবনী সমাধান হয়ে উঠেছে। এটি বড় প্রতিষ্ঠান থেকে ছোট কোম্পানিগুলো  পর্যন্ত সকলের জন্য জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতি। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে আরও বড় পরিবর্তন আনবে এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে একত্রিত হয়ে সফটওয়্যার জগতে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করবে।   লেখক : সেনা কর্মকর্তা

উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে গবেষণা

উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে গবেষণা

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড, আর গবেষণা সেই শিক্ষার প্রাণশক্তি। জ্ঞানার্জনের প্রকৃত অর্থ কেবল বই পড়া নয়। বরং শেখা, বিশ্লেষণ করা ও নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। গবেষণার মাধ্যমেই নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানভিত্তিক সমাজে টিকে থাকতে এবং উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে গবেষণায় শিক্ষার্থীদের আত্মনিয়োগের বিকল্প নেই। গবেষণা শিক্ষার্থীদের এমন এক দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে, যা তাদের শুধু ভালো পেশাজীবী নয়, বরং একজন উদ্ভাবক, নেতা ও সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে গড়ে তোলে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হলো গবেষণা ও উদ্ভাবন। কোনো দেশ যদি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা নতুন প্রযুক্তি, শিল্প খাতের উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এর মাধ্যমেই শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। একটি দেশের নিজস্ব গবেষণা না থাকলে প্রযুক্তি ও জ্ঞানগতভাবে সে দেশ অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে বিদেশী প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ে, যা অর্থনৈতিকভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তবে গবেষণার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ। করোনা ভাইরাস মহামারির সময় গবেষণার গুরুত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। বিশ্বজুড়ে গবেষণার মাধ্যমেই ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা গবেষণার বেহাল দসার কারণে দেশকে বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। কৃষি গবেষণা ও খাদ্য নিরাপত্তা দিকে তাকালে দেখা যায় একসময় বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির ছিল। কিন্তু কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাতের ফসল উদ্ভাবন করায় বর্তমানে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি। যদিও কৃষি গবেষণায় আরও বিনিয়োগ দরকার, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল উদ্ভাবন করা যায়। এতে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। গবেষণা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। একটি দেশের অর্থনীতি তখনই শক্তিশালী হয় যখন তার উৎপাদন খাত দক্ষ ও উন্নত হয়। গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায় বের করা সম্ভব হয়, যা কম খরচে বেশি পণ্য ও সেবা উৎপাদনে সহায়তা করে। গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানের জন্য আরও বেশি যোগ্য হয়ে ওঠে। একজন গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষার্থী কেবল চাকরির জন্য অপেক্ষা করবে না, বরং নিজেই নতুন উদ্যোগ নিতে পারবে। এতে দেশে যেমন বেকারত্বের হার কমবে তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া গবেষণা নিজেই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। উন্নত বিশ্বে গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং খাত গড়ে উঠেছে। যা ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। গবেষণা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও পথপ্রদর্শক। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবিত হলে তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। গবেষণায় বিনিয়োগ করলে দেশীয় পণ্য ও সেবার গুণগত মান বাড়ে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলাও গবেষণার ভূমিকা অনস্বীকার্য। গবেষণা একটি দেশের সমাজ, অর্থনীতি, মানবকল্যাণ, পরিবেশ, জলবায়ু সবকিছুর জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশের গবেষকরা মাত্র ১১,৪৭৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যেখানে ভারতের গবেষকরা ২,২২,৮৪৯টি এবং পাকিস্তানের গবেষকরা ৩৫,৬৬৩টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।  এই পরিসংখ্যান আমাদের গবেষণা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে। ইউনেস্কোর মতে, কোনো দেশের বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। বাংলাদেশে এই হার জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে, যা গবেষণার অপ্রতুলতার একটি প্রধান কারণ। যেখানে জাপানে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য জিডিপির ৩.৪ শতাংশ ব্যয় করে, দক্ষিণ কোরিয়ায়  ৪.৮ শতাংশ, চীনে ২.২ শতাংশ ব্যয় করে। সেখানে বাংলাদেশ গবেষণায় মাত্র ০.৩ শতাংশ বাজেট ব্যয় করে। যা সত্যি হতাশাজনক। তরুণরা হলো ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বাহক। কিন্তু শুধু সাধারণ পড়াশোনার মাধ্যমে তারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত গবেষণার জ্ঞান। তাই দেশের স্বার্থে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। গবেষণার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক গবেষণাগার ও পর্যাপ্ত উন্নত মানের সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। গবেষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশিক্ষকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাইমারি লেবেল থেকে শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে হবে। যাতে ছোট থেকে গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালোলাগা তৈরি হয় এবং ক্রমেই জানার আগ্রহের বিস্তার ঘটে। গবেষণার জন্য উপযুক্ত নীতিমালা ও প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা কার্যক্রম ও ফেলোশিপের সুযোগ বাড়াতে হবে। এতে দেশীয় শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। শুধু সনদভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই একটি জাতিকে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করা সম্ভব। দেশের স্বার্থে, তরুণদের এগিয়ে নিতে এবং সার্বিক উন্নতির জন্য গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। তাই সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে গবেষণার বিকাশে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে এবং বাংলাদেশ একটি গবেষণাবান্ধব উন্নত দেশে পরিণত হয়।

রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত কৌশল

রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত কৌশল

নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তকে ঘিরে রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাখাইন রাজ্য ক্রমশ আরাকান আর্মির প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছে। সেখানে একটি নতুন রাষ্ট্র, রাখাইন গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটি কৌশলগত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সীমান্ত নীতি, প্রতিবেশী সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের সমাধান কৌশল পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছেÑ যেখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থের জটিল মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঐতিহাসিকভাবে আরাকান নামে পরিচিত রাখাইন রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার  কেন্দ্রবিন্দু। শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি অঞ্চলটির ওপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। যার ফলে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাখাইন একটি স্বায়ত্তশাসিত বা এমনকি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য।   রাখাইনের কৌশলগত অবস্থান এটিকে প্রধান শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (ইজও) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক করিডর রয়েছে, যা ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। ভারতও এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশেষ আগ্রহী। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে চীনের প্রভাব প্রতিহত করতে সচেষ্ট। যা ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। নতুন একটি রাখাইন রাষ্ট্রের আবির্ভাব বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বয়ে আনতে পারে। একদিকে, এটি একটি সম্ভাব্য নতুন প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, সীমান্ত নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।   বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, যারা নিপীড়ন ও সহিংসতার কারণে রাখাইন থেকে পালিয়ে এসেছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এক মিলিয়নের বেশি  রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত চাপে পড়েছে। একটি নতুন রাখাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে, নতুন আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে এটি অর্জনের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য, আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং রাখাইন কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির সঙ্গে কৌশলগত সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা অপরিহার্য হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার অনিয়ন্ত্রিত ও প্রায়ই অস্থির সীমান্ত বারবার উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তবর্তী মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী  গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। একটি নতুন রাখাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে এই সমস্যাগুলো আরও বেড়ে যেতে পারে অথবা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী নিরাপত্তা সহযোগিতার নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।   বাংলাদেশকে রাখাইনে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর স্বার্থের জটিল সমীকরণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে। চীনের গভীর সম্পৃক্ততা একদিকে সম্ভাবনা তৈরি করলেও, অন্যদিকে ঝুঁকিও বহন করছে। চীনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে  রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হতে পারে। তবে এর কৌশলগত অগ্রাধিকার বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের সঙ্গে মিলবে কিনা, তা বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয়। একইভাবে, ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি ও রাখাইনে সংযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি, যাতে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর কার্যকর সমাধানে বাংলাদেশকে একটি সক্রিয় ও বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এই  কৌশলের প্রধান উপাদানগুলো হওয়া উচিতÑ   কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা- বাংলাদেশকে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাখাইনের উদীয়মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। অঞ্চলটির অন্যতম প্রধান অংশীজন আরাকান আর্মির সঙ্গে পরোক্ষ কূটনৈতিক আলোচনা (ব্যাকচ্যানেল ডিপ্লোমেসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংলাপের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলা, সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সদ্ব্যবহার- বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে, বিশেষ করে চীন ও ভারতের সঙ্গে। পাশাপাশি, পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনও নিশ্চিত করা জরুরি। রাখাইনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের জন্য মধ্যস্থতাকারী ও শান্তির পক্ষে সমর্থক হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন করতে পারে। এছাড়া, আসিয়ান (অঝঊঅঘ) এবং জাতিসংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।   সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন- সীমান্তবর্তী অপরাধ প্রতিরোধ ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উন্নত সীমান্ত নিরাপত্তা অপরিহার্য। বাংলাদেশকে আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে এবং প্রতিবেশী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। যৌথ সীমান্ত টহল ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মতো সমন্বিত পদক্ষেপ সীমান্ত উত্তেজনা কমাতে ও পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।   অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি- রাখাইনের সঙ্গে স্থিতিশীল ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাণিজ্য, পর্যটন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে যৌথ বিনিয়োগ উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হতে পারে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সীমান্ত বাণিজ্য করিডর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাখাইনকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে, যা বিদ্রোহ ও সংঘাতের প্রলুব্ধতা কমাতে পারে।   দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি- আন্তর্জাতিক আলোচনায় অতীতের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায়, বাংলাদেশকে কূটনীতি ও  কৌশলগত বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের প্রস্তুত করতে হবে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নীতি-সংক্রান্ত থিঙ্ক ট্যাঙ্কে বিনিয়োগ করলে জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা বাড়বে। প্রবাসী বাংলাদেশী সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোও ফলপ্রসূ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা- রাখাইনে স্থিতিশীলতা ও উনয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো  দেশগুলোর উচিত সংঘাতের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং রাখাইনে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা। জাতিসংঘসহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর উচিত সংলাপকে উৎসাহিত করা, মানবিক সহায়তা প্রদান করা এবং অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজরদারি জোরদার করা।   ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি- বাংলাদেশের রাখাইন নীতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত,  যেখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার  দেওয়া হবে। রাখাইনের সঙ্গে টেকসই সম্পর্ক উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হতে পারে, যা আঞ্চলিক সংহতি ও পারস্পরিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। তবে, বাংলাদেশকে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যে, সমস্যা শুধু রাখাইনের সঙ্গে নয় সম্পর্কিত নয়Ñ এখানে মিয়ানমার, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।   রাখাইন রাজ্যের রাখাইনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত কৌশল ও আঞ্চলিক নীতিগুলো পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। একটি সক্রিয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে পরিণত করতে পারে, যা অঞ্চলটির জন্য আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।

উপভোগ্য বিপিএল

উপভোগ্য বিপিএল

বিতর্ক থেকে যেন বেরুতেই পারছে না বিপিএলÑ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। অথচ এই উপভোগ্য টুর্নামেন্ট ১১ মৌসুম পার করল। দুর্বল ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নিয়ে সমস্যা, স্থানীয়-বিদেশী ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ, স্পট ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্পÑ এগুলো থেকে কবে মুক্ত হবে বিপিএল? যদিও গত শুক্রবার স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে দেশের মানুষ এ টুর্নামেন্ট কতটা উপভোগ করে। এটি ক্রিকেটেরই বিজয়। দর্শকরা এসেছেন খেলার টানে, চার-ছক্কার রোমাঞ্চে ডুব দিতে। একাদশ বিপিএল সে প্রত্যাশা মেটাতে কার্পণ্য করেনি, এমনকি ফরচুন বরিশালের পরপর দ্বিতীয় শিরোপা জেতা ফাইনালটাও নয়। নিজেদের সর্বশেষ বিপিএলেও ফাইনাল খেলে হেরেছিল চিটাগং। আরও একটি ফাইনাল, আরও একবার হতাশায় ডোবাল তাদের। অন্যদিকে ফরচুন বরিশাল পরপর দুবার ফাইনালে উঠে ভেসেছে ট্রফি জয়ের আনন্দ উৎসবে। চিটাগংকে ৩ উইকেটে হারিয়ে যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন তারা। ৪০ দিনের খেলা হলো, রানের ফোয়ারা ছুটল, সেঞ্চুরি দেখা গেল ৮টি, ব্যাটিং উইকেটেও বোলাররা ম্যাচ জেতালেন অনেক সময়, রোমাঞ্চকর অঘটন ঘটেছে, বড় দল বাদ পড়েছে, গ্যালারি পূর্ণ থেকেছে টিকিট কেনা দর্শকে। কিন্তু মাঠের বাইরে ছিল অনেক উত্তাপ। বিসিবির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বদলেছে, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলেও পরিবর্তন এসেছে। তবু কমেনি বিশৃঙ্খলা। একটা গোছানো বিতর্কমুক্ত টুর্নামেন্ট করা যায়নি এবারও। বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রিয় জাতি। আমরা দেখেছি বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের পরই ক্রিকেট বিশ্বে উত্তাপ ছড়িয়ে আসছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। বাংলাদেশও সে ধারায় বিশ্বে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে একটা অবস্থান করে নিয়েছে। বিপিএল আসরে এক ধরনের উত্তেজনায় পেয়ে বসে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। বলা যায়, খেলা চলাকালীন বিপিএল জ্বরে বেশ শক্তভাবেই আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশের লাখ লাখ ক্রিকেটপ্রেমী। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। বিপিএল বাংলাদেশের জন্য একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। এ ধরনের আয়োজন পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কার আগে বাংলাদেশ করে দেখিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরবের। দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের জন্য বিপিএল আর্থিক নিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিপিএল আয়োজনে কিছু অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা গেছে অতীতে, কিছু কলঙ্কও লেগেছে এর গায়ে। এবার যদি তেমনটা না হতো তাহলে কত ভালোই না হতো! টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ক্রিকেটারদের স্বল্প সময় ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে বড় কিছু করার এক দারুণ উপভোগ্য লড়াই। এতে দায়িত্বশীলতা, পেশাদারিত্ব এবং টিমওয়ার্কের চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। সে কারণেই আইপিএল এবং বিপিএল ক্রিকেট দর্শকদের কাছে এত বেশি আকর্ষণীয়। বিদেশী খেলোয়াড়দের সহযোগী (টিমমেট) এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে যত বেশি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া যাবে ততই দেশীয় ক্রীড়ার উৎকর্ষ ঘটবে। বিশেষ করে দেশের মাটিতে এ ধরনের আয়োজনে খেলোয়াড়রা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে দেশী-বিদেশী ক্রিকেটারদের সময়মতো পারিশ্রমিক না দেওয়া নিয়ে এবার যে ব্যাপক আলোড়ন উঠেছে, ভবিষ্যতে তা এড়াতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।   বিপিএল ও দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, এখন     থেকে বিপিএলের ড্রাফটে থাকা সব বিদেশী ক্রিকেটারের দায়িত্ব   নেবে বোর্ড। ক্রিকেটপ্রেমীরা আশাবাদী আগামীতে যেন কলঙ্কমুক্ত   হয় বিপিএল।

আইন মানতে হবে

আইন মানতে হবে

অবিলম্বে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সকল নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নিয়েও দলীয় সন্ত্রাসীদের একত্রিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য। বিগত সরকার সাড়ে ১৫ বছর জনগণের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সংগত কারণেই  বিক্ষোভকারী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা বছরের পর বছর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ফলে তাদের মনে ক্ষোভ রয়েছে। এ সত্ত্বেও সরকার দেশের সকল নাগরিককে আইন  মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। এতে করে আমরা নিজেদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে পুরানো বাংলাদেশ থেকে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করছি, আইন মেনে চলার মধ্য দিয়েই সেটি করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার অনুভূতি ক্ষুণ্ন না করি। আইনের প্রতি যে কোনো অবজ্ঞা নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির জন্য হুমকিস্বরূপ।’ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক  শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে বক্তব্য প্রচার করার নির্দেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এবং বিগত সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা ফেসবুকে  ধানমণ্ডি ৩২ অভিমুখে ‘বুলডোজার মিছিল’ এবং ‘মার্চ টু ধানমণ্ডি ৩২’ কর্মসূচি পরিচালনা করে। এক পর্যায়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হলেও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বুলডোজার কর্মসূচিতে সব নিঃশেষ হয়ে গেল। বিধ্বস্ত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপলক নেত্রে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এই মহিলা নিজের জিদ দিয়ে দলটাকে একেবারে  শেষ কইরা দিয়া গেল।’ শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের কূটনীতিককে ডেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবাদলিপি দিয়েছে। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, ‘৩২ নম্বরে ভাঙচুর অনভিপ্রেত, হাসিনার উস্কানি থেকে এ ক্ষোভের বহির্প্রকাশ।’ ভুলে গেলে চলবে না, আখেরে এ দেশেই আমরা থাকব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরস্পরের পাশে বিপদে-আপদে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে। দিন শেষে সবার সঙ্গে সবার দেখা হবে। দেশের সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা জাতীয় সম্পদ। কোনো ব্যক্তি, পরিবার কিংবা কোনো দলের একক আধিপত্য আদৌ ন্যায়সঙ্গত নয়। তরুণরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। আগামীর শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণরাই হবে নিয়ামক শক্তি। তারা পথহারা বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখাবে। সাড়ে পনেরো বছরের জগদ্দল শাসনের অবসান ঘটিয়েছে তরুণরাই। একটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর পথের সন্ধান দেয়। ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে তরুণদের হতে হবে ভ্যানগার্ড। তরুণদের আবেগ-অনুভূতিরও মূল্যায়ন করতে হবে। শুধু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারই নয়, কারও তরফ থেকেই কোনো ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য কাম্য নয়। যার ফলে তরুণরা আবারও আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। যে কোনো পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য শান্তি, সুস্থিতি ও স্থিতির পথে চরম অন্তরায়।

শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের সহায়ক

শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের সহায়ক

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের প্রধান আকাক্সক্ষা এখন সংস্কার যা ইতোমধ্যেই শুরু করেছে দায়িত্বশীলরা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এসেছে।  দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার জন্য স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হওয়ার পরেরও প্রথম দিকে এ বিষয়ে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে আশার কথা, গত ৩১ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার একজন উপদেষ্টা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনেরও ঘোষণা দিয়েছেন যা একটি ভালো উদ্যোগ। কেননা, আমরা  যদি উন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করতে চাই, তবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয়  সরকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে স্থানীয় পর্যায়ের সকল সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য উচ্চপর্যায়ে নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য অনায়াসেই সমাধান করা যায়।

পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা

পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা

ক্যাপিটালিজম (ঈধঢ়রঃধষরংস) বা পুঁজিবাদ হলো এমন একটি অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদন যন্ত্রের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে, উৎপাদন উপায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং লাভের জন্য তাদের পরিচালনার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। পুঁজিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে বলে পুঁজিবাদকে একটি মুক্তবাজার অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বে জনপ্রিয় দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পুঁজিবাদ অন্যতম এবং অন্যটি হলো সমাজতন্ত্র। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোনো কিছুতে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। পুঁজিবাদের ঠিক বিপরীতে হলো সাম্যবাদ (ঈড়সসঁহরংস)।

আগ্রাসী অসুস্থ মন!

আগ্রাসী অসুস্থ মন!

ধর্ষণের খবর প্রতিদিন আমাদের আহত, ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। অতীতে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সমালোচনার কারণে একটি মামলার বিচারে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তারপরও থেমে থাকেনি ধর্ষণ। মনে হচ্ছে ধর্ষণের জন্য শিশুদের টার্গেট করছে কিছু অমানুষ। কারণ, প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি শিশুরা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক। যেমন সম্প্রতি রাজধানীতে হাত-পা বেঁধে ৫ জন মিলে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে। পরে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় হাতিরঝিলে। এ ঘটনায় জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযুক্ত আরও তিনজনকে খুব দ্রুত ধরতে হবে। তারপর তাদের চরম শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। শিশুরা হলো নিষ্পাপ এবং ফুলের পাপড়ির মতো। কিন্তু মানুষরূপী নরপশুদের হাত থেকে শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। কি খারাপ সময় সমাজ অতিবাহিত করছে দেশ ও জাতি? যা নিয়ে সরকার, অভিভাবক এবং আমরা সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এখান থেকে আমাদের খুব শীঘ্রই মুক্তি পাওয়া দরকার। অন্যথায় আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। এই শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশ নেতৃত্ব দেবে। তাদের আমাদের রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করা রাষ্ট্র, সরকার এবং আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬২৭টি। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩২৯-এ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অতীতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ২ বছর ১০ মাস বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ গণমাধ্যম মারফত জানতে পারি। কি হচ্ছে এসব? কী বর্বরতা? নানা সময়ে দেখা যায় প্রতিবেশীরা তরুণ শিশুদের নানাভাবে ফুসলিয়ে ধর্ষণ করে থাকে। আবার দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধায় অনেক পরিবারকে আইনি ব্যবস্থা নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। অর্থাৎ সমাজের কিছু মানুষ আবার এসব অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। অনেক জায়গায় দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনাটিও বিচার-সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করার পাঁয়তারা করা হয়। যারা এর সালিশি করে, তাদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। যারা ধর্ষণ করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।   অতীতে শেরপুরে গৃহকর্মী শিশুকে ধর্ষণের মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শিশুটির পরিবার ও পুলিশের তথ্য অনুসারে, অপরাধীদের একজনের বাড়িতে চার-পাঁচ মাস আগে শিশুটি গৃহকর্মীর কাজ নেয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় শিশুটিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেন ওই বাড়ির কর্তা-ব্যক্তি। গভীর রাতে সিঁদ কেটে শিশুকে তুলে নিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপকর্মের ঘটনা শুনতে পাই, এটা কি কোন মানুষের কাজ হতে পারে? এদের ধিক্কার জানাই। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানানভাবে শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ অনেক বেড়েছে। যেভাবে হোক, এসব বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে দরকার সামাজিক প্রতিরোধ এবং সামাজিক ঐক্য। সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি পরিবারের দায়িত্ব রয়েছে যে তার ছেলেমেয়ে কোথায় যায়, কার সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। সর্বদা শিশুর প্রতি পিতা-মাতার নজর এবং খোঁজখবর নিতে হবে। যুগ যুগ ধরে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে দেশে শিশু ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে আইন আছে, কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ খুবই কম। ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী মামলা করলে কিছুদিনের মধ্যেই অপরাধীরা জামিনে মুক্ত হয়ে যান। পরে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। দেশজুড়ে ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রতিবাদ–বিক্ষোভ চলছে কিন্তু শিশু ধর্ষণের ঘটনা থামছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নিকটাত্মীয়রা অভিযুক্ত। শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধ কমাতে দ্রুত বিচার করতে হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সকল দলের মধ্যে এ রকম ইস্যুতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা জরুরি। ধর্ষণ বা যে কোনো অপরাধ নিয়ে রাজনীতি করা সঠিক না বলে মনে করি। এ ছাড়া ধর্ষণ বন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুকাল থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল না থাকাই ভালো। যাতে একে অপরকে বন্ধু এবং নিকটতম সঙ্গী ভাবতে পারে।    সমাজে শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুদের মনে এক আতঙ্ক এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। শিশুরা যেখানে যায়, সেখানে তারা ভীতিতে বসবাস করে। যা কোনোভাবে হওয়া উচিত নয়। এভাবে শিশুরা আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠলে তাদের ভেতরে সুস্থ বুদ্ধি, মননশীল চিন্তা-চেতনা বা সৃজনশীল মেধার বিকাশ হওয়া কঠিন। তাই মনে করি, ধর্ষণ বা শিশু নির্যাতনে লণ্ডভণ্ড আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের সহায়তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স তৈরি করতে হবে। পুলিশকে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো রিপোর্ট করতে এবং আদালতের মাধ্যমে মামলা প্রক্রিয়াকরণের গতি এবং সংবেদনশীলতা উন্নত করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ইউনিট, প্রত্যেক এলাকায় শিশু নির্যাতন বন্ধে কমিটি, পুলিশ ও আদালতের কর্মকর্তাদের লিঙ্গ প্রশিক্ষণ, ধর্ষণ অপরাধের জন্য মহিলা থানা এবং আদালত প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ফুল যেমন পাপড়ি মেলে সৌরভ ছড়ানোর অপেক্ষায় থাকে, তেমনি শিশুরাও একদিন ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবে এই অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু কি নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন এবং ধর্ষণ আমরা দেখতে পাই কিছু মানুষ নামে নরপশুদের কারণে। যে শিশুদের চোখের তারায় থাকে অপার সম্ভাবনা। বিকশিত হওয়ার পূর্বে অনেক নিষ্পাপ শিশুকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেলি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন আমাদের একটি প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, এক একটি শিশু এক একটি স্বপ্ন ও ফুল। সর্বোপরি বর্তমান সরকারকে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ধর্ষকদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

ভাষা আন্দোলন ও সমকালীন বাস্তবতা

ভাষা আন্দোলন ও সমকালীন বাস্তবতা

সপ্তম শতাব্দীতে যখন বাংলা ভাষার উন্মেষ হয় তখন থেকেই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা উপ্ত হয়। বাংলাদেশে জাতি গঠন প্রক্রিয়া প্রায় দেড়-দুই হাজার বছরের বিষয়। এ দেশের বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যকে প্রথম একত্র করেন রাজা শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে। ৭৫০ থেকে শুরু করে ১০৯০ সাল পর্যন্ত বৌদ্ধ পাল রাজার অধীনে এ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। এরপর সেন রাজবংশ ১০৯৫ থেকে শুরু করে ১২৩০ সাল পর্যন্ত দেশটিকে মোটামুটিভাবে একীভূত রাখে। অতঃপর আফগান এবং তুর্কি মুসলমানরা (১২০১-১৫৫৬ খ্রি.) এ দেশে তাদের রাজত্ব বহাল রাখে। ১৩৪২ সালে সর্বপ্রথম শামসুদ্দীন ইলিয়াছ শাহ নিজেকে ‘শাহে বাঙালিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। যাকে বলা হয় সুলতানি আমল। তাদের রাজত্ব নানা বাধা-বিপত্তির মুখে সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত বহাল থাকে। বাংলাদেশের সেই সময়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় ছিল হুসেন শাহী রাজত্ব, যার শুরু হয় ১৪৯৩ সালে। বস্তুতপক্ষে তখনই এ দেশে মধ্যযুগের অবসান হয়। মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে সুবা-বাংলা যদিও ১৫৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু সারাদেশটি তাদের অধীনে নিয়ে আসতে তাদের আরও প্রায় ৫০ বছর চলে যায়। দিল্লির মোগল সম্রাটদের অধীনে বাংলাদেশের সুবাদার বাস্তবে এদেশের স্বাধীন নবাব হিসেবে অবস্থান রাখেন। ব্রিটিশ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রি.) বাঙালির স্বতন্ত্র সত্তা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ভারতে যুগপৎ খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন (১৯১৯-১৯২২ খ্রি.) ব্যর্থ হওয়ার পর বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনা অনেক এগিয়ে যায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কিরণ শঙ্কর রায়, বিধানচন্দ্র রায় সবাই বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। দেশবন্ধুর ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের সূচনা করে। আবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে সোহরাওয়ার্দী-শরৎবসুর যুক্তবাংলা চুক্তি বাংলাদেশের পূর্বসূরি হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২ খ্রি.), ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৬৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের আগরতলা মামলা মোকাবিলাÑ এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালে। আর এসব আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ উত্থাপিত সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নবগঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহল প্রথম বিতর্ক শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত ভিন্নতা এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহির্প্রকাশ। এ আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এলিটদের মধ্যে এক প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সূচনা করে। বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ চক্রের আক্রমণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হাজার বছরের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। ভাষা আন্দোলনই ছিল এদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের মধ্যে অবচেতন বাঙালির জাতীয়তাবাদী অনুভব ছিল। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব করেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে।...উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণÑ রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু।’ এর ফলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলা ভাষার দাবিকে জোরদার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকাংশের মাতৃভাষা বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসনের কারণ হিসেবে তারা যদিও ‘এক পাকিস্তানের সংহতি’র দোহাই দিয়েছিলেন, কিন্তু এর নেপথ্যে কাজ করেছিল ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ না ঘটে সে বিষয়ে তারা প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন। তাদের মনে আশঙ্কা ছিল যে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পুরো পাকিস্তানের ওপর বাঙালি জাতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। তাই তারা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা শুরু করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সরকারি ফরম, ডাকটিকিট, মুদ্রা, রেলের টিকিট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্ধারণ করা হলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকমহল সমাজ ও রাজনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর নগ্নভাবে আক্রমণ শুরু করে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি প্রগতিশীল যুব সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে মাতৃভাষাকে সংস্কৃতিচর্চা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথ উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এ সংগঠনটি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে প্রচারণা চালায়। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু? শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসদলীয় সংসদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা রাখার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ সরকারদলীয়রা এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। নবগঠিত এ পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ সারা বাংলায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এ প্রতিবাদ দিবসে পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ের প্রথম গেটের সামনে বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন পরিষদের আহ্বায়ক শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতা। এ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় এবং ১৫ মার্চ পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা সংবলিত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করার বিষয়টি প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপিত এবং গৃহীত হলেও ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। ২১ মার্চ রেসকোর্সের গণসংবর্ধনায় প্রদত্ত বক্তৃতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে জোর দেন এবং যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের দেশের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করার কারণে নাজিমুদ্দিন সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর যেভাবে জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে জিন্নাহ্ তার নিন্দা না করে বরং মুসলিম লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে সমর্থন জানান। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুনরায় জিন্নাহ্ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্ররা আবারও তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী পূর্ব বাংলার ফজলুর রহমান পেশোয়ার শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। এ ঘোষণা প্রচারের পরই ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫২ সাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘কায়েদে আজম উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এভাবে আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠার পটভূমিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিক্ষোভ মিছিলসহ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালন করে। পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিন থাকায় পরবর্তী ধর্মঘটের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নেওয়া হয়। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল উক্ত বাজেট অধিবেশনে পরিষদের সদস্যদের সমর্থন আদায় করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রস্তাব পাস করানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে প্রাদেশিক পরিষদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমানসহ নাম না জানা কয়েকজন শহীদ হন। ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ সদস্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। পরিশেষে ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম। এটা শুধু ভাষাগত কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল সামন্তবাদের তাঁবেদার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষক শ্রেণির জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের এক ব্যাপক গণআন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রচিত পূর্ব বাংলার প্রথম প্রতিবাদী নাটক ‘কবর’-এর রচয়িতা মুনীর চৌধুরী, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ, ভাষা আন্দোলনের ওপর রচিত উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’-এর রচয়িতা জহির রায়হান, গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা রাখার দাবি উত্থাপনকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখকেও মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিকট জীবন দিতে হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। পৃথিবীর কোথাও ভাষার নামে কোনো দেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে ভাষার নামে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১-এর চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এ ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আন্দোলনসমূহ সফলভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফুরণ ঘটায় তা আর থেমে থাকেনি; বরং পর্যায়ক্রমে আরও বিকশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের বদৌলতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। তবে বর্তমান সময়ে আমরা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে হারিয়ে যেতে বসেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। অথচ এখনো উচ্চ আদালত, চিকিৎসা, প্রকৌশলবিদ্যাসহ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত। অথচ এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য ভাষা শহীদরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, অনেকেই পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, অনেকেই কারাজীবন ভোগ করেছেন। আমাদের উচিত ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমুন্নত রাখা।

দুর্নীতিমুক্ত হোক সমাজ

দুর্নীতিমুক্ত হোক সমাজ

দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তার অধীন প্রায় সকল সরকারি অফিস-আদালত, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সরকারি সকল অফিস সংঘটিত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি উইপোকার মতো দেশটাকে ফাঁপা করে দিয়েছে, যা রোধ করা দুদকের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে দেশের উন্নয়নে যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে একসঙ্গে মিলেমিশে দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেদিকে তাকাবেন সরকারি অফিস-আদালত বা মন্ত্রণালয় বা তার অধীন সকল প্রতিষ্ঠানে ওপেন সিক্রেটের মতো দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখবেন। এমনিতে কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের  অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। জীবনযুদ্ধের  বর্তমান লড়াইয়ে আমরা পর্যুদস্ত। বিগত সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য উদারতা দেখিয়ে তাদের বেতন বাড়ালেও এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সফলতা বা উন্নতি দেখা যায়নি। বরং দুর্নীতি মাকড়সার জাল বা অক্টোপাসের মতো জেঁকে বসেছে, যা এখন নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিগত সরকারের আমলে সরকারি অফিসের পিয়ন, কেরানি বা ড্রাইভারদের দুর্নীতির কথা এখন সকলের মুখে মুখে। তাদের অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছেন বিত্তশালী। দুদকের কিছু দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে দেখা যায় যে, সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশটাকে গ্রাস করেছে। এই দুর্নীতিই আমাদের দেশের সন্তানদের আশা-ভরসা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে বসছে। বাংলাদেশের মানুষ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চায়। এখনই যদি শক্ত হাতে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা না করা হয় তাহলে  লালফিতা বা আমলাতান্ত্রিকতার  দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে চলে যাবে তখন রশি টেনেও কোনো লাভ হবে না। শক্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি যেভাবে দেশটাকে বোধশক্তিহীন করে ফেলছে এর বিরুদ্ধে কথা বলাও বিপদ। তবে দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এখন যেন তদন্ত রিপোর্ট কোনোভাবেই হিমাগারে ফেলে রাখা না হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় সরকারি অফিসগুলোতে সরকারের রাজস্ব তহবিল হতে বাজেটের টাকা বরাদ্দ করা হলেও তা যথাযথভাবে ব্যয় করা হয় না। বছর শেষে সেই বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে না পেরে ক্রয় ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। সেখানেও এজি বা অডিট অফিসগুলোর অসৎ কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। বিগত সরকারের দুর্নীতির পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এখনো খুবই উদ্বিগ্ন। তাই সরকারি খাতে দুর্নীতি কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আরও গতিশীল ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বিগত সময় অনেক সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা গেছে, যা এখন দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিককালে দুদক-এর এক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, দেশে এমন কোনো সরকারি অফিস নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। বিভিন্ন সরকারি অফিসে গাড়ি ব্যবহারে অপচয় ও অনিয়মও সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে একটি চলমান সমস্যা, যার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ও টেকসই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। দুর্নীতির ফলে সেবা খাতে মানুষের হয়রানি, বিড়ম্বনা, প্রতারণা ও ক্ষতির অভিজ্ঞতা এখনো তুলনামূলকভাবে বেশি। সরকারের উল্লেখযোগ্য সেবার খাতগুলোতে মানুষের দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার অনেক বেশি। বিশেষ করে খাসমহালে, জল মহল এর নামে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, এসিল্যান্ড ও দেশের ভূমি অফিসগুলোতে যুগের পর যুগ সেবার নামে মানুষকে অপরিসীম যন্ত্রণা, হয়রানি, দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, যেন দেখার কেউ নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জায়গা না থাকায় জনগণও দিনে দিনে হতাশ হয়ে উঠছেন। কাজেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেশ গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এখন সময় এসেছে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং ক্ষমতাবানদের সম্পদের সঠিক তথ্য-বিবরণী নেওয়ার। প্রধান উপদেষ্টা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হতে দুর্নীতির উইপোকা দূর করার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন- এটাই প্রত্যাশা। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

সড়ক ব্যবস্থাপনায় টাস্কফোর্সের সুপারিশ

সড়ক ব্যবস্থাপনায় টাস্কফোর্সের সুপারিশ

সম্প্রতি ‘অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্র্নির্ধারণ সংক্রান্ত সরকারি টাস্কফোর্স’ রাস্তার যানজট কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছে। এসব সুপারিশের অনেক ইতোমধ্যে নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে। বিষয়গুলো আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে সুপারিশ আকারে। বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্র্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত বছরে ১০ সেপ্টেম্বর এই টাস্কফোর্স গঠন করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। এর অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে প্রচার মাধ্যমে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এ এস মুর্শিদ ছিলেন টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান। টাস্কফোর্সের সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ জন। প্রতিবেদনের ‘অবকাঠামো ও সংযোগ : অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ’ শীর্ষক অংশটি প্রণয়ন করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক। টাক্সফোর্সের সুপারিশে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে রাশ টানার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, রাজধানীতে কত গাড়ি চলতে পারবে সেটি আগে নির্ধারণ করতে হবে। সে অনুযায়ী রাস্তায় গাড়ি নামানোর অনুমোদন দিতে হবে। সড়ক ব্যবহারে গাড়ির জন্য ধার্য করতে হবে মাশুল। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে গাড়ি কেনার ঋণ কমিয়ে আনা এবং গাড়ির অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয় সুপারিশে। এ ছাড়া প্রকল্পের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয় নিষিদ্ধ, রাইড শেয়ারিং সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, লেগুনা, দুরন্তের মতো যানের চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়ে বড় ও দ্বিতল বাস বাড়ানোর কথা বলেছে টাস্কফোর্স কমিটি। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে উড়ালসড়ক নির্মাণ বন্ধ এবং বাস-ট্রেনসহ গণপরিবহনে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। অবশ্য চাষযোগ্য জমি বাঁচাতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে শহরের বাইরে উড়ালসড়ক ও উড়াল রেলপথ নির্মাণের। সুপারিশে রেল, নৌ ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে এক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আলাদা আলাদা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজেদের মতো করে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়। এতে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। বিশেষ করে জমি অধিগ্রহণ কিংবা জমি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে তৈরি হয় নানা জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, রেল কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী কন্টেনার টার্মিনাল করতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জমি দিতে রাজি হয়নি। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ের সঙ্গে জমিসংক্রান্ত জটিলতায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে মাল্টিমোডাল হাব করা যাচ্ছে না। একই কারণে মাল্টিমোডাল হাব করা যাচ্ছে না কমলাপুর  রেলস্টেশনকে। রেলের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের। প্রতিবেদনে বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা সূচক, বায়ুদূষণ সূচক, যানবাহনের গতির সূচকসহ আটটি বৈশ্বিক গবেষণা ও সমীক্ষার উদাহরণ টেনে বলা হয়, এর সবটিতেই ঢাকার অবস্থান সবার নিচে কিংবা নিচের দিকে। এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়। ঢাকার ৮৫ শতাংশ অবকাঠামো অননুমোদিত এবং তা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য উপযোগী নয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে এটিকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ যেখানে ঘণ্টায় ছিল ২৫ কিলোমিটার, তা ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছিল। এখন তা আরও কমেছে। নগরে একটি সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ  দেওয়া হয়েছে। এতে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ, ট্রাম, বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট), এলআরটি (লাইট  রেল ট্রানজিট), মনোরেল, সাব আরবান কমিউটার রেল, মেট্রোরেল ও রাইড শেয়ারিংয়ের মতো সব ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্সের দেওয়া প্রতিটি সুপারিশ বাস্তবসম্মত। এর মধ্যে কিছু সুপারিশ এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব। কিছু সুপারিশের জন্য কিছুদিন সময় লাগতে পারে। বাকি সুপারিশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জড়িত এবং বাস্তবায়নও সময়সাপেক্ষ। এজন্য সুপারিশগুলোকে তিন ভাগ যথাÑ স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া যায়। যেমনÑ বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি, রাইড শেয়ারিংয়ের সেবার মান উন্নয়ন, ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধ ও স্বল্প গতির যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন রুটে বড় ও দ্বিতল বাস সার্ভিস চালু ইত্যাদি স্বল্পমেয়াদে করা সম্ভব। নগরীর রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। একবার পরীক্ষামূলকভাবে দুটি রুট চালুও করা হয়েছিল। প্রভাবশালী বাস মালিকদের দৌরাত্ম্যে এই পরিকল্পনা সফল হয়নি। বর্তমান সরকারও এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি গোলাপি রঙের বাস দিয়ে চালু করা হয়েছে আবদুল্লাহপুর থেকে নগরীর বিভিন্ন রুটের বাস সার্ভিস। কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে অথবা ই-টিকিটের মাধ্যমে এই বাসে চড়তে হবে। কেউ টিকিট ছাড়া এই বাসে ভ্রমণ করতে পারবে না। নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ড ছাড়া যাত্রী ওঠানামাও করতে পারবে না। খুব শীঘ্রই মিরপুর, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন রঙের বাস চলবে নগরীর বিভিন্ন রুটে।    রাইড শেয়ারিং গোটা বিশে^ জনপ্রিয় পাবলিক পরিবহন। বাংলাদেশেও এটি শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। শুরুতে এর সেবার মান ভালো থাকলেও এখন আর নেই। পিক আওয়ারে এগুলো পাওয়া খুবই কঠিন, গন্তব্য পছন্দ না হলে এরা যেতে চায় না। বারবার ক্যাব পরবর্তন করেও গাড়ি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জরুরি প্রয়োজনে এখন আর রাইড শেয়ারিং ক্যাবের ওপর নির্ভর করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে ট্যাক্সি কালচার গড়ে ওঠেনি কোনো দিনই। সুতরাং রাইড শেয়ারিংয়ের সেবার মান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সিএনজি অটোতে মিটার লাগানো এবং মিটারে ভাড়া নির্ধারণের আইন বিদ্যমান থাকলেও কোথাও এর কার্যকারিতা নেই। যাত্রীদের পকেট কেটে তারা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। বিগত সরকারের আমলে একবার এবং বর্তমান সরকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করলেও তাদের আন্দোলনের মুখে দুই সরকারকেই আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এখন রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিক্সার দাপটে অতিষ্ঠ নাগরিক জীবন। এই অবৈজ্ঞানিক যানে দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে প্রতি নিয়ত। ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলে নীতিমালা তৈরি করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গত তিন মাসেও তাদের কোনো কর্মতৎপরতা চোখে পড়েনি। অবিলম্বে মূল রাস্তায় এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া স্বল্প গতির যান রিক্সার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আধুনিক নগরী গড়ে তুলতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা করে স্বল্প গতির এই যান তুলে দেওয়ার চিন্তা করতে হবে। একই সঙ্গে নগরীর রাস্তাগুলোতে বড় ও দ্বিতল পাবলিক বাস বাড়াতে হবে। এই বাস রাস্তার কম জায়গা নষ্ট করে বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারে। তবে অবশ্যই বাসগুলো হতে হবে মানসম্মত এবং চলতে হবে কঠোর নিয়ম মেনে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো একীভূত কিংবা সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ নিতে হবে। মহানগরগুলোতে যানজটের অন্যতম কারণ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এতে শুধু রেল, সড়ক ও জনপথ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নয়, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ও জড়িত। এ কারণে মন্ত্রণালয় একীভূত করতে না পারলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সকল বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। নগরীর সকল উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার আগে এই কমিটিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শতভাগ সমন্বয় নিশ্চিতের পরই শুরু করতে হবে কাজ। এমন একটি সমন্বয় পরিকল্পনায় অতীতে ‘সিটি গভর্নরের’ ধারণা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ এই দাবি তুলেছিলেন। অতীতে কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়নি। বর্তমান সরকার গঠিত সংস্কার কমিটি অবশ্য নগর সরকারের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে বড় শহরগুলোতে আধুনিক মিটার ট্যাক্সি চালু করা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে ট্রাম, বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট), এলআরটি (লাইট রেল ট্রানজিট), মনোরেল, সাব আরবান কমিউটার  রেল, মেট্রোরেল ইত্যাদি। ট্রাম, বিআরটি, এলআরটি লাইন নির্মাণে নগরীতে জায়গা পাওয়া যাবে কিনা তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। শহরের সব স্থানে না হলেও কিছু কিছু স্থানে হয়তো আধুনিক এই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু করা যাবে। তবে মনোরেল ও মেট্রোরেল নগরীতে আনতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত ছয়টি প্রকল্পের একটি বাস্তবায়নেই মতিঝিল থেকে মিরপুর হয়ে উত্তরা যাতায়াতকারী যাত্রীদের অনেক সুবিধা হয়েছে। এই রাস্তায় কমেছে যানবাহনের চাপ। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো চালু হলে রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণের যোগাযোগ সম্পূর্ণ হবে। বাকি থাকবে পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগ। পর্যায়ক্রমে প্রস্তাবিত সকল মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর কিছু পুনর্মূল্যায়নও করা যায়। দু’একটি প্রকল্পে মেট্রোর পরিবর্তে স্থাপন করা যায় মনোরেল। শহরের বড় রাস্তার পাশে বা মধ্যেই স্থাপন করা যায় মনোরেল। বিশে^র প্রায় সকল উন্নত শহরেই মেট্রোরেলের পাশাপাশি মনোরেল চালু রয়েছে। এ ছাড়া সাব আরবান কমিউটার রেল চালু করতে পারলে মূল শহরের ওপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমবে। যাত্রীরা ঢাকার আশপাশের শহরগুলোতে বাস করেও রাজধানীতে অফিস করতে পারবেন। সাব আরবান কমিউটার রেল সার্ভিস চালু করা অপেক্ষাকৃত সহজ। অল্প খরচে বিদ্যমান রেললাইন কাজে লাগিয়ে এই সার্ভিস চালু করা যায়। ঢাকা থেকে গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন বিদ্যমান। সংযোগ স্থাপন করতে হবে মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের মধ্যে। বিদ্যমান রেল লাইনের মাধ্যমে কমিউটার ট্রেন চালু করতে প্রয়োজন হবে সকল রেল ক্রসিং তুলে দেওয়ার। সকল ক্রসিংয়ে তৈরি করতে হবে ওভার বা আন্ডার পাস। এজন্য একটু খরচ হবে। ক্রসিংগুলো তুলে দিয়ে মেট্রোরেলের মতো টিকিটিং পদ্ধতিতে চালু করতে হবে কমিউটার ট্রেন। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সময় মাথায় রেখে গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ভাঙ্গা ও মানিকগঞ্জের মধ্যে প্রতি ৫/১০ মিনিট পর পর ট্রেন চালু করতে পারলে রাজধানীর ঢাকার জনসংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। রাজধানীতে বসবাসকারী অনেক মানুষ এ দূষিত পরিবেশ, উচ্চ বাসা ভাড়া ও অতিরিক্ত দ্রব্যমূল্য দিয়ে অতিষ্ঠ। তারা আশপাশের শহর কিংবা শহরতলিতে অর্ধেক দামে বাসা ভাড়া নিতে পারবেন। হাতের কাছে পাবেন টাটকা শাক-সবজি, মাছ-মাংস অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে। স্বাভাবিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে অনেকে শহর ছাড়বেন। সকালে এসে সন্ধ্যায় চলে যাবেন নিজ শহরে। বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোতে এই কনসেপ্টেই জনসংখ্যার চাপ কমানো হয়েছে। লাখ লাখ লোক সকালে শহরে প্রবেশ করেন আবার বিকালে শহর ছেড়ে যান। দীর্ঘমেয়াদে হলেও প্রকল্পগুলো নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে পর্যায়ক্রমে। টাস্কফোর্সের অবকাঠামো ও সংযোগ অংশের প্রণেতা, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক একটি জাতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নকে ‘জট লাগানো’ উন্নয়ন উল্লেখ করে বলেন, ‘এজন্য লাখো  কোটি টাকা খরচ করেও সুফল মিলছে না। টাক্সফোর্স জট ছোটানোর প্রস্তাব দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এগুলো বাস্তবায়ন করে উপকৃত হয়েছে। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। আমলাতন্ত্রের জটিলতায় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যতে কোনো উন্নয়নই সেভাবে কাজে লাগবে না।’