ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

মতামত

মতামত বিভাগের সব খবর

পথশিশুদের আনন্দ

পথশিশুদের আনন্দ

ঈদ এক বিশেষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, যা দেশজুড়ে সকলের হৃদয়ে আনন্দ ও ঐক্যের বার্তা বয়ে আনে। সমাজের এক অঙ্গ পথশিশুরাও এই আনন্দের অংশীদার হতে পারেন। বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবী ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার উদ্যোগে পথশিশুদের জন্য বিশেষভাবে আয়োজন করা হয় ঈদের আনন্দের কিছু মুহূর্ত, যা তাদের জীবনে স্বস্তি ও আশা নিয়ে আসে। ঈদুল ফিতর বা ঈদের দিন প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে এক বিশেষ মর্যাদা রাখে। এটি শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বা পারিবারিক মিলন নয়, বরং নতুন পোশাক, মুখরোচক খাবার, আনন্দের পরিবেশ ও একাত্মতার উৎসব হিসেবে বিবেচিত। তবে এ আনন্দের মেলা যেখানে অনেক পরিবারের জন্য উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত বয়ে আনে, অন্যদিকে সমাজের এক শোষিত অংশ– পথশিশুরাও ঈদের দিনটি উপলব্ধি করে এক ভিন্ন রূপে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর পার্থক্যের কারণে অনেক পথশিশুর কাছে দিনটি কেবল একটি অপরিসীম স্বপ্নের মতো থেকে যায়। পথশিশুরা, যারা প্রায়ই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, তেমন কিছু শিশু আছে যারা তাদের জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম ও নির্যাতনের মুখোমুখি। তাদের জন্য প্রতিদিনের জীবনই এক কঠিন বাস্তবতা। খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাথ ওভারব্রিজ ও বস্তিতে বসবাস করতে করতে তারা রাতের জেগে থাকে ক্ষুধা, আবহাওয়ার দুরাবস্থা এবং সামাজিক অবহেলার মধ্যে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবী ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা চেষ্টা করে যাচ্ছে পথশিশুদের জীবনে একটু হলেও আনন্দের সঞ্চার করতে। তারা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে পথশিশুদের মাঝে শুধু উপহার বিতরণ করেন না, বরং শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প শোনা, কারুশিল্প কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের মনোভাব এক নতুন দিশা দেন। তাঁদের ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সময় দেওয়ার মাধ্যমে তারা শিশুদের মনে এই বার্তা প্রেরণ করেন যে, সমাজ তাদের ভুলে যায়নি। এভাবেই সামান্য হলেও একটি সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। যেখানে পথশিশুরাও যেন সমাজের একটি অংশ হয়ে ওঠে। তাদেরও অধিকার আছে আনন্দ উপভোগ করার। অধিকাংশ ধনী ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত আনন্দে এতটাই মত্ত থাকেন যে, পথশিশুদের কষ্ট তাদের কাছে প্রায় অজানা। এ ধরনের সামাজিক অসমতা দূর করতে হলে আমাদের সকলের উচিত একটু সহানুভূতি প্রদর্শন করা। ছোট ছোট সহযোগিতাই হতে পারে একটি বিশাল পরিবর্তনের সূচনা। সমাজের সকল স্তরের মানুষের উচিত প্রতিটি ঈদে একটু হলেও সেই অংশীদারিত্ব দেখানো, যাতে করে পথশিশুদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এমনকি বিদ্যালয়, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে সমাজের প্রতিটি কোণে মানবতার আলো ছড়িয়ে পড়বে। সরকারেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নীতি-নিয়ম ও বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে যদি পথশিশুদের জন্য নিয়মিত সুবিধা ও উৎসবের আয়োজন করা যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিছু জেলা ও মহানগরীতে ইতোমধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেখানে স্থানীয় প্রশাসন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে মিলে কাজ করছে। এসব উদ্যোগের সফলতা দেখিয়ে, অন্যান্য অঞ্চলেও একই রকম সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়। ঈদ উদযাপন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি মানবতার এক ন্যায়বিচার ও সহমর্মিতার প্রতীক। যখন সমাজের ধনী অংশ এবং সচেতন নাগরিকরা নিজেদের আনন্দ ভাগ করে নেন, তখনই সত্যিকারের অর্থে ঈদের আনন্দ প্রকাশ পায়। পথশিশুদের জন্য যদি প্রতিটি ঈদে সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সামান্য হলেও আশার আলো সঞ্চার হয়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে, এই পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতা বেঁচে আছে। তাদের ছোট ছোট হাসি, আনন্দের চোখের ঝিলিক, একটি নতুন সূর্যোদয়ের মতো তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তন কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর পরিসরে ন্যায়বিচার ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। ঈদ হল ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও মানবিকতার উৎস। যখন আমরা নিজেদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও আনন্দ ভাগ করে নিই, তখনই আমাদের সমাজে এক নতুন সংহতি ও মিলনের ভাবনা সঞ্চারিত হয়। পথশিশুদের ক্ষেত্রে, সেই ছোট ছোট উদ্যোগগুলো তাদের মনে এক নতুন প্রেরণা জাগিয়ে তোলে। তাদের মুখের হাসি আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। ভবিষ্যতে যদি আমরা পথশিশুদের জন্য আরও উন্নত, সুসংগঠিত ও দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করি, তবে তাদের জীবনে শুধু একদিনের আনন্দের নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা হবে। আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি নাগরিকের উচিত এই বিষয়টি উপলব্ধি করা যে, সমাজের প্রতিটি সন্তান- যারা ধনী পরিবারে জন্ম নেয় বা যারা পথের মাঝে জন্ম নেয়- তাদের অধিকার সমান। সমাজের ধনী ব্যক্তি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থাগুলো যদি একত্রে হাত বাড়িয়ে এই উদ্যোগে অংশ নেয়, তাহলে পথশিশুদের জীবনে পরিবর্তনের সূচনা সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু একদিনের খুশির উৎস নয়, বরং এগুলো শিশুদের মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নের জন্য এক প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কাজ করবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি- পথশিশুরাও আমাদের সমাজের অংশ। তাদের প্রতি সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সমবেদনা প্রকাশ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে করে সবাই জানে, ঈদ উদযাপনের আনন্দ কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের প্রতিটি কোণে পৌঁছাতে পারে। সরকার ও এনজিওদের উচিত, একবারের উদ্যোগের পরিবর্তে নিয়মিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে পথশিশুরা প্রতি ঈদে বা বিশেষ উপলক্ষে তাদের জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দের ছোঁয়া পায়। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন দিক থেকেই সাহায্যের হাত বাড়ানো যেতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক হবে। পথশিশুদের কাছে ঈদ শুধু নতুন পোশাক, উপহার ও স্বল্প সময়ের আনন্দের উৎস নয়; বরং এটি তাদের জীবনে এক নতুন আশার বার্তা, এক মানবিক বন্ধনের প্রতীক। সমাজের প্রতিটি কোণে, যেখানে একদিকে আনন্দের দীপজ্যোতি জ্বলে, সেখানে অসংখ্য পথশিশু একাকী ও নিরর্থক জীবনের বেদনায় ভোগে। কিন্তু সামাজিক উদ্যোগ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা যদি তাদের জীবনে সামান্য হলেও সুখের সঞ্চার করতে পারি, তাহলে তা কেবল তাদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্যই এক আশার সুরভি নিয়ে আসতে পারে। আমরা সবাই যদি সামান্য হলেও এগিয়ে এসে পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করি, তাহলে সমাজে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবনে থাকবে আশার আলো, ভালোবাসার স্পর্শ ও মানবিকতার বন্ধন। এই পরিবর্তন কেবল একটি দিনের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রতিটি ঈদে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। আসুন আমরা সবাই মিলেমিশে এ প্রতিশ্রুতি দেই- পথশিশুদের ঈদকে নিজস্ব ঈদের মতো করে তুলি, যাতে করে তাদের জীবনেও আসতে পারে সেই অমূল্য আনন্দ, যেটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে উৎসবের মুহূর্ত নিয়ে আসে। এই প্রচেষ্টাই হবে সমাজকে আরও মানবিক, আরও সহানুভূতিশীল এবং আরও একাত্ম করে তোলার পথ।

ঈদ- সেকাল ও একাল

ঈদ- সেকাল ও একাল

সেকালের ঈদ উৎসবের আয়োজন স্মৃতিমধুর। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এর আয়োজন চলত মাস ধরে। বাড়িঘর  ধোয়া-মোছা,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, ভালো খাবারের আয়োজন , নতুন পোশাক-আশাক কেনা ইত্যাদি এ ঈদ উৎসবের অংশ। সুগন্ধযুক্ত চালের গুঁড়ি বা গুঁড়া দিয়ে ফুল পিঠা তৈরি করা হতো, এর আয়োজন চলত সমমনা মহিলাদের উদ্যোগে, পাড়া প্রতিবেশীদের প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে, দিনের কিছুটা সময় বেছে নিয়ে, বসার পিঁড়ি জোগাড় করে সবাই একত্রে বসে, পিঠা তৈরি করে সেগুলোতে যার যার পছন্দমতো নকশা করত। খেজুরের কাঁটা ব্যবহার করে এ নকশা করা হতো। অপরূপ নকশা ফুটে উঠত প্রত্যেকটি পিঠায়। যে যত তাড়াতাড়ি পিঠা তৈরি শেষ করতে পারত, তার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সে বেশি প্রশংসিত হতো। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে পান-সুপারি খাওয়া হতো। তখন এক আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। প্রত্যেকটি পিঠাকে সর্ষের তেলে ভেজে দীর্ঘদিন ধরে মাটির হাঁড়িতে রেখে দেওয়া যেত। অবশেষে খাবার হিসেবে এ পিঠা পরিবেশনের জন্য আবার তেলে ভেজে গুড় বা চিনির শিরায় ভিজিয়ে রেখে খাওয়া হতো। এ এক মহাযজ্ঞ বলে বিবেচিত হতো। অনুরূপভাবে একটি টিনের টুকবার মাঝে সারি সারি লাইনে তারকাটার সাহায্যে ছিদ্র করা হতো। এটাতে ‘চালুন’ বা চালোন বলা হতো। চালোনের চারদিকে বাঁশের চটি দিয়ে ফ্রেমে বেঁধে হাতে ধরার ব্যবস্থা করা হতো। দুজন মহিলা এই চালোনের ওপরে সিদ্ধ চালের নরম ভাতের গোলা রেখে, হাতে ডলে বা চাপ দিয়ে ঝুড়ি পিঠা বানাত। দুপুরের রোদে পাটি বিছিয়ে ঝুড়ি পিঠা শুকানোর নিয়ম ছিল। আবার কাঠফাটা রোদে টিনের চালের ওপরেও এসব পিঠা ঝরঝরে করে শুকানো যেত। মাটির হাঁড়িতে এ পিঠা রাখার নিয়ম প্রচলিত ছিল। পরিবেশনের আগে বা ঈদের দিনে গুড়ের শিরায় ঝুড়িপিঠা খেতে খুব মজা হতো। এ রীতি আজও গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে। অতিথি আপ্যায়নের সময়ও এ পিঠার ওপর চিনির ছিটা দিয়ে পরিবেশন করা যায়। এছাড়া গ্রাম্য বধূদের জানা আরও নানা ধরনের চালের সেমাই, টেপা সেমাই, ঝিকিমিকি পাতার পিঠার আয়োজন করা হতো সেকালে। কৃষকের বাড়িতে পোলাও বা খিচুড়ির জন্য বিশেষ জাতের ধান উৎপন্ন হতো। চিনিগুঁড়া, কালিজিড়া চাল, আমবোরো, সালিধানের চাল গৃহিণীরা সঞ্চয় করে রাখত। এসব চালের পিঠা-পায়েসও তখন বেশ প্রচলিত ছিল। ময়মনসিংহ ও রংপুর এলাকায় মুরগির মাংসের ভুনার সঙ্গে ঈদের দিনে চালের গুঁড়ার রুটি খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। খিচুড়ির সঙ্গে খাওয়া হতো গরুর মাংসের রেজালা। পোলাও খাওয়ার জন্য মুরগির কোরমা করত বিত্তশালী পরিবার। রাতের আহারের জন্য থাকত সকালের রান্না করা কাঁচা সেমাইয়ের ক্ষীর, পিঠার কিছু রেখে দেওয়া অংশ ও দুপুরের ভোজের অংশ। সারাদিন থাকত আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও খাওয়া-দাওয়া। দরিদ্রদের মাঝে এসব খাবার বিলিয়ে দেওয়া ধর্মীয় চিন্তার অংশ ছিল। কাউকে অভুক্ত রাখা হতো না। সকলের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত ও কুশল বিনিময় করাই ছিল ঈদের দিনে বেড়ানোর আসল উদ্দেশ্য। সমবয়সীদের সঙ্গে হাসিমুখে খোশগল্প করার অফুরান সময়ের দিন ছিল তখনকার ঈদের দিন। প্রতিঘরে বা প্রত্যেক পরিবারে প্রায় সবার ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড় পরিধান করা তখনকার দিনেও প্রচলিত রীতি ছিল। কৃষক পরিবারে সারাদেশে লুঙ্গি-তহবন-ফতুয়া বা আলীগড়ি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা হতো। কৃষাণীর জন্য বরাদ্দ থাকত উন্নতমানের শাড়ি। ছেলেমেয়েদের জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবি, ঘাঘরা, গারারা-কুর্তা। দরিদ্র জনগোষ্ঠী জাকাতের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, লুঙ্গি, জামা ইত্যাদি সংগ্রহ করত। সেগুলোই পরে তারা সবাই ঈদের আনন্দে নতুন পোশাকে সেজে সবার সামনে হাজির হতো। মেয়েদের জন্য চুলের ফিতা, বেলোয়াড়ি চুড়ি জোগাড় করা হতো। জুতা, সেন্ডেল তো ব্যবহারের জন্য পাওয়া যেতই। ঈদ মানে খুশি। সেই খুশিতে সবাই শরিক হয়ে জীবনের স্বাদ আর অনাবিল আনন্দ লাভ করত সাধারণ জনগণ। আনন্দ করার এ সংস্কৃতি কালের প্রবাহে আজ নতুন রূপে রূপায়িত হয়েছে। ঈদের দিনে সেকালে ভোরেই পুকুরে ডুব দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে আগে গোসল সেরে নিত। বয়স্করা বাড়িতে সুগন্ধী সাবান মাখিয়ে কুয়োর পানিতে গোসল করতেন এবং তা করতেন খুব সকালবেলা। ঘরের কাজ-কর্ম শেষ করে মহিলারা দ্রুত গোসল সেরে নিতেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাত ধরে বা বয়স্কদের সঙ্গে নতুন কাপড় ও সুগন্ধি বা আতর মেখে ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া ছিল সেকালের রেওয়াজ। রোজার ঈদের নামাজ আদায়ের আগে ‘ফিতরা’ আদায় করা প্রতি পরিবারের ওপর তাগিদ ছিল। এটা রোজাদারের জন্য আদায় করা ধর্মীয় বিধান। জাকাতও আদায় করা হতো। কিশোরগঞ্জের ‘শোলাকিয়া’ ঈদগাহে দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ দলে দলে ঈদের নামাজ আদায় করতে অতীতের মতো আজও আসেন। ময়মনসিংহের উত্তরে শেরপুরের উত্তর সীমান্তেও একটি ঐতিহাসিক ঈদগাহ রয়েছে। একালের মতো সেকালের বড় বড় শহরগুলোতেও ঈদগাহ-মাঠ ছিল। ঈদের বড় জামাত সেসব ঈদগাহ-মাঠে অনুষ্ঠিত হতো। ঢাকার বুকে মুঘল যুগের ঈদগাহ মাঠ ধানমন্ডিতে আজও বিদ্যমান আছে। সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া এলাকার গ্রামাঞ্চলে স্থায়ী ঈদগাহ-মাঠ বিদ্যমান ছিল। সেসব ঈদগাহ-মাঠে বিশেষ ব্যবস্থায় পর্দা দিয়ে মহিলাদের জন্য ঈদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হতো। যেমন আজও হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। এফ এইচ হলের মাঠেও এরূপ জামাতের প্রচলন আছে। মোহাম্মদপুরের একটি মসজিদে বর্তমানে এরূপ ব্যবস্থা হয়। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের এক গ্রামে বিরাটদিঘীর পাড়ে স্থায়ী ঈদগাহ-মাঠ বিদ্যমান ছিল। সেখানে একসময় ঈদের জামাত শুরু হওয়ার আগে সারা বছরের জাকাত ও ফিতরা-ইমাম সাহেবের হেফাজতে জমা করার বিধান ছিল। এ গ্রামের জনগণের মাঝে ‘ফসলি জাকাত’ দেওয়ারও রীতি আছে। সে গ্রামের মসজিদ সংলগ্ন গৃহের প্রশস্ত দ্বিতল মাদ্রাসা-কক্ষে মহিলাদের জুমা ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় আজও। শৈশবে পুরান ঢাকার শহুরে আবহে বড় হয়েছি বলে আমাদের ঈদের আনন্দ ছিল একটু ভিন্ন রকম। ঈদের চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের হাকিদার ‘আগামীকাল ঈদ’ এ বার্তা সারা পাড়া ও মহল্লায় এলান করে দিতেন। কিশোর-কিশোরীরা আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করে পাড়া মাতিয়ে তুলত। পুকুরে কিশোরীদের গোসল করার প্রচলন ছিল। আজ সে নিয়ম প্রচলিত নেই। ঈদের দিনে পুরানো রঙ করা কাপড় ফিতার মতো করে কেটে চুল বাঁধার রীতি ছিল। এই ফিতা ‘নবক’ নামে পরিচিত ছিল। নতুন জুতা, সেন্ডেল পায়ে দিয়ে নতুন কাপড় পরে সেজে-গুজে কিশোর-কিশোরীরা পথে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে সমবেত হতো। এ স্থানটি আনন্দের মূল লক্ষ্য ছিল। বৃষ্টির দিনে মহল্লার মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদের জামাত হতো। নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে খোরমা, সেমাই দিয়ে নাস্তা করার রেওয়াজ ছিল। দুপুর বেলা বাড়িতে রান্না করা পোলাও-কোরমা আনন্দের সঙ্গে খাওয়াই ছিল নিয়ম। এ সময় বন্ধু, আত্মীয়-প্রতিবেশীদেরও আপ্যায়ন করা হতো। বাড়িতে বাড়িতে মুরব্বিদের পা ছুঁয়ে সালাম করা হতো। সালামের বদলে ঈদী বা সালামি দেওয়া হতো। নতুন জামাই শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করতে আসত, সালামি পেত কাঁচা টাকা। এই টাকার মূল্য ছিল অনেক। বড় রাস্তার পাশে ঈদীতে পাওয়া টাকা দিয়ে খেলনা কেনা যেত। ঈদের পরের দিন চকবাজারে ও আজিমপুরে বড় মেলা হতো। এসব মেলায় চড়কিতে ওঠা যেত, মাটির ও কাঠের খেলনা কেনা যেত। ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে আনন্দ বিরাজ করত। গৃহস্থালি বস্তুও কেনা যেত মেলা থেকে। বিশ্বায়নের যুগে ঈদের উৎসব ভিন্ন স্বাদ পৌঁছায় মুসলমানের ঘরে ঘরে। পুরানো দিনের চালের গুঁড়া দিয়ে করা সেমাইয়ের বদলে আজকাল বাজার থেকে সবাই কিনে আনে লাচ্ছা সেমাই, মেশিনে গড়া সেমাই। বড় বড় কোম্পানি এসব সেমাইয়ের ব্যবসা করছে। গুঁড়া দুধ, কনডেনস্ড মিল্ক সহজেই বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করে মিষ্টি জাতীয় জর্দা ফিরনি পায়েস রান্না করা হয়। তবে খোরমা, খেজুর, কিসমিস, বাদাম, কেশোনাট ইত্যাদিও ব্যবহার হয়। ঘিয়ে ভাজা পরাটা, রুটি, খাসি, গরুর ভুনা মাংস ছাড়া খিচুুড়ি-পোলাও রান্না করা হয়। এর সঙ্গে আরও থাকে কোরমা। ঈদের দিনের উৎসবকে সার্থক করে তোলার আয়োজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়ার উৎসাহে গৃহিণীদের মাঝে কেনাকাটা সাড়া জাগায়। বাজার-হাট সরগরম হয়ে ওঠে। সেকালে একজন একপ্রস্থ নতুন কাপড় নিয়েই খুশি থাকত। আজকের দিনে নানা সেটের বাহুল্য ছাড়া ঈদ যেন পূর্ণতা পায় না। ঘরে রান্না করা খাবারে পরিতৃপ্ত থাকে না মানুষ। রেস্টুরেন্টে বেশি খরচের অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে তৃপ্তি পেতে চায়। সামর্থের পার্থক্য অনুযায়ী নারীদের সাজ-সজ্জার জন্য রকমারি ইমিটেশন প্রসাধনী কেনা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অনেকে পর্যটন কেন্দ্রে বা বিদেশে পাড়ি দিয়েও ঈদ উদ্যাপন করেন। অল্পে তুষ্ট হওয়ার দিন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হয়! তবে শহর ছেড়ে গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের সান্নিধ্যে গিয়ে ঈদ উদ্যাপন করারও হুজুগ আছে এখন। ফলে যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর খুব চাপ পড়ে। দুর্ঘটনাও ঘটে অনেক। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি (কমপিটিটিভ) চাওয়া-পাওয়ার যুগে মানুষের মাঝে ‘ঈদ মানে নির্মল আনন্দ’ পাওয়ার অনুভূতিটাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সমান সমান বাহ্যিক পাওয়ার রেওয়াজ সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। আসলে মানুষ ধনী-দরিদ্রদের মাঝে সমতার ভিত্তিতে তৃপ্তি পেতে চায়। আসুন, আমরা অল্পে তুষ্ট থাকতে অভ্যস্ত হই। সুখী থাকি। সবার প্রতি সবার সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অটুট থাকুক।  

সবাই মিলুক উৎসবে

সবাই মিলুক উৎসবে

ইসলামে মুসলমানদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দুটি বিশেষ আনন্দের দিন নির্ধারণ করেছেন: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এই দুটি ঈদের দিন মুসলিমদের জন্য একদিকে যেমন অত্যন্ত খুশি ও আনন্দের, অন্যদিকে ইবাদত, তাকবির, নামাজ, দান-সদকা এবং পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন তৈরি ও সুদৃঢ় করার। অধিকন্তু, সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সার্থকতা প্রকাশ পায়। কিন্তু বাস্তবের ঈদচিত্রে দেখা যায় ভিন্নতা। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, এতিম, গৃহহীন, পথশিশু, একাকী ও যুদ্ধবিধ্বস্তদের ঈদ আনন্দের না হয়ে, বরং হয়ে উঠে বেদনার। তখনই সমাজ থেকে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সার্থকতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলোর ঈদ হয় জমকালো ও আনন্দময়। ঈদের প্রস্তুতি, কেনাকাটা, সাজসজ্জা সবটাতেই থাকে এক আলাদা উচ্ছ্বাস। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ঈদের আমেজ। নতুন দামি পোশাক, নানারকম সুস্বাদু খাবার, ঈদের নামাজ, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানো, উপহার বিনিময় ও ঘোরাঘুরির মাধ্যমে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন তারা। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ঈদ উদ্যাপন কিছুটা হিসাব-নিকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থের সঠিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা সাধ্যমতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন। তাদের দামি পোশাক বা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে থাকে পারিবারিক ভালোবাসা ও আত্মীয়তার বন্ধন, যা তাদের ঈদকে আনন্দময় করে তোলে। সামর্থ্যরে মধ্যে থেকেই ঈদের আনন্দ খুঁজে নেন তারা। অপরদিকে, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের জন্য ঈদ মানেই এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা। নতুন জামা, ভালো খাবার, উপহারÑ এসব তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। প্রতিদিনের আয় বা দিনমজুরি দিয়ে যেখানে তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়, সেখানে ঈদের আনন্দের জন্য খরচ করা তাদের জন্য এক ধরনের বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অগ্রাধিকারগুলোর সঙ্গে বড় বেমানান। তাই, তাদের ঈদ কাটে পুরানো জামা-কাপড়ে, ছেলেমেয়েদের দেওয়া মিথ্যে আশ্বাসে এবং ভালো কিছু রান্না বা প্রতিবেশীদের দেওয়া খাবারের আশায়। এতিম ও পথশিশুদের ঈদ কাটে এক ভালোবাসা ও স্নেহহীন নির্মম বেদনায়। বাবা-মা ছাড়া ঈদ অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছেই ঈদ বলে মনে হয় না। সেখানে এতিম বাচ্চাদের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলেই জীবন থমকে যায়। এতিমখানায় থাকা শিশুরা হয়তো নতুন জামা পায়, একটু ভালো খাবার পায়, কিন্তু বাবা-মায়ের আদর ও ভালোবাসার অভাব তাদের ঈদের আনন্দকে পরিণত করে দেয় বেদনায়। বাবা-মার আদর-ভালোবাসা ছাড়া জীবন তাদের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা। অন্যদিকে, যারা এতিমখানাতেও ঠাঁই পায় না, যারা খোলা আকাশের নিচে বেড়ে ওঠে, তাদের ঈদ যেন আরও নির্মম। ঈদের দিন তাদের মধ্যে থাকে এক মুঠো ভালো খাবার জোগাড় করার প্রতিযোগিতা। মসজিদ, হোটেল ও রেস্তোরাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তারা খুঁজতে থাকে মানুষের সহানুভূতি, একটু ভালো খাবার, ভালো জামা ও কিছু আর্থিক সাহায্য। কিছুটা পেলেই তাদের মুখে ফুটে ওঠে নির্মল হাসি। তাদের থাকে না কোনো নতুন পোশাকের উচ্ছ্বাস, আনন্দের ঝলক বা পরিবারের উষ্ণতা। অনেকেই জীবিকার তাগিদে প্রিয়জনদের ছেড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে অবস্থান করছেন বা কেউ কর্মব্যস্ত জীবনে একাকী হয়ে গেছেন। তাদের ঈদ মানেই নিঃসঙ্গতা, স্মৃতির আক্ষেপ, আর দূর থেকে আপনজনদের আনন্দ দেখার বেদনা। প্রবাসীরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারকে সুখী করার চেষ্টা করেন। তাদের পাঠানো অর্থে পরিবারের সদস্যরা নতুন পোশাক পরে, সুস্বাদু খাবার খায় এবং আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু প্রবাসী ব্যক্তিটি ঈদের দিনটি কাটান নিঃসঙ্গতায় ও বেদনায়। ব্যস্ততার ফাঁকে হয়তো পরিবারকে ভিডিও কলে শুভেচ্ছা জানান, কিন্তু কাছের মানুষদের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সৌভাগ্য তাদের হয়ে ওঠে না। শুধু প্রবাসীরাই নন, সমাজের অনেক প্রবীণও ঈদের দিন কাটান একাকীত্বের মধ্যে। অনেক বাবা-মা বাস্তবের নিষ্ঠুরতায় বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন। পরিবার থেকে তারা একেবারে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একদিন এই পরিবারকে ভালো রাখার জন্য তারা নিজেদের সব সুখ-স্বপ্ন ত্যাগ করে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। যারা একদিন পরিবারের সকলের সব ঈচ্ছে-আকাক্সক্ষা পূরণ করেছেন, তারা পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেছেন এবং তাদের ঠিকানা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। ঈদ তাদের কাছে দুঃখ, বেদনা, স্মৃতি ও একাকীত্বে পরিপূর্ণ একটি সাধারণ দিন। সারাদিন আপনজনদের অপেক্ষায় থেকে স্মৃতিগুলোকে সঙ্গী করে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। অসুস্থ মানুষদেরও ঈদ কাটে যন্ত্রণা ও বেদনায়। অনেক রোগী বিভিন্ন জটিল রোগ যেমনÑ হৃদরোগ, হেমোফিলিয়া, কিডনি ফেইলিওর ও ক্যানসারে  আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে আছেন। তাদের কাছে ঈদ মানে হয়তো সাধারণ আরও একটি যন্ত্রণা ও বেদনার দিন। অনেক দেশের ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দেওয়ার পেছনে রয়েছে যুদ্ধ, দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক সংকট। উদাহরণস্বরূপÑ ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক ও ইউক্রেনে বোমার শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তারপর আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্তভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। অথবা প্রিয়জনের লাশ খুঁজতে থাকে অথবা লাশের পাশে বসে কাঁদে। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ হচ্ছে আরও একদিন বেঁচে থেকে লড়াই বা বেঁচে থাকার লড়াই করা। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ঈদ বছরের পর বছর ধরে ভিন্ন এক বাস্তবতায় কাটছে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের রমজানেও এই নৃশংসতা থামেনি। ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরাইল গাজার ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে ৭০০-এর বেশি নিরপরাধ নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘের মতে, গাজায় এখন আর কোনো এলাকাই নিরাপদ নয়। ঈদের দিনে যেখানে শিশুরা নতুন জামা পরে আনন্দে মাতোয়ারা থাকার কথা, সেখানে গাজার শিশুরা হাত পেতে খাবার চায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া স্বজনদের খুঁজে বেড়ায়। শুধু ফিলিস্তিন নয়, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও ঈদের চিত্র প্রায় একই। এতটার পরও তারা সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখে, আশার আলো খোঁজে, শান্তির প্রত্যাশা করে এবং ঈদ উদ্যাপনের চেষ্টা করে। ঈদ যদি শুধু ব্যক্তিগত আনন্দের উৎসব হয়, তবে তা প্রকৃত সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। আমাদের উচিত, ঈদের আনন্দ শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। আমরা যদি জাকাত, ফিতরা, দান ও সহানুভূতির মাধ্যমে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের পাশে দাঁড়াই, এতিম ও পথশিশুদের ভালোবাসা ও স্নেহ প্রদান করি, নিঃসঙ্গ ব্যক্তি ও প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটাই এবং ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের জন্য দোয়া ও সহায়তা করি, তাহলেই ঈদ সত্যিকার অর্থে সবার জন্য ঈদ হয়ে উঠবে বলে আশা করতে পারি।

সেবা ও ত্যাগে ভিন্ন মাত্রা পাক ঈদের আনন্দ

সেবা ও ত্যাগে ভিন্ন মাত্রা পাক ঈদের আনন্দ

শিশু-কিশোর বয়সে ঈদের যে আনন্দ তার সঙ্গে আর কিসেরই বা তুলনা হতে পারে? ব্যক্তির যত বয়স বাড়ে, সেই আনন্দের তাগিদ ও উপভোগ ফিকে হতে থাকে। তখন আবার শিশু-কিশোরদের আনন্দ দেখেই ভিন্নতর এক খুশি ছলকে ওঠে হৃদয়ে। ছেলেবেলায় নতুন জামা-জুতো পরে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি ঘুরে বেড়ানো আর নানা পদের লোভনীয় সব খাবার খাওয়ার মধ্যে যে মজা থাকে, তা চিরকালীন স্মৃতির সঞ্চয়। বাবা-মা রোজা রাখতে দিতে চান না, তবু কান্নাকাটি করে একটা-দুটো রোজা রাখা, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের দিন বাবা কিংবা বাড়ির মুরুব্বিদের সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়া বালক কিংবা কিশোরের মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দ এনে দেয়। বলাবাহুল্য, বালিকা-কিশোরীদের মনেও সেই আনন্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। একটু যারা বেশি সংবেদনশীল, তারা অনুভব করে এ মহোৎসবে কোনো কোনো বন্ধু কিংবা সহপাঠীর অনুপস্থিতি। আবার পূজার উৎসব বা বড়দিনের ব্যতিক্রমী আনন্দ আয়োজনে যোগ দেওয়ার সুযোগ মিললে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সমাজের বিচিত্র উৎসব ও বিবিধ সংস্কৃতির অন্তর্গত সারসত্যটুকু জেনে ওঠা যায়। শিশু-কিশোররাই কি কেবল ঈদের আনন্দে মশগুল হয়? ঠিক তা নয়, ঈদে সব বয়সীরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ আহরণ। গিন্নিরা ফিরনি-পায়েস আর পোলাও-কোর্মা ইত্যাদি উপাদেয় খাবার রান্না করে সুখ পান। এখনো এই কাজ তাদের একচ্ছত্র অধিকার বলে গণ্য করেন। বাড়ির আর দশটা নেমন্তন্নের সঙ্গে ঈদের রান্নাবান্না আর খাওয়ানোর তৃপ্তিকর আনন্দ সমতুল্য হতে পারে না। সময় বদলালেও এখনো অনেক মা, এমনকি বড় বোনেরাও পরিবারের সদস্যদের জন্য নিজ হাতে পোশাক তৈরি করেন। প্রতিটি সেলাইয়ের ফোঁড়ে যেমন থাকে মমতা আর ভালোবাসা, তেমনি প্রতিটি বুননে প্রাপ্তি ঘটে চলে অসাধারণ এক সুখ। ঈদের বহু আগে থেকেই  এই সুখের সূচনা; এও ঈদেরই আনন্দ। এতক্ষণ যা বললাম, তাকে সাবেক আমলের ঈদের বৈশিষ্ট্য বলে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবেন আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ কিংবা তরুণী। কারণ, তারা অভাগা; বৃহৎ পরিবারের বহুধা বিভক্ত এক ক্ষুদ্রাংশের বাসিন্দা, স্কয়ার ফিট মাপের ফ্ল্যাটের বিচ্ছিন্ন কক্ষে যার পৃথিবী পুরে রাখা। তার কাছে ঈদ কিছুটা বোরিং, কিছুটা ফাঁকা ঢাকায় হৈহল্লার সুবর্ণ সুযোগ। ঈদের পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবি তার তেমন পছন্দের নয়, তবু দু-চারটে গড়াগড়ি খায় ওয়ার্ড্রােবে। নিতান্ত অনিচ্ছায় তার একটি বেছে নেওয়া। যদিও তারও আছে কিছুটা নিকট অতীতের ঈদ-স্মৃতি। ঢাকার বাইরে ‘গরিব-গুর্বো’ শেকড়ে ফেরার অনিবার্যতা এবং সেইসঙ্গে এই হৃদয়হীন শহরে অভিভাবকের কোনো স্বজন বা বন্ধুর বাসায় কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত, কিছুটা আরোপিত আনন্দ সন্ধানের অভিজ্ঞতা। এই বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে এটি আমাদের সমর্থনও পায় না।    তারপরও বলব, প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই এমন একজন অন্তত ব্যক্তি থাকেন যিনি রমজান মাসের প্রতিটি রোজা পালন করেন, তারাবি পড়েন। এই যে এক মাসের নামাজ-রোজা পালন শেষে ঈদের দিনটি আসে, সে দিনটি ওই ব্যক্তির জন্য এক অসামান্য ভালোলাগা বয়ে আনে। তার আনন্দের প্রকৃতি ও ধরন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে নামাজ পড়ে আসার পর সারাটা দিন হয়তো তিনি গৃহেই থাকেন। কোনো আনন্দস্থলে যোগ দিতে যান না, কিংবা আনন্দের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন না। তবু ঈদের দিন তার হৃদয় গভীরে যে আনন্দের সুর অনুরণিত হয়, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমার আব্বার কথাই বলি, আমাদের বহুজনের আব্বাও এমনই, নব্বুই ছুঁইছুঁই বয়সেও একটি রোজাও কামাই করেন না তারা। আব্বা শেষ দশ রোজায় মসজিদে অবস্থান করে মৌনব্রত পালনও (ইতেকাফ) করতেন একসময়। দশ গ্রামের এক সম্মানিত ধর্মভীরু ও ধর্ম-অভিভাবকের সন্তান হিসেবে আব্বা যতটা পেরেছেন ধর্মকর্মে নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর ঈদের দিনের খুশির সঙ্গে আমাদের ভাইবোনের ঈদ-আনন্দের কি তুলনা দেওয়া সাজে? মানি বা না মানি, ইন্টারনেটের ব্যাপকতা, সেলুলার ফোনের দাপট এবং আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের আগের ও পরের ঈদের ভেতর এক বিপুল ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে। সশরীরে নিকটাত্মীয়ের বাড়ি উপস্থিতির বদলে ভার্চুয়াল দেখাসাক্ষাৎ কি ‘কোলাকুলি’ সেরে নেওয়ার সুবিধা জনপ্রিয় হচ্ছে। ম্যাসেঞ্জারের ঝলসে ওঠা ইমেজ কিংবা ফোনের গ্রুপ টেক্সট হটিয়ে দিয়েছে রঙিন ঈদকার্ড পাওয়ার সূক্ষ্ম সুখ। চ্যানেলগুলো সাত দিন-দশ দিনের আনন্দ-পসরা সাজিয়ে বসছে। ঈদের অবকাশ যাপন অলিখিতভাবে দীর্ঘই ছিল, চলতি বছর থেকে তা সরকারি অনুমোদন পাচ্ছে। এ থেকে বিনোদন উৎপাদকরা আরও উৎসাহিত হবে বলে ধারণা করা যায়। আজকের ভোগী মানুষ নিজেকে কিছুটা সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থানে আত্মকেন্দ্রিকতায় রেখে, উপভোগ-সর্বস্বতায় নিমগ্ন থাকায় ঈদ নামের আশ্চর্য সামাজিক, সাম্যবাদী ও ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল পরম সুযোগটি মানবিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এই হারানোর ক্ষতি নিয়ে মোটেই ভাবিত নয় অধিকাংশ নাগরিক শিক্ষিত মন। এক আত্মঘাতী আত্মপরতা ও উদাসীনতার জালে জড়িয়ে ভোজনসুখ, পোশাকের ঝলক, আর বিনোদনের গ্রাহক হিসেবে মানবসত্তার সকরুণ পরিবর্তনে নিশ্চয়ই তবু কোথাও বিবেকবোধ জেগে উঠছে। ঈদে শত বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি সহ্য করে রাজধানী থেকে কোটি মানুষ তার শেকড়ের কাছে ফেরেন। দেশের বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মধ্যে যে স্বস্তি ও শান্তি, তার ছিঁটেফোঁটাও কি থাকে মহানগরীর ফ্ল্যাটে বন্দি বিচ্ছিন্ন ঈদ উদযাপনে? আপনি নিকটজনের সান্নিধ্যে মহানন্দে ঈদ করছেন। অথচ অনেকেরই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া হয়নি নানা কারণে। তার ঈদ নিরানন্দে-মেশা; এমন বন্ধু কিংবা পরিচিতজনের কাছে আপনার একটি টেলিফোনই হয়ে উঠতে পারে মহা খুশির ব্যাপার। আমার পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক হয়েছে। খুব কাছেরই কোনো বস্তিতে ঈদ এসেছে বছরের বাকি ৩৬৪ দিনের মতোই। হঠাৎ আপনি সেখানে গেলেন কয়েকটা নতুন পোশাক নিয়ে সেখানে। অচেনা বালক কিংবা মধ্যবয়সী কোনো নারীর হাতে তুলে দিলেন তার কাছাকাছি মাপের কোন পোশাক। কেমন হবে? দেখুন চেষ্টা করে তাদের আনন্দ আর হাসি দেখে আপনার নিশ্চয়ই মনে হবে, অপরকে সুখ দিতে পারলে এক ধরনের তৃপ্তি আর সুখ নিজের মনে এসেও ধরা দেয়। হাসপাতালে দুস্থদের ওয়ার্ডে যান দোকান থেকে দু’তিন পদের কেনা খাবার নিয়ে। কুড়িজনের জন্যই নিন খাবারটা। ঈদের দিন অনেক রোগীরই কাটে স্বজনদের মুখ দেখার আশায়। অথচ তার সেই আশা পূরণ হয় না। না, আমি কোনো মানবিক গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছি না। বিশ্বাস না হয়, একবার গিয়েই দেখুন হাসপাতালে। দু’হাতে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে। ঈদের দিন আপনার এই ‘বেড়ানোটি’ কিছুটা অস্বস্তিকর ও বেহুদা মনে হলেও আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে যদি কাজটি আপনি করেন তাহলে আপনার অন্য ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হবেÑ সেটা জোর দিয়েই বলতে পারি। মানুষ মানুষের জন্য। ঈদের আনন্দ যদি কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যায় অন্যকে আনন্দ দিয়ে তাহলে সেটা তো আপনি করতেই পারেন। ঈদুল ফিতরে আমাদের ‘জাতীয় সংগীত’ হয়ে উঠেছে জাতীয় কবির গানÑ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। অধিকাংশ গানের মতোই এটি আমরা গাই, খুশির ঈদ এসেছে এই ভেবে আপ্লুত থাকি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখি না এই গানের ভেতরেই ঈদের মর্মবাণী কী তাৎপর্যপূর্ণভবেই না আমাদের জন্য কবি লিখে গেছেন। খুব ছোট্ট দুটি অংশ উদ্ধৃত করছিÑ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে,/শোন আসমানী তাগিদ।... আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ,/হাত মেলাও হাতে... শত্রুমিত্র ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে মিলে মহান হয়ে ওঠার, বলা ভালো মানুষ হয়ে ওঠার বড় সুযোগ সামনে এনে দেয় ঈদ। অথচ আমরা এদিকটিতে কী সহজে উপেক্ষা করে যাই। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার গভীর আনন্দ-আহ্বান এড়িয়ে যাই। যদি তা না যেতাম, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ঈদের দিনটিকে পরমানন্দের দিবস করে তুলতে পারতাম। এবারের ঈদে কি আমরা এদিকটি বিবেচনা করে দেখব? ঈদ মোবারক। ঈদের ছুটিতে নিরাপদে থাকুন।

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর

বাংলাদেশ ও চীন অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং ক্ল্যাসিক সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। বিনিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা, চীন শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল শুরুর ঘোষণা, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং হৃদরোগ সার্জারি যানবাহন দানের বিষয়ে পাঁচটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে বিনিয়োগের জন্য চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার বেজিংয়ের ‘দ্য প্রেসিডেনশিয়াল’-এ চীনা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এক বিনিয়োগ সংলাপে চীনা বিয়োগকারীদের উদ্দেশে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে ব্যবসার সম্ভাবনার সুবিধা গ্রহণ করার আহ্বান জানান। শুক্রবার সকালে বেজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপল-এ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। বাংলাদেশে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই অভ্যুত্থান ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের পথ সুগম করেছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় আসীন। চীনের সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং সম্ভাব্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ (এফটিএ) আলোচনার জন্য নতুন পথ উন্মুক্ত। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করে। ওই সফরে দুই দেশ প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২১টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে ২১টি সেতু, ১১টি মহাসড়ক নির্মাণে সহায়তা করেছে। এছাড়া ২৭টি জ্বালানি শক্তি ও বিদ্যুৎসহ অসংখ্য প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে চীন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্ব দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা থেকেই গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের ধারাবাহিক সমর্থনের কথা, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ্য। মিয়ানমারের গৃহহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট সমাধানেও বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করায় চীনের ভূমিকা রয়েছে। এসবই উভয় দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার পরিধি ও পরিচয় তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ-চীনের এই সম্পর্ক শুধু বাংলাদেশের জন্যই গড়ে ওঠেনি, বরং নানা কারণে চীনেরও স্বার্থ রয়েছে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণে চীনের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মৈত্রী বন্ধনকে অটুট রাখার জন্য উভয় দেশের ইতিবাচক ভূমিকা বরাবরের মতো সমুন্নত থাকবে বলেই বিশ^াস। তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রতিষ্ঠানকে স্বাগত জানানো তাৎপর্যপূর্ণ। চীনে আম-কাঁঠাল-পেয়ারা রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়া, গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ-ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি সংস্কারমুখী বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সুসংবাদ। ঈদের আগে প্রধান উপদেষ্টার চার দিনের চীন সফর বাংলাদেশের জন্য বড় সফলতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি করবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা।

পবিত্র ঈদুল ফিতর

পবিত্র ঈদুল ফিতর

পবিত্র রমজানের শেষে ঈদুল ফিতর এসেছে সবার জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে। জাতীয় ঈদগাহসহ দেশের সর্বত্র নির্ধারিত স্থানীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হবে ঈদের জামাত।  ঈদুল ফিতর ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্যই বয়ে আনুক সুনির্মল এক আনন্দবার্তা! ঈদুল ফিতর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে খুশির এই উপলক্ষটি। ঘরে ঘরে, জনে জনে আনন্দ ও খুশির বার্তা বয়ে আনে ঈদ। দিনটি সৌভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলকে এক কাতারে শামিল করার চেতনায় করে উজ্জীবিত। কল্যাণের পথে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূলমন্ত্রে করে দীক্ষিত। ঈদের আগে রোজার একটি মাস সংযম ও আত্মত্যাগের মাস। রোজার কঠোর অনুশীলন ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি এবং গরিব-দুঃখী-অনাহারীদের কষ্ট অনুভবের প্রেরণা দেয়। এ সময় গরিব-দুস্থদের ঈদের আনন্দে শরিক করার জন্য রয়েছে ফিতরা ও জাকাতের ব্যবস্থা, যা বিত্তবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য প্রদেয়। নামাজের ভেতর দিয়ে ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করা হয়। নতুন পোশাক পরে সকালে ঈদগাহে নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচি। ধনী-গরিব সবাই এই দিনে মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। ঈদুল ফিতরের মূল তাৎপর্য বিভেদমুক্ত জীবনের উপলব্ধি। ভুল-ভ্রান্তি, পাপ-পঙ্কিলতা মানুষের জীবনে কমবেশি আসে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। পরম করুণাময় আল্লাহ্ চান মানুষ পাপ ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসুক সৎপথে। সম্প্রীতির আনন্দধারায় সিক্ত হয়ে উন্নত জীবন লাভ করুক। ঈদুল ফিতর মানুষকে এই শিক্ষা দেয়। ঈদুল ফিতরের উৎসব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে সমাজের ধনী-গরিবের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে। শ্রেণিবৈষম্য বিসর্জনের মধ্য দিয়েই এ আনন্দ হয়ে ওঠে সার্থক। এবার অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদযাপিত হবে বলে আশা করা যায়। দীর্ঘ ছুটির অবকাশে যাত্রাপথের ভোগান্তি, গরমের ক্লান্তি আর কষ্টের পরও আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনুভূতিই আলাদা। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের দুর্ভোগ কমেছে বহুলাংশে। ঈদ বিভেদ-বৈষম্যহীন, ভ্রাতৃচেতনায় ঋদ্ধ এক নির্মল আনন্দ-উৎসব-বিনোদনের উপলক্ষ। এই উৎসবের দিনে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হবে আনন্দ। রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, সেই শিক্ষার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তি ও শ্রেয়বোধের চেতনায় সুস্থিত হতে হবে। ঈদুল ফিতর উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব সকল প্রকার হিংসা, যুদ্ধ, হানাহানিমুক্ত হোক। দূর হোক জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের ভীতি। সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন হোক সুদৃঢ়। সবার ওপর বর্ষিত হোক মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমত ও শান্তিকল্যাণ। আনন্দে ভরে উঠুক জীবনের প্রতিটি দিনÑ এই প্রত্যাশায় ঈদ মোবারক! সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত আনন্দ

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত আনন্দ

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’। গানটির সাথে মিশে আছে চিরাচরিত মধুময় শৈশবের ঈদ উৎসব। পবিত্র মাহে রমজানের শবেকদরের রাত থেকেই শুরু হয়ে যেত ঈদের আমেজ। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে সবার মাঝে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো।কখন ঘোষণা আসবে নতুন চাঁদ দেখা গেছে আর কাল ঈদ। ঘোষণা আসার সাথে সাথেই মহল্লায় হৈচৈ পড়ে যেত।আর তার পরপরই বিটিভিতে বাজতে শুরু করতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটি’। ঈদ শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। সামাজিক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মানুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়, পরস্পরের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে সবার মাঝে উৎসব ও আমেজের ভাব বিরাজ করে। ঈদের আনন্দ প্রতিটা মুসলিম বিশ্বের ঘরে দেখা যায়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় আনন্দঘন পরিবেশ। তবে বর্তমান সময়ে এমন আনন্দঘন পরিবেশ তেমন দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেকাল ও একালের ঈদের মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে সেকাল ও একালের ঈদের আনন্দের মাঝেও। সেকালে ঈদের নামাজ আদায় করে, খাবার খেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, বড়দের থেকে সালামি নেওয়া হতো। বর্তমান সময়ে ঈদের নামাজ আদায় করে আর কাউকে ঘুরতে দেখা যায় না। নানান ব্যস্ততায় এখন আর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। সকলের কাছে রয়েছে স্মার্টফোন যার মাধ্যমে ঘরে বসেই সারা বিশ্বের বড় বড় অনুষ্ঠান দেখে ঈদ উদযাপন করা হয়। ঈদ হলো সেই দিন পালনের নাম, যা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। ঈদ মানে ফিরে আসা। যেহেতু খুশির বার্তা নিয়ে ঈদ ফিরে আসে এবং মানুষ তা পালন করে। তাই তাকে ঈদ বলা হয়। দিনটি আনন্দ উচ্ছ্বাসে কাটিয়ে দেওয়া। যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ-দুর্দশা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এমন আনন্দঘন পরিবেশ দেখা যায় না। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গানটিও এখনকার শিশুরা যেন শুনতে চায় না। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ঈদের আনন্দও পরিবর্তন হয়েছে। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য এখন আর কেউ অধীর আগ্রহে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। এখন রয়েছে প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা চাঁদ দেখার কমিটি। তারাই মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে দেয় ঈদ কবে হবে। বর্তমান সময়ে ঈদ উৎসব দেখার চেয়ে দেখানোর মানুষের সংখ্যা বেশি।কে কত টাকার বাজেট নিয়ে শপিং করতে এসেছে জনপ্রিয় ভাইরাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একপ্রকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কার থেকে বেশি টাকার শপিং করতে পারে। আগেকার সময়ে ঈদের দিনে বাড়িতেই তৈরি করা হতো হরেক রকমের মজাদার খাবার। স্মার্ট ফোন না থাকার কারণে ছিল না কোনো কন্টেন্ট তৈরির প্রচেষ্টা কিংবা খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার ট্রেন্ড। ছিল না অনলাইনে টিকিট কাটার সুযোগ, পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করে থাকতো। আধুনিকতার যুগে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার থাকায় সামাজিক উৎসব হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর হাতের পুতুল।কে কার আগে পোস্ট করবে,কার ছবি দেখতে সুন্দর হয়েছে, পোস্টে লাইক, কমেন্ট আরো কতকিছু!! এখন এসবের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায় সবাই। ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঈদি বা সালামি। নতুন পোশাক পরিধান করে নামাজ আদায় করে বড়দের থেকে সালামি নেওয়া ছিল ঈদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যুগের পরিবর্তন আসলেও এ চিরাচরিত প্রথা এখনও বিরাজমান রয়েছে। তবে, এখন অনলাইনের মাধ্যমে সালামি নেওয়া হয়। মোবাইল ব্যাংকিং যেমন- নগদ, বিকাশের মাধ্যমে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সালামি পৌঁছে যায়। এছাড়াও শিশুরা সিসিমপুর কার্টুন দেখে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতো। বিচিত্রার কয়েকটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকত বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর কার্টুন দিয়ে। তবুও ঈদ আসে, আমরা উদ্যাপন করি। কিন্তু যে ঈদ আমরা শৈশবে পালন করে এসেছি তার স্বাদ ডিজিটাল যুগের সকল সুযোগ সুবিধা পেয়েও পাই না। মায়ের মুখের মতো ভেসে আসে মধুময় শৈশবের কাটানো ঈদ। হয়তো একসময় পুরোপুরি হারিয়ে যাবে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য।।

গাজার কান্না শুনতে কি পাচ্ছে বিশ্ব?

গাজার কান্না শুনতে কি পাচ্ছে বিশ্ব?

গাজার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার যেন শেষ নেই। দীর্ঘ দেড় বছর পর, এক মুহূর্তের জন্য হলেও ধ্বংসস্তূপের মাঝে একটুখানি স্বস্তির ছোঁয়া এসেছিল। যুদ্ধবিরতির চুক্তির আশা নিয়ে তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল। নতুন জামা পরার, ভালো কিছু খাওয়ার আশায় ছিল। ঈদ তো আর বেশি দূরে নয়! মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজানের ধ্বনিতে সেহরির জন্য জেগে উঠত মানুষ, কেউবা ক্ষুধার জ্বালা নিয়েও রোজা রাখত অবিচল বিশ্বাসে। ইফতারে কারও ভাগ্যে জুটত শুকনো রুটি, কেউবা ভাগ্যবান হলে এক টুকরো তরমুজ কিংবা প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা শরবত। এত কষ্টের মাঝেও গাজার শিশুরা হাসছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের নিষ্পাপ মুখের কিছু ছবি, যেখানে ঈদের আনন্দের অপেক্ষা ছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতাও তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস কেড়ে নিতে পারেনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন টিকে থাকতেই পারল না! রাতেও সবাই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কেউ কল্পনাও করেনি যে পরদিন সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আর কজনের হবে। আজানের ধ্বনি শোনার আগেই শুরু হলো বিভীষিকা। ইসরাইলি বাহিনীর নিষ্ঠুর বোমা হামলায় মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো ঘরবাড়ি। নিরীহ মানুষগুলোর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল বাতাসে। মুহূর্তেই কেঁপে উঠল গাজার মাটি, ধুলো আর ধোঁয়ার আস্তরণে ঢাকা পড়ল আশার আলো। চারদিকে শুধু মৃত্যু, ধ্বংস আর আর্তনাদ। কেউ সেহরির জন্য উঠে আরেকজনকে ডাকতে গিয়ে দেখল, সে আর নেই। কারও ছোট্ট শিশু মা-বাবার নিথর দেহ আঁকড়ে ধরে কাঁদছে, কেউবা অর্ধেক শরীর নিয়ে ধুঁকছে মৃত্যুর কোলে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল, ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে পথ হারিয়ে ফেলছিল মানুষ। চারদিকে শুধু স্বজন হারানোর আহাজারি, কান্নার রোল। কেউ কাঁদছে পরিবারের জন্য, কেউ নিঃশব্দে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। গাজার প্রতিটি কোণ যেন এক ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো। অথচ কথা ছিল, ভূমধ্যসাগরের ঢেউ আনন্দে গর্জে উঠবে, জলপাই গাছে ফুটবে নতুন কুঁড়ি, শিশুরা মুক্ত আকাশের নিচে নির্ভয়ে খেলবে। গাজার মানুষ বিভীষিকার দিনগুলো ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হলো না। গাজার এই অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে শুধু নিন্দা ও শোক প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, বরং কার্যকরী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিতে হবে। ধনী মুসলিম দেশগুলোকে খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। গাজার আহত ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠন করতে হবে। গাজায় উন্নতমানের হাসপাতাল নির্মাণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি পুনর্নিমাণে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ সংগ্রহ করা দরকার। শিশুদের শিক্ষা ও মানসিক পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজার পক্ষে শক্তিশালী দাবি তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করতে হবে। ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের জন্য বৈশ্বিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে ইসরাইলের বর্বরতা উন্মোচিত হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে গাজায় সহায়তা পাঠাতে হবে। গাজার জনগণের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া, মুসলিম বিশ্বকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ ভুলে গিয়ে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পায়। শুধু ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট দিয়ে প্রতিবাদ জানানো যথেষ্ট নয়; বরং বিশ্ব নেতাদের চাপে রাখতে হবে, যেন তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। মুসলিম বিশ্ব যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে ইসরাইলকে এই বর্বরতা বন্ধ করতে বাধ্য করা যাবে। শুধু মুসলিম দেশ নয়, যেকোনো বিবেকবান মানুষকে এখন গাজার পাশে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গাজার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে হবে, যাতে বিশ্ববাসী ইসরাইলের আগ্রাসন সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে। গাজার শিশুরা যখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে, যখন তারা বাবা-মায়ের নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে মৃত্যু কী, তখন আমাদের নীরব থাকা উচিত নয়। একদিন হয়তো ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে, আমরা মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। গাজার মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে না, তারা শান্তি চায়, স্বাভাবিক জীবন চায়। যুদ্ধ নয়, শিশুরা মুক্ত আকাশের নিচে হাসতে চায়, খেলতে চায়। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর এখনই সময়। এখন সময় এসেছে শুধু দুঃখ প্রকাশ নয়, বরং বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে গাজাকে রক্ষা করার।

রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি চুক্তির প্রস্তাব

রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি চুক্তির প্রস্তাব

তিন বছর পূর্বে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই  যুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি স্পষ্টভাবে  পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড এখন রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়েছে ইউক্রেন। গত ১১ তারিখ সৌদি আরবের জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সংলাপ শেষে একটি যৌথ বিবৃতিতে সম্মতির বিষয়টি জানানো হয়েছে। বৈঠকটির পর ইউক্রেনকে পুনরায় সামরিক সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্য দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে একটি অন্তর্বর্তী যুদ্ধবিরতি কার্যকর এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলোচনা শুরু করতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ইউক্রেন। বৈঠকে নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, বল এখন রাশিয়ানদের কোর্টে। মস্কোর নিকট যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি নিয়ে যাওয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু তারা যদি এতে রাজি না হয় তাহলে দুর্ভাগ্যবশত সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা বুঝা যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সমুদ্র ও আকাশপথে আংশিক যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার বাইরে গিয়ে আমাদের প্রদত্ত প্রস্তাবটি হলো গোলাগুলি বন্ধ করা। পুতিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। তবে তিনি বেশ কয়েকটি কঠিন শর্তও দিয়েছেন। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছেÑকিয়েভ ন্যাটোর সদস্যপদ না পাওয়ার নিশ্চয়তা, ইউক্রেনে বিদেশী সেনা মোতায়েন নিষিদ্ধ করা এবং রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া ও চারটি অঞ্চলকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ হলো ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ, যা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটকে সমাধান করতে হবে। তবে মার্কিন কর্মকর্তরা আশঙ্কা করছেন, পুতিন এই যুদ্ধবিরতিকে ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। রাশিয়ার এসব দাবি শুধু ইউক্রেনের সঙ্গে নিছক একটি চুক্তি করার জন্য নয়, বরং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চুক্তির ভিত্তি তৈরি করা। শান্তির জন্য সকল শর্ত পূরণ করা আবশ্যক বলে পুতিন মনে করেন। তবে রাশিয়ার শান্তি চুক্তি বা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভাঙার রেকর্ড রয়েছে। তাই এমন কোনো চুক্তি কার্যকরের জন্য শক্তিশালী একটি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।  ট্রাম্পও এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান বলে তিনি উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। আশা করি প্রেসিডেন্ট পুতিনও রাজি হবেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে বলেন, যুদ্ধবিরতি একটি ইতিবাচক প্রস্তাব, যা কেবল আকাশ ও সমুদ্রপথে লড়াই নয়, যুদ্ধের সম্মুখ সারির জন্যও প্রযোজ্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, এটি ইউক্রেনের শান্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমাদের সকলকে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি স্থায়ী ও নিরাপদ শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য দ্বিগুণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধবিরতিতে ইউক্রেনের সম্মত হওয়ার সিদ্ধান্তকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বাগত জানায়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ ইউক্রেনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা বলেন, আসন্ন শান্তি আলোচনায় ইইউ তার অংশীদারদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে পুতিনের প্রতিক্রিয়াকে ছলনা বলে অভিহিত করেছেন জেলেনস্কি। শান্তি চুক্তি জোরদার করার জন্য তিনি রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান। এর আগে পুতিন বলেছিলেন, যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তিনি রাজি আছেন। কিন্তু একটি যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংকটের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর অবসান ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা উচিত বলে পুতিন মন্তব্য করেন। ট্রাম্প অবশ্য পুতিনের বক্তব্যকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিন্তু অসম্পূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার গ্রুশকো বলেছেন, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় ইউক্রেনকে সদস্য করা হবে না এবং যে কোনো শান্তি আলোচনায় কিয়েভ নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকবেÑমস্কো এমন নিশ্চয়তা চায়। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই লৌহদৃঢ় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এই চুক্তির অংশ হোক। পুতিন বলেছেন, তিনি যুদ্ধবিরতির পক্ষে। তবে শান্তির জন্য বেশ কয়েকটি কঠিন শর্ত যুক্ত করতে চায় রাশিয়া। যার মধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার দাবি রয়েছে। যদিও কিয়েভ ও তার মিত্ররা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে রাশিয়ার দাবি মেনে যুক্তরাষ্ট্র অস্থায়ীভাবে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করলেও স্থায়ী সীমাবদ্ধতা আরোপ করেনি। ট্রাম্প কিন্তু কূটনৈতিক সাফল্যের লক্ষ্যে ইউক্রেনের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারেন। পুতিন আলোচনায় দেরি করিয়ে ট্রাম্পের নিকট থেকে আরও সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অভিযোগ, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পুতিন ধ্বংস করতে চাইছেন। রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব ভূমি দখল করেছে, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সেই বিষয়টি কিভাবে সামাল দেওয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাব ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এড়িয়ে গেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালনা করছেন তার সমালোচনা করে ইউক্রেনের সাবেক সেনাপ্রধান এবং বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত জালুঝনি মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্র পুরো পশ্চিমা বিশ^ব্যবস্থার ঐক্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার হামলার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু ইউরোপ হতে পারে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রেমলিনের দিকে ঝুঁকছে এবং তাদের ছাড় দিতে চাইছে। তিনি আরও বলেন, আমরা যা দেখছি তা কেবল অশুভ অদক্ষ এবং রাশিয়াই বিশ^ব্যবস্থাকে বদলে দিতে চেষ্টা করছে তা নয়, বরং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রও এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে যুদ্ধে ইউক্রেন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। জেলেনস্কি ইউক্রেন যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে চাইছেন। কিন্তু শান্তি আলোচনা এবং মস্কোকে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চাইছে তা নিয়ে কিয়েভ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের শঙ্কা হচ্ছে, ইউক্রেনের জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়াই মস্কোর সঙ্গে শান্তি চুক্তি সই এবং মস্কোকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড় দিতে চাইছে। পুতিন মনে করেন, সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পাবেন। তাই পুতিন দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কোনো ধরনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার তার আগ্রহ নেই। শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হলে সেটি হতে হবে স্থায়ী সমাধান। শান্তি চুক্তির বিষয়ে পুতিনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যেন একটি শান্তি চুক্তি করা যায়। যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তি চুক্তির জন্য আমরা কাজ করছি। পুতিন শান্তি চুক্তিতে যে আগ্রহী ফান্স ও যুক্তরাজ্য সে বিষয়ে তাকে প্রমাণ দেওয়ার আহ্বান জানায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় সাহসিকতার প্রশংসা করেন। যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য তিনি পুতিনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি চুক্তির বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ট্রাম্প। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, পুতিনকে এখন পূর্ণাঙ্গ ও শর্তহীন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে। তবে শান্তি চুক্তির বিষয়ে পুতিনের মধ্যে কোনো আন্তরিকতার লক্ষণ দেখছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির এ পরিকল্পনা ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন এটি পুতিনের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মনে করেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। রাশিয়ার পদক্ষেপ এখনো স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না বলে কূটনীতিকরা মনে করেন। বিশেষ করে জেদ্দায় বৈঠকের পর ক্রেমলিন অবশ্য বেশ কৌশলী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না বলেই রাশিয়া এমন কৌশলী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি এস পেশকভ বলেছেন, জেদ্দার আলোচনায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মস্কো পর্যবেক্ষণ করেছে। ট্রাম্প-পুতিনের প্রথমবার টেলিফোন আলাপে রাশিয়ার ইতোমধ্যে দখল করা ইউক্রেনের ভূমি নিয়ে ফয়সালা, কোনোভাবেই ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান করতে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং পূর্ব-মধ্য ইউরোপে ন্যাটোর হম্বিতম্বি কমিয়ে আনার ব্যাপারে জোরালো দাবি তুলেছিলেন পুতিন। ট্রাম্প আভাস দিয়েছেন, এই চুক্তিতে ইউক্রেনকে ছাড় দিতে হবে। এতদিন ইউক্রেন ছাড় দিতে রাজি না থাকলেও দেশটি অনেকটা বাধ্য হয়েই আপোসে রাজি হয়েছে। খালি চোখে এই চুক্তিতে কারও বিজয় হয়নি মনে হলেও রাশিয়া কৌশলগত বিজয় নিশ্চিত করেই চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মতি দেবে। ইউক্রেনের সঙ্গে ট্রাম্প একটি অর্থনৈতিক চুক্তিও করতে চাচ্ছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নিরাপত্তার বিষয়টি থাকে। যদিও ইউক্রেন তাদের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক আলোচনায় ২০২২ সালে ইস্তানবুলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচিত একটি খসড়া চুক্তিকে শান্তি আলোচনার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করার প্রসঙ্গটিও এসেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি কার্যকর হয়নি। উক্ত আলোচনায় ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পরিত্যাগ ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের স্থায়ী প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল। একই সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে অন্য দেশগুলোর হস্তক্ষেপের ওপরও নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলা হয়েছিল। স্টিভ উইটকফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ইস্তানবুলের আলোচনাগুলো সংগঠিত ও ফলপ্রসূ ছিল এবং এটি শান্তি চুক্তির জন্য একটি দিকনির্দেশনা হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের ব্যাপক যুদ্ধের মধ্যেও আলোচিত যুদ্ধবিরতি আগামী সপ্তাহগুলোর মধ্যেই চূড়ান্ত করা সম্ভব বলে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করে। যদিও উভয় রাষ্ট্রই এখনো আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। জেলেনস্কি জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে রুশ বাহিনী ১,৫৮০টিরও বেশি নিয়ন্ত্রিত বোমা, প্রায় ১,১০০টি আক্রমণাত্মক ড্রোন এবং ১৫টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের নতুন সমাধান দরকার। মস্কোর ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা এসব হামলা ও যুদ্ধ বন্ধ করে। আলোচনার আগে শান্তি চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া যে আগ্রহী নয় তার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ট্রাম্প বলেন, আমরা খুব শীঘ্রই পূর্ণ যুদ্ধবিরতি পাব। তিনি দাবি করেন, পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে জ¦ালানি স্থাপনায় হামলা সীমিত করার বিষয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে। ক্রেমলিন বলছে, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে তখনই বৈঠক হবে, যখন একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তি হবে। শান্তি চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া কিন্তু খুব একটা তাড়াহুড়া করছে না। কারণ যুদ্ধে দেশটি কিন্তু ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করলে চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক টিকে রাখা কঠিন হতে পারে। রাশিয়া গত দুই দশক ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নিকট দাবি জানিয়ে আসছে যে, পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি সীমিত করতে হবে এবং ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বর্তমানে যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর উভয় রাষ্ট্র মিলেমিশে কাজ করবে। এ প্রসঙ্গে উইটকফ বলেন, এমন একটি বিশ^ কে না চায়, যেখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে মিলে ভালো ভালো কাজ করবে, আর্কটিকে নিজেদের জ¦ালানিনীতিতে কিভাবে সমন্বয় আনা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করবে, সম্ভব হলে জলপথ ভাগাভাগি করবে, একই সঙ্গে ইউরোপে এলএনজি গ্যাস পাঠাবে, আর হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়েও সহযোগিতা করবে। ট্রাম্প-পুতিনের মধ্যকার সম্পর্কের বর্তমান উষ্ণতায় বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির যে আলোচনা চলছে তা রাশিয়া মেনে নিতেই পারে। তবে ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন কি না, সে বিষয়ে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করছেন। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের চেষ্টা করলে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার কারণে তা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনে নতুন করে যুদ্ধবিরতি হলে তা পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কেউ দায়িত্ব পেতে পারে। অবশ্য সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে রাশিয়ার সম্মতি থাকতে হবে। রাশিয়া যত বেশি সুবিধা আদায় করতে পারে ততই লাভবান হবে। তবে তারা শান্তি আলোচনা একেবারে বানচালও করতে চায় না। খুব সম্ভবত ধাপে ধাপে ছোট ছোট চুক্তি হতে পারে, যা একটি বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট মনে করেন, রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না। তাদের দাবি রয়ে গেছে আগের মতোই। তারা সত্যিই কোনো অর্থবহ যুদ্ধবিরতি বা শান্তি চায় কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর শান্তি চুক্তি তখনই সম্ভব হবে যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষ হামলা চালিয়ে বা উসকানি দিয়ে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘনের চেষ্টা না করে। শান্তিতে পৌঁছানোর আগে অনেক বাধা আসবে। তবে সেই বাধা সামাল দিতে হবে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

দেশসেবায় সেনাবাহিনীর বহুমুখী অবদান

দেশসেবায় সেনাবাহিনীর বহুমুখী অবদান

জাতীয় কবি নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধের উপস্থাপনা। ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’- কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যের কাছে মাথা নত না করার অবিস্মরণীয় স্মারক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশমাতৃকার প্রতি ইঞ্চি ভূমির সুরক্ষায় নিরলস ব্রতে সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর। আকাশ-জল-স্থল নিষ্কণ্টক এবং নিরাপদ রাখার গভীর সংকল্পে তারা ঋদ্ধ। আধুনিক প্রশিক্ষণে সদাজাগ্রত সেনাবাহিনী তথ্যপ্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। শুধু দেশকে শত্রুমুক্ত নয়; অভ্যন্তরীণ যেকোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটে তাদের বিচরণ অনবদ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনে দেশকে শত্রুমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ বিজয় অর্জনে অকুতোভয় সৈনিকের পরিচয়ে সেনবাহিনী বিশ্বনন্দিত। সকল স্তরে ঐকমত্যের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনে সেনাবাহিনীর নান্দনিক সৌরভ উন্মোচিত। বাংলাদেশের সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর সকল সদস্যের যোগ্যতা-দক্ষতা ও দেশপ্রেম প্রকৃতই পরীক্ষিত। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অবিচল প্রতীক হিসেবে তারা সর্বত্রই সমাদৃত। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজা-মহারাজাদের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বাংলার সামরিক ইতিহাসের মূল। সেই সময়কালে সেনাবাহিনী গঠিত হতো পদাতিক, অশ্বারোহী, যুদ্ধ হাতি এবং যুদ্ধজাহাজ নিয়ে। বাংলায় মুসলমানদের আগমন এবং সালতানাত এর প্রতিষ্ঠা বাংলার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছিল। মুঘল শাসনামলে বাংলায় কামান ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচলন হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাংলা ছিল দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ব্রিটিশদের শক্তির সৌরভ। ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নেতৃত্বাধীন ৫০ হাজার সৈন্যের বাংলার সেনাবাহিনীকে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত করে। পরবর্তীতে একই ব্রিটিশ বাহিনী ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের নেতৃত্বাধীন বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা বাংলায় আর্মি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করে যা ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয়ে যায়। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। এই সৈন্যদের করাচিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাগদাদে মোতায়েন করা হতো। যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা বাগদাদে ১৯১৯ সালের কুর্দি বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ‘ইস্টার্ন কমান্ড পাইওনিয়ার কোর’ নামক একটি সহায়ক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে যারা ছিল কিছুটা প্রকৌশলী এবং কিছুটা পদাতিক। বাহিনীটির বেশিরভাগ সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা থেকে। এই বাহিনী মূলত রাস্তাঘাট ও বিমানঘাঁটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে মূল বাহিনীকে সাহায্য করত। প্রয়োজনে তারা পদাতিক বাহিনী হিসেবেও যুদ্ধ করত। এটিকে বিভিন্ন কোম্পানিতে ভাগ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নানা রেজিমেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন গনি ছিলেন একজন কোম্পানি কমান্ডার এবং তিনি বার্মা ফ্রন্টে তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পূর্ব বাংলার যুদ্ধফেরত পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের নিয়ে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট তৈরির ধারণা দেন এবং কেন্দ্রীয় কমান্ডের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাংক মেজারভি’র অনুমতি সাপেক্ষে ক্যাপ্টেন গনি পূর্ববাংলার সৈন্যদের নিয়ে বাঙালি পল্টন গঠন করেন। যা ছিল পরবর্তীতে গঠিত পদাতিক রেজিমেন্টের মূল ভিত্তি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ভঙ্গুর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক-সামরিক-আঞ্চলিক বৈষম্যের চরিত্র ধারণকারী শাসকগোষ্ঠীর নব্য আন্তঃঔপনিবেশিক যাঁতাকলে বাঙালি জাতিকে চরম নিষ্পেষণে নিপতিত করেছিল। পাকিস্তানের শাসন- শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতন-বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘসময় ধরে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মধ্য দিয়ে বেসামরিক বাঙালি জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। তারা হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী স্ফুলিঙ্গে রূপান্তর ঘটে। ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মার্চ মাসেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সৈন্যরাও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ মিলে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। ১৭ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্ণেল (অবঃ) মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক সদস্যদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় এবং ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তা ও সৈনিকদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালের মধ্যেই সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার্স, সিগন্যাল, সার্ভিস, অর্ডিন্যান্স, মিলিটারি পুলিশ, অশ্ব গবাদি পশুপালন-খামার ও মেডিকেল কোর গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম শর্ট কোর্সের পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি। ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর)। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অভ্যুত্থান-ঘাত-প্রতিঘাতের দোলাচলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমান অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সংযোজন, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন এবং কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুসংগঠিত ও শাক্তিশালী বাহিনী হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়েই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি অপরিহার্য বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ সূচিত হওয়ার পর থেকেই এক অসাধারণ অধ্যায় রচনা করেছে। দেশের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের অন্তর্ভুক্তি এবং কার্যকলাপ দেশের ভাবমূর্তিকে শান্তি মিশনের শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত করেছে। ৬ মার্চ ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৩০ জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা অনবদ্য হওয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী সদস্যরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলসমূহকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় কর্মযজ্ঞ পালনসহ কঙ্গো, মালি, সুদান, সাউথ সুদান, সাহারা, লেবানন, হাইতি, পূর্ব তিমুরে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। প্রায় তিন যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সকল প্রান্তের দুর্গত-নিপীড়িত-নিরীহ মানুষের সেবায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মানবিক হস্ত সর্বদা প্রসারিত। ১৯৯৩-৯৪ সালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রুয়ান্ডা, সোমালিয়া ও বসনিয়া- এ তিনটি শান্তি মিশনে নিজেদের সক্ষমতা-দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ঐ সময় জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের কর্মকর্তাদের হতবাক করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতা ও সামরিক জ্ঞানে উক্ত দেশসমূহে মিশনে দায়িত্ব পালনরত বেলজিয়ান, আমেরিকান ও ফ্রান্স সেনাবাহিনীকে ছাপিয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা বিদেশের মাটিতে শত্রুদের সামনে মাথা নত না করে, কঠিন বিপদ-সংকটময় মুহূর্তে জীবনঝুঁকির মধ্যেও জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আইভরি কোস্টের গোলযোগপূর্ণ অবস্থাকালীন সময়ে লাইবেরিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশী কন্টিনজেন্টগুলো প্রত্যক্ষভাবে শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ লাইবেরিয়ার সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল সহায়তায় বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড স্থানীয় জনগণ ও সর্বমহলে উচ্চকিত। স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই, জুলাই ২৪ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। অত্যন্ত জটিল এই সংকটকালে জনগণ ও দেশের প্রতি সেনাবাহিনীর দায়বদ্ধতা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দৃঢ়চেতা মনোভাবে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রবল বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসামান্য নিরপেক্ষতা ও দেশেপ্রেমের পরিচয় দিতে সম্পূর্ণ সফল। দেশকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে বিরত রেখে শান্তিশৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সুরক্ষায় অসীম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সমগ্র দেশবাসীর হৃদয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও সমর্থন অকাট্য যুক্তিতে নির্ভার। কোনো অবস্থাতেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য জনগণের আস্থাকে শিথিল করতে পারবে না। দেশী-বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্র-গুজবসন্ত্রাস সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো অপচেষ্টাই সার্থক হতে পারে না। লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অকৃত্রিম প্রতীক দেশপ্রেমে ঋদ্ধ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরব-সৌরভ অপরাজিত থাকুক- মহান স্রষ্টার দরবারে এটুকুই প্রার্থনা। লেখক :   শিক্ষাবিদ

গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে

গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুন্দরবন অন্যতম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এলাকা সুন্দরবনের পরিবেশের পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ত জলভাগ বাড়ার সঙ্গে কমছে স্থলভাগ। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে সবুজ। সুন্দরবনে বহু দিন ধরেই চলছে অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন। যেমনÑ ধুধুল, পশুর, গরান, হেঁতাল, শাল, সেগুন। নিয়মিতভাবে এসব গাছ কাটার ফলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য আজ বিপন্ন। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো এটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে। সুন্দরবনের আমূল বনসম্পদ পরির্বতনের কারণে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে আছড়ে পড়ছে একের পর এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। আবহাওয়ার পরিবর্তন জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে। বন আইন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কাঠ পাচারকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠলেও বন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা বনবিভাগ রহস্যজনক কারণে কাঠ পাচার রোধে রয়েছে উদাসীন। এতে করে সরকার বঞ্চিত হয় রাজস্ব থেকে, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। গাছ কাটা বাড়ার ফলে বনের প্রাণিকুল বিপন্ন হয়ে পড়ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতল হরিণসহ অনেক বিরল প্রাণীর জীবন আজ হুমকির মুখে। অযাচিত গাছ কাটা বন্ধ করতে সরকার ও সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ, বনরক্ষীদের কার্যকরী ভূমিকা এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। পর্যটন শিল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে গাছ কাটা রোধ করা সম্ভব। বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ, সুন্দরবনে অযাচিত গাছ কাটা বন্ধ করতে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও জনসচেতনতাসহ যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

রমজানেও গাজায় মৃত্যুর মিছিল

রমজানেও গাজায় মৃত্যুর মিছিল

রমজান পবিত্রতা, সংযম ও শান্তির মাস। কিন্তু ২০২৫ সালের রমজানেও গাজায় সেই শান্তির ছিটেফোঁটাও নেই। যুদ্ধবিরতির ঘোষণার মাঝেও মৃত্যুর মিছিল থামছে না। প্রতিবারের মতো এবারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাস্তবে, গাজার রাস্তাগুলো রক্তে ভিজছে, শিশুরা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ছে হাজারো স্বপ্ন।  আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপের মুখে সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে গাজার আকাশে এখনো ড্রোনের গুঞ্জন, বোমার বিস্ফোরণ, আর্তচিৎকার থামেনি। সংঘাত বন্ধের নামে যেসব চুক্তি করা হয়, সেগুলো বারবারই ভেস্তে যাচ্ছে। ইসরাইলি বাহিনীর দখলদার নীতি অব্যাহত থাকায় যুদ্ধবিরতির অর্থ হয়ে উঠেছে আরও টার্গেটেড হামলা, আরও নিরীহ মানুষের মৃত্যু। একদিকে মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে ইসরাইলি বাহিনীর টার্গেটেড হামলায় প্রতিদিনই বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। মাত্র কয়েক সপ্তাহের স্বস্তি ভেঙে নতুন করে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে ফিলিস্তিনিদের জীবনে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে চলছিল রমজানের ইবাদত। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ভেস্তে দিয়ে সেহরির সময় ইসরায়েলি বাহিনীর নজিরবিহীন এই হামলায় নিহত হয়েছে কয়েকশ’ মানুষ, তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিমান হামলার পাশাপাশি শুরু হয়েছে স্থল অভিযান। উত্তর ও দক্ষিণ গাজা খালি করতে লিফলেট ফেলছে ইসরাইল। প্রাণভয়ে হাজারো ফিলিস্তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে ইসরাইল ও হামাস। তবে গাজার মানুষ আবারও মৃত্যু আর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। ইসরাইল গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর হামলার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করছে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুললেও বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা যেন এই ধ্বংসযজ্ঞকে আরও দীর্ঘায়িত করছে। গাজায় যা ঘটছে, তা কেবল একটি ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, এটি এক পরিকল্পিত গণহত্যা। এই সংকট নিরসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, গাজার ওপর থেকে সমস্ত অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যথাযথ বিচার করতে হবে। তৃতীয়ত, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতিসংঘকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘ, ওআইসি এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে মধ্যস্থতাকারী হয়ে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর উচিত কেবল নিন্দা জানানোর পরিবর্তে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। ফিলিস্তিন সংকট শুধু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি মানবতার চরম পরীক্ষা। নিরপরাধ শিশুদের রক্তে রঙিন হচ্ছে রমজানের রাত, অথচ বিশ্ব এখনো নীরব। যখন পুরো বিশ্ব নীরব থাকে, তখন অবিচারের শিকার মানুষের আর্তনাদ ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকে। আজ সময় এসেছে ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর। নিরপরাধ শিশুদের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। গাজার মানুষের কান্না বিশ্ব মানবতার পরীক্ষা নিচ্ছে। আমরা কি নীরব দর্শক ছিলাম, নাকি মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম?Ñ ইতিহাস একদিন এই প্রশ্নের উত্তর চাইবে। শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবতার স্বার্থে অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক। অবরোধ ভাঙুক, ফিলিস্তিনের মুক্তি আসুক। মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সেমাই ক্রয়ে সতর্ক হোন

সেমাই ক্রয়ে সতর্ক হোন

মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে আনন্দের সময় বছরের দুটি ঈদের দিন। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরে আসে সেই মহা আনন্দের একটি দিন ঈদুল ফিতর। সেই অপেক্ষায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী। ঈদের দিনকে ঘিরে চলে নানা রকম আয়োজন- পিঠা, পায়েস, পোলাও আরও কত রকমের মুখরোচক খাবার। এর মাঝে অন্য রকম পছন্দের তালিকায় রয়েছে সেমাই। সেমাই ছাড়া যেন ঈদ টাই জমে ওঠে না। তবে সেমাই নিয়ে রয়েছে কত রকমের দুশ্চিন্তা। কতিপয় অসাধু মুনাফালোভী কুচক্রী ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় কৃত্রিম রং মিশ্রিত ও নিম্ন মানের ময়দা এবং রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত সেমাই ভোক্তাদের কম দামের লোভ দেখিয়ে বিক্রি করে থাকে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বাজারে এত এত সেমাইয়ের ভিড়ে ভেজাল সেমাই চিহ্নিত করা বেশ কষ্টসাধ্য। তবে কয়েকটি দিকে লক্ষ্য রাখলে নিরাপদ ও ভালো সেমাই চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন- সেমাই ক্রয় করার সময় সেমাইয়ের রং দেখে নিন। অতিরিক্ত উজ্জ্বল রং অস্বাভাবিক সাদা রং থাকলে সন্দেহ সৃষ্টি করে। সেমাইয়ের গন্ধ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে যদি দুর্গন্ধ থাকে বা কেমিক্যালের ঘ্রাণ পাওয়া যায় তবে সেমাই ক্রয় করা থেকে বিরত থাকুন। সেমাই হাতে নিয়ে ভেঙে দেখুন, ভালো সেমাই সহজে ভেঙে যায়। কিন্তু খারাপ সেমাই হাতে শক্ত লাগে। ভাঙতে চায় না। তা ছাড়া মুখে নিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে দেখতে পারেন। ভেজাল সেমাই বিষাদ তেঁতো লাগে। তাছাড়া বিশ্বস্ত দোকান থেকে সেমাই ক্রয় করতে পারেন। তবে ব্রান্ডেড বা BSTI অনুমোদিত পণ্য ক্রয় করুন। ক্রয়ের সময় মোড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেখে কিনুন। সবচেয়ে ভালো হয় বাসায় তৈরি সেমাই। পরিশেষে, ভেজাল খাদ্য এড়িয়ে সঠিক পণ্য ক্রয় করি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে নিরাপদ ও সুস্থ সুন্দর আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদযাপন এটাই হোক প্রত্যাশা।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন

ফিটনেসবিহীন যানবাহন

বাংলাদেশে ঈদ মানেই ঘরমুখো মানুষের ঢল, ব্যস্ত সড়ক, আর ভয়াবহ যানজট। এ উচ্ছ্বাসের মাঝেই এক ভয়ংকর চিত্র বারবার দেখা যায়। তা হলো ফিটনেসবিহীন, পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের দাপট। বছরের পর বছর গ্যারেজে পরে থাকা কিংবা সচল থাকার ন্যূনতম মানদণ্ড হারানো এসব বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, এমনকি নসিমন-করিমন পর্যন্ত রঙের প্রলেপ লাগিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় সড়কে। এসব যানবাহন শুধু দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায় না, বরং যাত্রীদের জীবনের জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। এর পরিণতি হয় ভয়াবহ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা কিংবা সড়কে দীর্ঘ যানজটে। তাই এখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যথায়, এ ধরনের উদাসীনতা ও সড়কে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে শুধু দুর্ঘটনা বাড়াবে না, বরং ঈদ আনন্দকে শোকে পরিণত করবে। তাই সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ঈদে নিরাপত্তা জরুরী

ঈদে নিরাপত্তা জরুরী

অনেকে দৈনন্দিন প্রয়োজনে, আবার কেউ  শখ পূরণের জন্য বাইক ক্রয় করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাইক ব্যবহারকারীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাইক চুরি। প্রায়শই দেখা যায়, কেউ নির্দিষ্ট স্থানে বাইক পার্কিং করে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, তার প্রিয় বাহনটি আর নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই চোরেরা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বাইক নিয়ে উধাও হয়ে যায়, যা মালিকের জন্য চরম হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বাইক চুরির ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং চোর শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, বাইক নির্মাতা কোম্পানিগুলোরও উন্নত প্রযুক্তির লকিং সিস্টেম চালু করা উচিত, যাতে বাইক চুরি করা কঠিন হয়ে ওঠে। বাইকের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে জিপিএস ট্রাকিং প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। বাইকে জিপিএস লাগানোর মাধ্যমে মালিকরা যেকোনো সময় তাদের বাইকের অবস্থান শনাক্ত করতে পারবেন। চুরি হয়ে গেলেও সহজেই বাইকের সঠিক লোকেশন বের করা সম্ভব হবে, যা বাইক উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বাইক প্রস্তুতকারকদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে চলবে না। বরং আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। বাইক পার্কিংয়ের সময় নির্দিষ্ট ও নিরাপদ স্থানে লক করা, সিসিটিভির আওতাভুক্ত স্থানে রাখার মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বাইকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই একমাত্র সমাধান। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, জিপিএস ট্র্যাকিং এবং ব্যক্তিগত সচেতনতা—এই চারটি দিক একসঙ্গে কাজ করলেই বাইক চুরির প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে। আবু হুসাইন   ঢাকা