ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মতামত

পুকুর দীঘি ও অন্যান্য জলাশয় রক্ষা করা প্রয়োজন

পুকুর দীঘি ও অন্যান্য জলাশয় রক্ষা করা প্রয়োজন

চট্টগ্রাম মহানগরীতে যে হারে লোক বাড়ছে সে হারে কিন্তু আর কিছুই বাড়ছে না, বরঞ্চ আনুপাতিক হারে কমছে। আগামীতে এ নগরীর দৃশ্যপট আরও চমৎকৃত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে আমাদের জন্য তেমন কোনো সুখবর নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত নানা দান। বহুকাল পূর্বে কেউ বাড়ি করার পরিকল্পনা করলে পুকুর খনন অবধারিত ছিল। সমতল বা জলাশয় জায়গা থেকে মাটি তুলে মাটির ঘর তৈরি করত। একটা মাটির ঘর তৈরি করা মানে সৌখিন একটা কাজ করার মতো। যেখান থেকে মাটি তুলল সেটা হয়ে গেল পুকুর। জমিদারি প্রথার সময়ে এ ধরনের মানসিকতা আঁচ মিলে বেশি।  গ্রাম-শহর সর্বত্র পুকুর একটা সাধারণ জিনিস। দুইশত বছর পূর্বে এই মহানগরীতে কম করে হলেও একশ’র অধিক পুকুর ছিল। লোক বৃদ্ধির কারণে পুকুর ভরাট কার্যক্রম ধীরগতিতে চলমান। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। প্রয়োজন হলো পুকুর ভরাট করে বাড়ি তৈরি করে ফেললাম। দেখা-দেখিতে আমরা ধ্বংসের কৌশল আয়ত্ত করছি। বর্তমানে মহানগরীতে হাতেগোনা কয়েকটি পুকুর আছে।  দিন দিন সর্বত্র পানির সংকট বাড়ছে। আগের মতো বর্ষাকালও অনুপস্থিত। বৃষ্টির পানিতে পুকুর, দীঘি, নালা, খাল-বিল, সাগর, মহাসাগরের যৌবনের দীপ্তিময় শিখা সমুজ্জ্বল থাকলেও বর্তমানে সেই দৃশ্য বহমান নেই। একমাত্র কারণ পরিবেশ বিরুদ্ধ আচরণ। মানুষ নিজের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। সবুজ বনানী ধ্বংস, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা, পুকুর, দীঘি, জলাশয় ভরাট করার কারণেই পরিবেশ মুমূর্ষু। যার কারণে প্রকৃতির রূপও গেছে পাল্টে। বৃষ্টি শুরু হলে থামতে চায় না, এক এলাকায় বৃষ্টি হলে অন্য এলাকায় রোদ।  সাগরে মিটাপানি কমে যাওয়ায় নুনা পানিতে সাগর সয়লাব হচ্ছে। লবণাক্ত পানি পান করা যাচ্ছে না। সামর্থ্যে যারা পারছে তারা বিশুদ্ধ পানি কিনে পান করছে। শুধু পুকুরের কথা চিন্তা করলে হবে না, জলাশয়, ডোবা, দীঘি- এগুলো রক্ষায়ও আমাদের ভাবতে হবে। তবে আমাদের জন্য সুখবর হলো পুকুর, দীঘি রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তৎপর রয়েছে। নানা প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জানা যায়, ইতোমধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  সাধারণ জনগণের ধারণা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর, দীঘি ভরাটের বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। অনেক পুকুর দীঘির মালিকরাও এ বিষয়ে যে আইন আছে তা জানত না। এখন যেহেতু আইন বিষয়ে সকলে জ্ঞাত সেহেতু সাধারণ জনগণ চায় আইন যেন সকলের জন্য সমান কার্যকর হোক। শুধু শহর কেন্দ্রিক নয়, দেশের গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকেও দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। পুকুর, জলাশয়, ডোবা, ঢেবা ভরাট পল্লীতেও সমানতালে চলছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে, তা হলো গরিব লোকের পুকুর ছাড়া আর কিছু নেই।  সংসারের প্রয়োজনে পুকুর ভরাট করে ঘর তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সাহায্য সহযোগিতা করা যেতে পারে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত হবে গ্রাম অঞ্চলের পুকুর দীঘি রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আইনের সুনির্দিষ্ট ধারা অবগত করিয়ে তাদের দায়িত্ব দেওয়া। এভাবে হয়তো বা সকলে সচেতন হবে। কেউ সহজে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজে যেতে চাইবে না। পুকুর, দীঘি, ঢেবায় অনেকে মাছ চাষ করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ চালাচ্ছে। পুকুর দীঘি পাড়ে নানা ধরনের সবজি উৎপাদন নতুন কোনো খবর নয়। বর্তমানে সবজির মূল্য সীমাহীন বৃদ্ধি। পুকুর দীঘি পাড়ে সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানো তেমন কোনে আহামরি ব্যাপার নয়। কিন্তু আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি না।  পল্লীর অধিকাংশ এলাকায় পানির তীব্র সংকট। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো মহল্লা বা পাড়ায় একটা পুকুর থাকে তাহলে পানির চাহিদা মেটানো সহজ হয়। একটা পুকুর মানে পানির ট্যাংক। যেই পুকুর দীঘি জলাশয় আমাদের অহোরাত্র সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো রক্ষা করা না গেলে আমরাই হব চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা অনেকে ভুলে গেছি সেই ঢাকার কারওয়ান বাজারের বিএসইসি দশতলা ভবনের অগ্নিকা-ের কথা। সে ঘটনায় বেশ কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি তিনজনের প্রাণহানি, শতাধিক আহত এবং অনেকে হয়ে গেছে পঙ্গু। এটাতে দমকল বাহিনী পর্যাপ্ত পানি ছিটাতে পারেনি নানা প্রতিবন্ধকতা ও কাছে পানি যোগান না পাওয়ায়। যদি আশপাশে কোনো পুকুর দীঘি থাকত তাহলে জীবনহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো।  বিপদের কোনো হাত-পা নেই। আমরা কোন সময় কি ধরনের বিপদের সম্মুখীন হব কেউ জানি না। তাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থ হলে বংশপরম্পরায় আমরা নানাবিধ ভোগান্তিতে থাকব। একটা সুবিধা পাওয়ার জন্য হাজারো সুবিধাকে বিতাড়িত করে দিচ্ছি আমরা জেনেশুনে। পুকুর দীঘি জলাশয় ডোবা ঢেবার উপকারিতা লিখে শেষ করা যাবে না। এ ধরনের সুবিধা পাওয়া জিনিসকে আমরা নানা অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি না, ঐতিহ্যের একটা অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষা করা গেলে পরিবেশ বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচলে আমরা নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারব। তাই পুকুর দীঘি জলাশয় ডোবা ঢেবা ভরাটের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।  দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুকুর দীঘি জলাশয় নীরবে কিন্তু ভরাট চলছে। আমরা তেমন গরজ মনে করছি বলে ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থাপনাসহ পুকুর দীঘির সংখ্যা ধীরগতিতে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকরী ভূমিকা অপরিহার্য। মানুষ আইনকে শ্রদ্ধা করে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে নিজের সুবিধার জন্যে পুকুর দীঘি মালিকরা প্রকৃতির ক্ষতির পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনগণ অশনিসংকেতের কবলে পড়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে সচেতন করার জন্য অধিকতরভাবে প্রচার চালানোসহ কর্মকৌশল নির্ধারণ করা গেলে ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা কামিয়াব হব, নয়তো আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হব।  লেখক : সাংবাদিক

মতামত বিভাগের সব খবর

প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূলধারায় ফিরে আসুক

প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূলধারায় ফিরে আসুক

মানুষের জন্ম দৈবের অধীন। আমাদের অনেকেই জন্ম থেকেই দুরারোধ্য ব্যাধি, দুর্ঘটনা বা যুদ্ধ কবলিত হয়ে প্রতিবন্ধী।  কারো বা বয়োবুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বোধশক্তির দীনতা ধরা পড়ে। দৈহিক বা মানসিক দিক দিয়ে যার জীবনে স্বাভাবিক বিকাশের অপূর্ণতা, প্রতিবন্ধকতা বা বাঁধা সেই প্রতিবন্ধী। সমাজে মূক, বধির, বিকলাঙ্গ, জড়বুদ্ধি এরা সবাই প্রতিবন্ধী। এদের জীবনে পদে পদে সমস্যা। এরা পৃথিবীর রং রূপ রসের বিলাশ বৈচিত্র্য অনেক কিছু উপভোগ করতে অক্ষম। তারা সুস্থ মানুষের মতো জীবনযাপনে অক্ষম। দিকে দিকে যে বিচিত্র কর্মধারা নিত্য প্রভাবিত, সেখানেও যোগ দিতে অপারগ।

মানবতার প্রতি এক অঙ্গীকার

মানবতার প্রতি এক অঙ্গীকার

আজ ফিলিস্তিন দিবস, যা প্রতি বছর ২৯ নভেম্বর পালিত হয়। এটি একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। কেবল একটি ভ‚খÐের স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, এটি ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক সংহতির প্রতীক। জাতিসংঘ ১৯৭৭ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, মূলত ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন জ্ঞাপন এবং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ফিলিস্তিনিদের জন্য তাদের ভ‚মি কেবল আবাস নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রতীক। তবে ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের প্রস্তাবিত বিভাজন পরিকল্পনার মাধ্যমে অঞ্চলটি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনে বিভক্ত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকাংশ ভ‚মি হারায় এবং উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।

পদ্মার ভাঙন যেন অভিশাপ

পদ্মার ভাঙন যেন অভিশাপ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত হলেও মুন্সিগঞ্জে পদ্মার পাড়ের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে এই নদী যেনো তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ । রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী জেলা ও অত্যন্ত অবহেলিত জনপদ মুন্সিগঞ্জে বছরের পর বছর নদী ভাঙন অঞ্চলের একটি চিরাচরিত ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিবছর পদ্মার ভাঙ্গনে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার হাজার হাজার পরিবার তাদের ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। পদ্মার ভাঙনে লৌহজং উপজেলার ৩৫ শতাংশ, টঙ্গিবাড়ির ১৫ শতাংশ এবং সদরের বেশ কিছু অংশ হারিয়ে মানচিত্র ছোট হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের। ভাঙনকবলিত এসব এলাকার মানুষ সবকিছু হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন এবং ভাসমান মানুষের মতো মানবেতর জীবন যাপন করেন। সাধারণত প্রতিবছর অবৈধ, অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, অতি বৃষ্টি ও উজান হতে নেমে আসা প্রচÐ গতির পানির ঢল, পদ্মার প্রবল স্রোতের কারণে নদী-তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন গ্রাম, রাস্তা-ঘাট, আবাদি জমিসহ সরকারি বেসরকারি নানা অবকাঠামো নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।

সোনার বাংলা গড়তে তারুণ্যের ভাবনা

সোনার বাংলা গড়তে তারুণ্যের ভাবনা

জুলাই অভ্যুত্থান হলো শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত এক জাগরণ, যা দীর্ঘ ১৫ বছরের পর্বতসম আধিপত্যকে পর্যদুস্ত করেছে। বহুল প্রতীক্ষিত সকলের আশা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকারের আগমন। দীর্ঘ দিনের সকলের একটাই প্রত্যাশা, তা হলোÑ রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত সোনার বাংলাদেশ গড়া। ৫ আগস্টের পর ‘সংস্কার’ শব্দের সাথে মানুষ অনেক বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেছে। সংস্কার অর্থ হলোÑ মেরামত বা সংশোধন। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কাঠামোকে সুষ্ঠু উপায়ে বিন্যাস করে সম্পূর্ণ জনগণের কল্যাণের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় ভ‚মিকা রাখা। এতে কোনো সেক্টর যাতে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে নিয়োজিত না হতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা। একটি দেশ উন্নয়নের জন্য কতিপয় বিষয়ের সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতেই হবে।

সুখ নামের সোনার হরিণ

সুখ নামের সোনার হরিণ

ইউরোপের পাহাড়ি দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সুইজারল্যান্ড। দেশটি আয়তনে ছোট হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। পাহাড়, পর্বত, নদী ও হ্রদের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে এখানে। ক্ষুদ্র পর্বতময় দেশ যার ৭০ ভাগ ঘিরে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। এছাড়া দেশটির রয়েছে নিরপেক্ষতার এক লম্বা ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে তারা কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। এমনকি বিশ্বযুদ্ধেও কোনো পক্ষ নেয়নি। এ নিরপেক্ষতাই তাদের নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এ জন্যই রাষ্ট্রটিকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাও এখানে খুব নিরাপদ। গোপন অর্থ রাখার দেশ হিসেবে সুইস ব্যাংকের কুখ্যাতি বা সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। আর এ জন্যই বিশ্বের ধনীদের অর্থ জমানোর জনপ্রিয় উৎস হলো এই সুইস ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডকে আমি প্রথম দেখি সিনেমা পর্দায়। বলিউডের ঋষি কাপুর, শ্রীদেবী এবং বিনোদ খান্না অভিনীত ত্রিকোণ প্রেমের ছবি ‘চাঁদনিতে’। ছবির মতো সুন্দর দেশটি দেখে প্রথম দর্শনেই মোহিত হয়ে পড়ি। এরপর আরও অনেকবার সিনেমার পর্দায় দেখেছি। দেশটির প্রতি মুগ্ধতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। অবশেষে চাকরির সুবাদে সুইজারল্যান্ড  ভ্রমণের সুযোগ ঘটে গেল। আমার জীবনে দেখা সেরাদেশ ভ্রমণের কথা বললে সুইজারল্যান্ডের কথাই বলতে হয়। তাইতো স্মৃতির রেশ এখনো মনজুড়ে উজ্জ্বল। এটি বিশ্বের অন্যতম একটি ধনী দেশ। জনসংখ্যা এক কোটিরও নিচে। খাওয়া পড়ার কোনো অভাব নেই। ধনী হলেও জনসংখ্যা নিম্নগামী। শিশু জন্মের হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বয়স বেড়ে যাওয়া স্রষ্টার এক অমোঘ বিধান। জীবনের অপরিহার্য সত্য হলো মৃত্যু। এই বয়সে নানারকম সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। শরীরের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। তাইতো প্রবীণদের অনেকেই মনে করেন শরীরটা এখন সৃষ্টি কর্তার কাছে সঁপে দেওয়াটাই যেন শ্রেয়। তাতেই হবে অনাবিল সুখ আর অমরত্ব। যিনি নিজেই নিজের প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি আত্মঘাতী হিসেবে সমাজে বিবেচিত। বিশ্বের অনেক দেশ আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে গণ্য করেন। আবার অনেক ধর্মে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তারপরও তো মানুষ আত্মহত্যা করেন,  নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নেভান। সুইজারল্যান্ডে কিন্তু আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যায় সহায়তা প্রদান করা আইনিভাবে বৈধ। জানা গেছে, দেশটিতে গত এক বছরে হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। আর আত্মহত্যা করতে সাহায্য করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যার নাম ‘এগজিট ইন্টারন্যশনাল’। আত্মহত্যার জন্য  যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, তার নাম ‘সারকো’। বাইরে থেকে যন্ত্রটি নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ভেতর থেকেও তা চালু করা যায়। অর্থাৎ মৃত্যুর প্রত্যাশায় যে ব্যক্তি ওই যন্ত্রটির ভেতরে ঢুকবেন তিনি নিজেও যন্ত্রটি চালাতে পারবেন। এই সংগঠনটির যিনি প্রধান, তাকে সবাই ‘ডক্টর ডেথ’ নামে চেনে। জীবন এক অনিশ্চিত ভ্রমণ। আর মৃত্যু অনিবার্য। একটা বয়সে প্রতিটি মানুষ চায় তার মৃত্যু যেন সহজ, সুন্দর  ও বেদনাবিহীন হয়। তাইতো সুইজারল্যান্ড বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি বিবেচনা করেই এ বিষয়ে আইনগত বৈধতা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মোতাবেক প্রতিবছর প্রায় দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। সুইজারল্যান্ডের মতো ধনী দেশে এত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও আত্মহত্যার তালিকায় দেশটি প্রথমদিকে জায়গা করে নিয়েছে। জীবনের যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, গাড়ি, বাড়ি সবই যখন পেয়ে যান, তাহলে দেশটির মানুষ আত্মাহত্যার পথ কেন বেছে নিচ্ছেন? এ পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কেউই পুরোপুরি সুখী নয়। সুখের আড়ালেই রয়েছে এক ধরনের সুখহীনতা। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অন্তহীন। আর এই অন্তহীন আশা-আকাক্সক্ষার পেছনে ছুটে চলে সে নিরন্তর। আশা-আকাক্সক্ষার যেমন শেষ নেই, তার ছুটে চলারও যেন শেষ নেই। আশা-আকাক্সক্ষা অসীম  কিন্তু পায় সে অল্প। এটাই তার চিরন্তন অতৃপ্তির কারণ। তাই সে যা পায় তাতে তার ক্ষুধা মেটে না। সে চায় আরও আরও অনেক বেশি। তাইতো মানবজীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত অনেক বয়স্ক মানুষের ধারণা, প্রকৃত সুখ বলতে যা বুঝায় তা ওপারে, এপারে নয়। আর এজন্যই রবি ঠাকুর তার কবিতায় বলেছেন, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’। প্রবহমান নদীর দুই পাড়ে যদিও সমান সুখ-সুবিধা ও অসুবিধা আছে, তবুও এপারের মানুষ অন্যপারের মানুষকে অধিকতর সুখী মনে করে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ক্যালভিন বলেন, মানবজীবন চিরদিন সুখশান্তিতে কাটে না। আকাশের দিকে হাত বাড়ালে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই মিলে না। তাই চাওয়া পাওয়ার গণ্ডি মাটির কাছাকাছি হওয়াই ভালো। সারকো, কফিন আকৃতির একটি যন্ত্র। কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে মৃত্যু ডেকে আনা হয়। একবার কফিনে শুয়ে পড়লেই সব শেষ। কিভাবে কম সময়ে এই বেদনাবিহীন মৃত্যুকে আরও মসৃণভাবে কার্যকর করা যায়, এটা নিয়ে তাদের এখন গবেষণা চলছে। জানা গেছে, যারা আত্মহত্যা করতে চায় তারা বয়স্ক এবং কিছুটা হতাশাগ্রস্ত। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা দিব্যি সুস্থ, ঘুরছেন ফিরছেন আবার মনে মনে আত্মহত্যা করার কথাও ভাবছেন। কারণ, তার পরিবারে কেউ নেই, কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই, নেই কোনো আশা-ভরসাও। তাহলে তিনি কেন বেঁচে থাকবেন? কী নিয়ে বেঁচে থাকবেন? তবে এই যন্ত্রটির সাহায্যে কম সময়ে বেদনাবিহীন অনায়াসে  মরতে হলে ওই সংস্থায় ২০০ ডলার দিয়ে সদস্য হতে হবে। এরপর ওই সারকো নামক যন্ত্রটির ভেতর শুয়ে পড়ার আগেই তার কাছ থেকে নেওয়া হবে ৭ হাজার ডলার। আত্মহত্যা করতে হলে কোনো ক্লিনিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সোজা নির্ধারিত ডক্টর ডেথের কাছে গেলেই হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই জানা যাবে মৃত্যুপ্রার্থী ব্যক্তি আর নেই। কোনো এক শীতল ঘরে তিনি মারা গেছেন। সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন। সব মানুষই সুখের পেছনে ছুটে। সুখের জন্য আমরা যতই হাঁসফাঁস করি না কেন, সুখ যেন এক সোনার হরিণ। দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। তাহলে সুখী কে? গাড়ি, বাড়ি, টাকাকড়ি, ধনদৌলত, শিক্ষা-দীক্ষা সব থাকার পরও সুইজারল্যান্ডের রাস্তা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ৭ হাজার ডলার পকেটে নিয়ে সারকো যন্ত্রটিতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষটি, নাকি ১১৮তম সুখী বাংলাদেশের অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি, যে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? আর এ জন্যই গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ‘সুখ হলো মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। একে ধরা যায় না, অর্জন করতে হয়’। লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ

সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে সরকার রাষ্ট্র মেরামতের নানা অসঙ্গতিগুলোকে চিহ্নিত করে যৌক্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রায় অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রসমূহ যথাযথ যুগোপযোগী গণমুখী করার উদ্দেশ্যে সরকারের আন্তরিকতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। গণতান্ত্রিক-মানবিক নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মেধা ও প্রজ্ঞার সমীকরণে বৈষম্য দূরীকরণে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমগ্র নাগরিকের সার্বিক জীবনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও অবৈধ অনৈতিক কর্মযজ্ঞে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বিগত সরকারের কদর্য পৃষ্ঠপোষকতায় স্বল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী দুর্বৃত্তদের লুটপাট ছিল অসহনীয়। অর্থপাচার থেকে শুরু করে এহেন কোনো কাজ নেই, যাতে দেশকে প্রায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। দেশবিধ্বংসী এসব হিংস্র নরপশুতুল্য দানবরা বিদেশে বসে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। চলমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা পর্যায়ে সিন্ডিকেটের বেপরোয়া কারসাজি বাজারব্যবস্থাকে নাজুক করে তুলছে। অন্যদিকে দেশে অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন অযাচিত ইস্যুতে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিটেন্স প্রবাহে সমৃদ্ধি আর্থিক ভিত্তিকে অনেকটুকু মজবুত করলেও দুর্বৃত্তায়নের দুর্ভেদ্য প্রাচীর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা এখনো সম্ভব হয়নি। বহুমুখী সংকট মোকাবিলায় সরকারকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তবুও বিনয়ের সঙ্গে যে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছি তা হলো সমুদ্র সম্পদ আহরণে পর্যাপ্ত মনোযোগ। এ সম্পর্কিত কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনায় বহু ধরনের ইতিবাচক চিন্তাচেতনা দীর্ঘসময় ধরে শোনা গেলেও বাস্তবতায় এর কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এ সম্পর্কে দেশবাসিও সম্যক অবগত বলে মনে হয় না। জ্বালানি তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্র সম্পদ আহরণে পর্যাপ্ত গবেষণা পরিলক্ষিত। কিন্তু এসব গবেষণার ফলাফল প্রয়োগ নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে। বিশ্বের বহু দেশ সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হলেও; এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনেকাংশে পিছিয়ে আছে। জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রমও প্রায় স্থবির-গতিহীন। দক্ষ জনবলের অভাবও প্রকট। ফলশ্রুতিতে দেশের সমুদ্র সম্পদ এখনো বহুলাংশে অনাবিষ্কৃত-অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে যে পরিমাণ তেল-গ্যাস এবং মৎস্যসম্পদ আহরণ করা তার পরিমাণ বঙ্গোপসাগরে থাকা অফুরন্ত সম্পদের তুলনায় অতি নগণ্য। বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪-৫ শতাংশ আসে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে। যার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমুদ্র থেকে শুধু মাছ রপ্তানি থেকেই বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশের সমুদ্র বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছে মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। দেশে বছরে যে পরিমাণ মাছ আহরণ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ আসে গভীর সমুদ্র থেকে। উপকূলীয় একালায় ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। অর্থনীতিবিদদের দাবি, সমুদ্র অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হবে। সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারবে। বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমার তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে, তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব হবে। আমাদের সকলের জানা, বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ধারণা ব্যক্ত করেন। মূলত সুনীল অর্থনীতি হলো সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্র থেকে আহরণকৃত সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে তা সুনীল অর্থনীতি হিসেবে বিবেচ্য। সহজ কথায় সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা সুনীল অর্থনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য। চলমান বৈশ্বিক মন্দায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশেও সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার হাতছানি দেশবাসীকে করছে উদ্বেলিত। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্যক্ষেত্র। সেখানে ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিনসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস রয়েছে। আরও রয়েছে ইসপিরুলিনা নামক সবচেয়ে মূল্যবান আগাছা। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ। যেমন- তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিনসহ ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুত ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। গবেষকগণ বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ম্যারিন জেনেটিক রিসোর্সের অবস্থান এবং বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি-উইডে প্রচুর প্রোটিন আছে যা ফিশ ফিড হিসেবে অমদানি করা ফিশ অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহার হতে পারে। কসমেটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত উপাদানসদৃশ এমন সিউইডও অনেক পাওয়া গেছে।     বিশ্ব অর্থনীতিতেও সুনীল অর্থনীতির নানামাত্রিক অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। দ্য জাকার্তা পোস্টে প্রকাশ পাওয়া নিবন্ধ সূত্রমতে, দ্য লমবক ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়ন কর্মসূচিতে ৭৭ হাজার ৭০০ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা প্রবল। পাশাপাশি প্রতিবছর আয় করবে ১১৪ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৪ সালে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনে সুনীল অর্থনীতির অবদান পরিমাপের চেষ্টা চালায়। ২০১৩ সালে দেশটির অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির অবদান ছিল ৩৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ২ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৭ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ২০২৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে চীনের অর্থনীতিতে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামুদ্রিক শিল্প বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনের জিডিপিতে সামুদ্রিক খাতের অবদান হবে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়াও চীন, জাপান, ফিলিপিন্সসহ অনেক দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী। প্রতিবেদন মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপের সরকারগুলো অর্থনীতির নতুন ফ্রন্ট হিসেবে সমুদ্র সম্পদের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশের প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির অবদান প্রায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। আয়ের সর্বোচ্চ অংশ আসে পর্যটন ও বিনোদন খাত থেকে। যার পরিমাণ ২৫ শতাংশ। মৎস্য ও যাতায়াত উভয় খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ২২ শতাংশ। গ্যাস ও তেল উত্তোলন থেকে আয় ১৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, ব্লু ইকোনমির চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করলে বছরে বাংলাদেশের পক্ষে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। এই চারটি সেক্টর হলো তেল ও গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য আহরণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটন। এই খাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সমুদ্র সম্পদ আহরণের নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। নবতর কর্মকৌশল প্রণয়ন ও আশু-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদি প্রায়োগিক পদক্ষেপ দৃশ্যমান করা না গেলে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে কার্যকর প্রবৃদ্ধি অর্জন দীর্ঘায়িত হবে। ন্যূনতম অবজ্ঞা-অবহেলা পরিহার করে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবেই। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের উন্নয়নে সচল অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় সমুদ্র সম্পদ আহরণের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে কালক্ষেপণ না করে এক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

কৃষকের মুখে হাসি

কৃষকের মুখে হাসি

কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর কথা আমরা বলে থাকি। কেননা, কৃষক হাসলেই মাঠ হাসে, অর্থাৎ উৎপাদনে গতি আসে। বিষয়টি পরস্পর পরিপূরক। ভালো ফলন হলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোয় ভূমিকা রেখেও অনেক সময় কৃষকের মুখে হাসি থাকে না। বলা ভালো, কৃষকের মুখের হাসি কেড়ে নেওয়া হয়। পণ্যের ন্যায্য দাম না পেলে এমনটাই হওয়ার কথা। আবার ফসল ফলানোয় বাধা থাকলেও কৃষকের মুখের হাসি নিভে যায়। ২৮ বছর পর কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবারের জনকণ্ঠে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তুলশীগঙ্গা নদী পুনর্খনন করায় ২৮ বছর পর সুফল পাচ্ছে জয়পুরহাটের কৃষকরা। এখন তাদের মুখে হাসি। বছর বছর আমন ফসল না পাওয়ার দুঃখ তাদের ঘুচেছে। ১৯৯৫ সালে নদীর উভয় তীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হলেও নদী খনন না হওয়ায় সুফল পাননি কৃষকরা। গভীরতা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি মাঠে ঢুকে প্লাবিত হয়ে নষ্ট হতো এলাকার হাজার হাজার হেক্টর আমন খেত। সেই থেকে নদী খননের দাবি ছিল ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের। অবশেষে তুলশীগঙ্গা নদী পুনর্খনন করার পর পাল্টে গেছে এলাকার সেই চিত্র। খননের পর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বর্ষার পানি দ্রত নদীপথে অপসারিত হওয়ায় নদীর দুই তীরে ফসলের মাঠগুলোতে এখন চাষ হচ্ছে আমন ধান। প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার আমন ধান চাষ করতে পেরে খুশি এলাকার কৃষকরা।  নদী তীরবর্তী এলাকা ঘুরে জনকণ্ঠের প্রতিনিধ দেখেছেন, নদী পুনর্খননের ফলে উভয় তীরের জমিতে চলতি মৌসুমে ব্যাপকহারে আমন ধান চাষ হয়েছে। বিশেষ করে জয়পুরহাট সদর উপজেলার বানিয়াপাড়া, ধারকী, সোটাহার, সতিঘাটা, ক্ষেতলালের বটতলী, ইকরগাড়া, আটি দাশড়া, হাওয়ার বিল, দেওগ্রাম এবং আক্কেলপুরের হাসতা বসন্তপুর, জাফরপুর ও অনন্তপুর মাঠে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে গত বছর থেকে আমন ধান চাষ করছে কৃষকরা। অথচ নদীর গভীরতা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে গত ২৮ বছর ধরে নদীর দু’পাশের এসব মাঠের হাজার হাজার হেক্টর জমি বর্ষার পানিতে ডুবে থাকায় আমন ধান চাষ করতে পারেনি কৃষকরা। খননের ফলে বর্ষার পানি নদীপথে দ্রুত অপসারিত হওয়ায় বর্তমানে প্লাবিত হচ্ছে না ফসলের মাঠ। ফলে, খুব সহজেই আমন ধান চাষ করতে পারছে তুলশীগঙ্গা নদীর দু’পারের কৃষকরা। উল্লেখ্য, বন্যানিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালে তুলশীগঙ্গা নদীর ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলা অংশের উভয় তীরে দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো চাই। এ জন্য কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। সেইসঙ্গে চাষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ রাখতে হবে। নদী  পুনর্খননের সুফল হিসেবে আজ জয়পুরহাটবাসী কৃষকরা সন্তোষ প্রকাশ করছেন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশের খরা ও ভাটি অঞ্চলের কৃষকদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা চাই। মনে রাখতে হবে, কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।

ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান

ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সুযোগ সম্প্রসারণে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। একটি দল হিসেবে একসঙ্গে এবং দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে কাজ করলে সম্ভাব্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিং, করহার ও করনীতির নিশ্চয়তা প্রদান, সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ উন্নত করা, বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস অধিক কার্যকর এবং ক্রেডিট রেটিং উন্নত করার কথা জানান ব্যবসায়ীরা। এতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও হবেন আকৃষ্ট। তবে ব্যবসা পরিচালনায় প্রয়োজন স্বচ্ছতা। অস্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির জাল সমাজের প্রতিটি সেক্টরে বিদ্যমান। বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব, তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার  এবং সমস্যাগুলো  চিহ্নিত করতে হবে ব্যবসায়ীদের। যাতে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়। অনেক বছর যাবৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের বিশ্বাসে ঘাটতি এবং অসামঞ্জস্য সম্পর্ক প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়েছে। আবার আশপাশের অনেক দেশের তুলনায় ব্যবসা শুরুর সূচকে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ব্যবসা পরিচালনায় পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয় উদ্যোক্তাদের। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূর করতে তৈরি করতে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। বাংলাদেশে অর্থনীতির অবস্থা কয়েক বছর ধরে খুবই নাজুক। বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) অতীতে যেসব ‘ডুইং বিজনেস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থান অধিকাংশ সময় নিচের দিকে ছিল। গত মার্চে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) বৈদেশিক বাণিজ্যের বাধাবিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ঘুষ, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ যেন হারিয়ে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া আবশ্যক। চলমান শ্রমিক অসন্তোষে পোশাক কারখানা ভাঙচুর ও বন্ধ থাকায় আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স। এক্ষেত্রে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নানা রকম চ্যালেঞ্জ। ঝুঁকি তৈরি হয়েছে ছোট-বড় সব ব্যবসার ক্ষেত্রেই। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগÑ সবটিতেই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। আর ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্বাভাবিক গতি না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘটে বিচ্যুতি। কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে দুই বছর আগে থেকেই। নানা রকম আন্দোলন দেশজুড়ে লেগেই আছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য পরিবহন। অন্যদিকে বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাওয়ায় প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে তৈরি করতে হবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ও বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ করা একান্ত প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বে দ্রুত ব্যবসাবাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ আসবে এবং দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবেÑ এটাই প্রত্যাশা।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ, যা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্যই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি সমাজে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করতে পারে, তখন সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারে এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, যা সমাজকে আরও বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীল করে তোলে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গ্রামের মানুষ সাধারণত একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়। তারা বিভিন্ন সামাজিক কাজে একত্রিত হয় এবং পরস্পরের পাশে দাঁড়ায়। এই সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রামের মানুষের জীবনে একটি বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং তাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। রবি ঠাকুরের গান, নজরুলের কবিতা কিংবা লালন ফকিরের দোহাÑ সব কিছুতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছোঁয়া রয়েছে। এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন শুধু শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাধারণ মানুষের মাঝেও একটি গভীর সংযোগ তৈরি করে।   সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে শুধু সরকার ও নাগরিকদের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অপরিহার্য। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করা। যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়, তখন গণমাধ্যমের ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সমাজকে শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে।  তবে কখনো কখনো কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হানাহানির সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সবসময় এই ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে। বাংলাদেশ সরকারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও সমান গুরুত্ব দেয়, যা সকল ধর্মের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হচ্ছে। ফলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব বুঝতে পারছে এবং ভবিষ্যতে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকেরও কর্তব্য। প্রত্যেককে নিজের অবস্থান থেকে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই সম্প্রীতির চর্চা ও প্রসার ঘটাতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা দিয়ে বজায় রাখতে হয়। আমাদের প্রতিদিনের আচরণ ও চিন্তাধারায় এই সম্প্রীতির মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। তবেই আমরা একটি সত্যিকার অর্থে মানবিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, ও সংস্কৃতির মানুষ সমানভাবে সম্মানিত ও নিরাপদ থাকবে। আমাদের বুঝতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে এবং একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আমাদের বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। তাই আমাদের সকলের উচিত এই সম্প্রীতির মন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করা।

অবাধ বালু উত্তোলন নয়

অবাধ বালু উত্তোলন নয়

নগরায়ণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রাচীনকাল থেকেই বালুর ব্যবহার প্রচলিত। বিভিন্ন নির্মাণ কাজে বালু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মরুভূমিতে বালু থাকলেও তা’ নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তাই সর্বত্রই নদীর তলদেশের বালু উচ্চমানের নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যখন তখন অপরিকল্পিত উপায়ে অবাধ বালু উত্তোলন বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে। বালুসন্ত্রাস এবং অবৈধ বালুমহাল বাংলাদেশের জন্য ও এক নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। নদী বিধৌত বাংলাদেশের প্রায় ২৪,১৪০ কি.মি নদী রয়েছে। বহ্মপুত্র, তুরাগ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, ফেনী, তিস্তা নদীসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীতেই সংঘবদ্ধ চক্র বালুমহাল নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে।  স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক হর্তা-কর্তা, এমন কী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালুমহাল ইজারার ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে না কোনো নীতিমালা। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, লালমনির হাট, কুড়িগ্রাম ও কুষ্টিয়া বালু উত্তোলনের প্রধান ঘাট হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না, এছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের অবৈধ বালুমহাল টেন্ডার সন্ত্রাসকেও হার মানিয়েছে। ২০২১ সালেই অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য অন্তত ২৭ জনকে জরিমানা ও ৫৫ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে ড্রেজার মেশিন ধ্বংস করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেঘনা চর দখল ও বালুমহালকে কেন্দ্র করে ১২ জন মানুষ নিহত ও প্রায় ৪৬০ জনের মতো মানুষ আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও বালুবাহী ট্রাকচাপায় রাজশাহীতে কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন। নদীতে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে নদী হারাচ্ছে তার নাব্য ও গতিপথ এবং নদীভাঙনের দরুন হাজার হাজার পরিবার হচ্ছেন বাস্তুচ্যুত। বালু উত্তোলন সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাস স্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি জমিও নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও নলকূপে পানি পাওয়াও কষ্টকর হচ্ছে। অবৈধ বালু উত্তোলন একই সঙ্গে পরিবেশ, সামাজিক ও বাস্তুসংস্থানজনিত সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে অবাধ বালু উত্তোলন নদীর তলদেশ ও নদীপাড়ের কার্যক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। যখন নদীতে অতিরিক্ত বালু উত্তোলন করা হয় তখন নদীর প্রবাহ কমতে থাকে, যার কারণে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়। নদীভাঙনের দরুন অনেক মানুষ বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে বালু উত্তোলন জনিত নৈরাজ্য পরিবেশগত সংঘাতের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত। অতিরিক্ত মাত্রায় বালু উত্তোলন নদীর জলপ্রবাহ কমিয়ে নদীর ক্ষয় বাড়িয়ে তুলছে। যার কারণে নদীর পাড়ভাঙা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণে নদীর আশপাশের অব কাঠামো, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু, ফসলি জমি ইত্যাদিকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলছে। বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন ও বন্যার ফলে অনেক লোকজন বসতভিটা হারিয়ে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে।   অবাধ বালু উত্তোলন দিন দিন পরিবেশের জন্য নানাবিধ হুমকি তৈরি করছে। তাই অবৈধ বালু উত্তোলন রোধে জনগণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গণমাধ্যম সবার দায়িত্বশীল এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। আমাদের বর্তমান কাজের দ্বারাই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়। তাই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা [email protected]

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শান্তিপ্রিয় মানুষ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শান্তিপ্রিয় মানুষ

রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের পর, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কায় কাঁপছে পুরোবিশ^। কারণ, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ মানেই পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিগত কয়েক মাস থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ ভূখণ্ডের গভীরে এমন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আসছিলেন। অবশেষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষের দুই মাস আগে বাইডেন এমন অস্ত্র ব্যবহারের সবুজ সংকেত দিলেন। এর পূর্বে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছিলেন যে, এমন পদক্ষেপ মানে ন্যাটো মিত্র জোট সরাসরি ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে পুতিন বলেছিলেন, যদি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে দেয়, এটির অর্থ হবে তারা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পুতিন হুমকি দিয়ে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ চলমান যুদ্ধের প্রকৃতি এবং পরিধি বদলে দেবে। নতুন এ হুমকির বিরুদ্ধে রাশিয়া যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেও তিনি জানান। পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ কোনো দেশের মিসাইল দিয়ে ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে রাশিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। জো বাইডেনের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় মস্কো বলেছিল, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউক্রেন যদি সত্যিই মার্কিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। মার্কিন প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রয়া জানিয়ে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদায়বেলায় বাইডেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। এতে করে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এমনকি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও বলেছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ বাধাতে চান। আমার বাবা শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জীবন বাঁচানোর সুযোগ পাওয়ার আগেই তারা তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু করতে চায়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় গোয়েন্দার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রিচার্ড গ্রেনেল লেখেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে বাইডেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন, তা কেউ ধারণা করেননি। বিষয়টি এমন, তিনি নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। ফলে, সব বদলে গেল। আগের সকল হিসাব-নিকাশ এখন অকার্যকর। সিনেটর মাইক লি বলেন, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করে দিলেন জো বাইডেন। কিয়েভভিত্তিক ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সেরহি কুজান বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার রাজনীতিবিদরা একে গুরুতর উত্তেজনা বৃদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার আইনপ্রণেতা আন্দ্রেই ক্লিসাস তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হবে বলে সতর্কতা দিয়েছেন। ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে তিনি লিখেছেন, পশ্চিমারা উত্তেজনা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে সকালের মধ্যে ইউক্রেন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যেই যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালাবে, তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা হামলা চালানো হবে। এক্ষেত্রে কোনো দেরি করা হবে না। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় ধাপ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। যুদ্ধের এক হাজারতম দিনে তিনি এ সংক্রান্ত একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন বলে পুতিনের মুখপাত্র এবং ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ জানান। নতুন এই ডিক্রিতে বলা হয়, যেসব দেশের পরমাণু অস্ত্র নেই, তাদের যদি তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষ এ ধরনের বিধ্বংসী অস্ত্র প্রদান করে, সেক্ষেত্রে সেসব দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। পেসকভ বলেন, পরমাণু অস্ত্র নেইÑ এমন কোনো আগ্রাসী দেশের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ কোনো দেশ যদি জোটবদ্ধ হয়, তাহলে তা আর একক নয়; বরং যৌথ হামলায় পরিণত হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নীতি অক্ষুণ্ন রেখে যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, আমরা সেটিই নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া সবসময় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার বিপক্ষে। আমরা শুধু আমাদের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। জো বাইডেনের এ সিদ্ধান্ত ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ন্যাটো অংশীদারদের ওপর রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক নাশকতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ, পুতিন আগেই সতর্ক করেছিলেন, ইউক্রেন যদি মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসিদের ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তা মস্কোর বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে। এর ফল হবে বিপর্যয়কর। যুদ্ধ এখন সেদিকেই মোড় নিল। জি-৭ নেতাদের একটি যৌথ বিবৃতিতে ‘যতদিন সময় লাগে ইউক্রেনের প্রতি অটুট সমর্থন’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের এক হাজার দিন পূর্তিতে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ব্রাজিলে এ সপ্তাহে একই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন ১৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে। মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলমান। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইরানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগদান এই অঞ্চলের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল সে¥াট্রিচ গণমাধ্যমে আয়োজিত এক টকশোতে দখলদার রাষ্ট্রটির সীমানা ইউফ্রেটিস থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার পক্ষে জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরেন। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরোবিশে^ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে। সে¥াট্রিচ বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ঘিরে রেখেছে, সেই সঙ্গে মিসর এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অঞ্চল এবং ইরাকে পৌঁছানো অঞ্চলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত করার উচ্চাকাক্সক্ষা। এই তালিকায় সৌদি আরবও রয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, মিসর এবং এমনকি সৌদি আরবের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ইরান অত্যাধুনিক সকল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। ইরানের প্যারামিলিটারি রেভুল্যুশনারি গার্ড জানায়, এ সকল সমরাস্ত্রের মধ্যে এমন  ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন রয়েছে যা সরাসরি ইসরাইলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। তেহরান মনে করে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপারেশন ট্রু প্রমিজ-থ্রি পরিচালনা করা হবে, যা ওয়ান ও টু এর চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হবে। নেতানিয়াহু প্রশাসন যা অনুমানও করতে পারবে না। গাজা ও লেবানন যুদ্ধের মধ্যে গত এপ্রিল মাস থেকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরাইলে ১৮১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়। এর জবাবে গত ২৬ অক্টোবর ইসরাইল শতাধিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে হামলা চালায় ইরানে। এই হামলায় রাজধানী তেহরানসহ দেশটির কয়েকটি প্রদেশের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এরপর থেকেই ইসরাইলে পাল্টাহামলা চালানো হবে বলে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এমন প্রদর্শনী নেতানিয়াহু প্রশাসনের জন্য অনেকটা চাপের। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ও শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইরানের নিকট। এ বিষয়ে ইরান জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, গাজায় এক বছর ধরে যে গণহত্যা চলছে, তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকেই দিতে হবে। গাজা সংকট মোকাবিলায় তার দেশ প্রয়োজনে ইসরাইলে ঢুকবে। তিনি বলেন, তুরস্ক এর আগে লিবিয়ায়ও ঢুকেছে। ইসরাইলের ক্ষেত্রেও তারা ভেতরে ঢুকতে পারবে মন্তব্য করে এরদোয়ান বলেন, এ জন্য আমাদের অনেক কঠিন হতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে এ ধরনের উপহাস করতে না পারে। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন এবং লেবাননে যারা মারা যাচ্ছে তারা শুধু নারী, শিশু এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকই নয়, মানবতা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাও। ন্যাটো জোটের মিত্রদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে এরদোয়ান নেতানিয়াহুকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, মানবতার অভিন্ন জোট যেভাবে হিটলারকে থামিয়েছে, একইভাবে নেতানিয়াহু ও তার হত্যার নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হবে। অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পশ্চিমতীরে অবৈধ ইহুদি বসতির সম্প্রসারণ ইসরাইল অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকি মোকাবিলায় ইসলামিক দেশগুলোর একটি জোট গঠন করা উচিত বলে এরদোয়ান মনে করেন। তিনি বলেন, ঐক্যই একমাত্র পদক্ষেপ, যা ইসরাইলি দাম্ভিকতা, ইসরাইলি দস্যুতা ও ইসলামিক দেশগুলোয় ইসরাইলি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে পারে। ইসরাইলের এই ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণবাদ লেবানন ও সিরিয়ার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে বলে তিনি অভিহিত করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তুরস্ক সম্প্রতি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানান। সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলাই এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য। এরদোয়ানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, এরদোয়ানের এই বক্তব্য বিপজ্জনক, মিথ্যা ও উসকানিমূলক। এরদোয়ান ইরানের সঙ্গে মিলে এই অঞ্চলের আপেক্ষাকৃত কম কট্টর দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে কাজ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজার বড় অংশই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) প্রদত্ত তথ্যানুসারে, যুদ্ধে গাজার ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ১৫ বছর তথা ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবেই ইসরাইল এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে থাকে, যা ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত। ইসরাইলের এই কুখ্যাত যুদ্ধনীতি লেবাননেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশটির রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা এবং লেবাননে ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। ইসরাইলের প্রতি ইউরোপীয় জোটের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বলেন, ইইউ এখন পর্যন্ত ইসরাইল সরকারকে যেকোনো অর্থবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলেছে। গাজা এবং লেবাননে ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে বোরেল ইসরাইল থেকে আমদানি নিষিদ্ধ থেকে শুরু করে দখলদার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ স্থগিত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই জোটের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করারও আহ্বান জানান। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে উত্তেজনাও চরমে। এতে আমেরিকা জড়িত থাকায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। চীনও তাদের সমর্থন দিচ্ছে। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনাও ক্রমশ সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজিত করছে। আবার দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিতে চীন ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ চলমান। এই বিরোধে আবার ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ^ আজ বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ইসরাইলের পক্ষে কথা বললেও তুরস্ক, রাশিয়া এবং চীন, গাজা ও তেহরানের প্রতিই সমর্থন বাড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, চীন সবসময়ই ইরানের বিশ^স্ত অংশীদার এবং বরাবরের মতোই ইরানকে সমর্থন করবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির চাপ আরোপের বিরোধিতা করবে চীন। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, তার দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইউরোপের দেশগুলো প্রস্তুত করছে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন যদি ব্যর্থ হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপকে যুদ্ধে জড়িয়ে দেবে। মস্কোর বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোর যুদ্ধ করা তাদের জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। ক্রেমলিন জানিয়েছিল, রাশিয়া ‘পরমাণু নীতি’ পাল্টে ফেলবে। এমনকি যে দেশগুলোর  নিকট আণবিক অস্ত্র নেই, তাদেরকেও আক্রমণ করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র নিকট চূড়ান্ত সতর্কতা হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েই আমরা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করব। এখনই আমরা এটা করতে চাই না। কিন্তু আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত থাকতে চাই। এখন পুতিনের বক্তব্যই সঠিক হতে চলেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরমাণু অস্ত্রের সামরিক মহড়া দিয়ে ইউক্রেন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সরাসরি হুমকি দিল রাশিয়া। এর ফলে, ইউক্রেন থেকেই তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কিয়ামতের কিছু আলামত

কিয়ামতের কিছু আলামত

কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অন্যতম সর্বশেষ ভয়াবহ আলামত: আখেরী যামানায় কিয়ামতের সন্নিকটবর্তী সময়ে যমীন থেকে দাববাতুল আরদ্ নামক এক অদ্ভুত জন্তু বের হবে। জন্তুটি মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার পর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এটি বের হবে। সহীহ হাদিস থেকে জানা যায় যে, পশ্চিম আকাশে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরই যমীন থেকে এই অদ্ভুত জানোয়ারটি বের হবে। তাওবার দরজা যে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে- এ কথাটিকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করার জন্য সে মুমিনদের কাফের থেকে নির্দিষ্ট চিহ্নের মাধ্যমে আলাদা করে ফেলবে। মুমিনের কপালে লিখে দিবে ‘মুমিন’ এবং কাফেরের কপালে লিখে দেবে ‘কাফের’। কুরআন মাজিদের সূরা নামলের ৮২ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘যখন প্রতিশ্রুতি (কিয়ামত) নিকটবর্তী হবে তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি প্রাণী নির্গত করব। সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে : এ বিষয়ে যে, মানুষ আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করত না’। ইবনে কাছীর বলেন : আখেরী যামানায় মানুষ যখন নানা পাপাচারে লিপ্ত হবে, আল্লাহর আদেশ পালন বর্জন করবে এবং দ্বীনকে পরিবর্তন করবে তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সামনে এই জন্তুটি বের করবেন’। - (৩/৩৫১)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘জন্তুটি মানুষের মতই কথা বলবে’। - পূর্বোক্ত উৎস। প্রাণীটির কাজ কি হবে এবং কি বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে- এ ব্যাপারে আল্লামা আলূসী বলেন : আয়াতে উল্লিখিত কুরআনের বাণীটিই হবে তার কথা। অর্থাৎ  আন্নান নাসা কানু বি আয়াতিনা লা ইউক্বিনুন। - মানুষেরা আমার আয়াতসমূহে বিশ^াস করেনি। এই বাক্যটি সে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শুনাবে। মর্ম এই যে, আজকের পূর্বে অনেক মানুষই আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করেনি। বিশেষ করে কিয়ামতের আলামত ও তা সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে। এমনকি আমার আগমনের বিষয়েও অনেক মানুষ বিশ্বাস করত না। এখন সে সময় এসে গেছে এবং আমিও বের হয়ে এসেছি। দাব্বাতুল আরদ্ সম্পর্কে হাদিস থেকে যা অবগত হওয়া যায় : ক) মুসলিম শরীফে হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন : ‘একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আগমন করলেন। আমরা তখন কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, ‘যতদিন তোমরা দশটি আলামত না দেখবে ততদিন কিয়ামত হবে না। (১) ধোঁয়া (২) দাজ্জালের আগমন (৩) ভূগর্ভ থেকে নির্গত দাব্বাতুল আরদ্ নামক অদ্ভুত এক জানোয়ারের আগমন ৪) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় (৫) ঈসা ইবনে মারইয়ামের আগমন (৬) ইয়াজুয-মা’জুযের আবির্ভাব (৭) পূর্বে ভূমিধস (৮) পশ্চিমে ভূমিধস (৯) আরব উপদ্বীপে ভূমিধস (১০) সর্বশেষে ইয়ামান থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে  নেবে’। খ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দাববাতুল আরদ্ নামক একটি প্রাণী বের হবে এবং মানুষের নাকে চিহ্ন দেবে। অতঃপর মানুষেরা পৃথিবীতে জীবন যাপন করবে। প্রাণীটি সকল মানুষের নাকেই দাগ লাগিয়ে দেবে। এমনকি উটক্রয়কারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তুমি এটি কার কাছ থেকে ক্রয় করেছো? সে বলবে : আমি এটি নাকে দাগ ওয়ালা একজন ব্যক্তির নিকট থেকে ক্রয় করেছি’। -মুসনাদে আহমাদ। সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদিস নং- ৩২২। গ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন : ‘দাববাতুল আরদ্ বের হবে। তার সঙ্গে থাকবে মূসা (আ.) এর লাঠি এবং সুলায়মান (আ.) এর আংটি। কাফেরের নাকে সুলায়মান (আ.)এর আংটি দিয়ে দাগ লাগাবে এবং মূসা (আ.)এর লাঠি দিয়ে মু’মিনের চেহারাকে উজ্জ্বল করে দেবে। লোকেরা খানার টেবিল ও দস্তরখানায় বসেও একে অপরকে বলবে : হে মু’মিন! হে কাফের! মুসনাদে ইমাম আহমাদ। আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন, হাদিস নং- ৭৯২৪। প্রাণীটির ধরন কেমন হবে? প্রাণীটি হবে মানব জাতির কাছে পরিচিত চতুষ্পদ জন্তুসমূহের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সেটি মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। প্রাণীটি কোন শ্রেণীর হবে- এ নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। যেমন, ইমাম কুরতুবী বলেন: এটি হবে সালেহ (আ.) এর উটনীর বাছুর। যখন কাফেররা উটনীকে হত্যা করে ফেলল তখন বাছুরটি পাথরের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। এটি আল্লাহ তাআলার অনুমতিক্রমে কিয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবে। ইমাম কুরতুবী বলেন : এটিই বিশুদ্ধ মত। আবার কেউ কেউ বলেছেন এটি হবে হাদিসের কিতাবসমূহের মধ্যে দাজ্জালের প্রসঙ্গে বর্ণিত জাস্সাসা বা গোয়েন্দা বোঝানোর পরিভাষাটি। অবশ্য অনেকের মতে এ মতটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দাজ্জালের হাদিসে যে প্রাণীটির কথা এসেছে তার নাম জাস্সাসা। আর কিয়ামতের পূর্বে যে প্রাণীটি বের হবে তার নাম দাব্বাতুল আরদ্, যা কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩) কেউ কেউ বলেছেন : এটি হলো সেই সাপ যা কা’বার দেয়ালে ছিল। কুরাইশরা যখন কা’বা ঘর নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করল তখন সাপটিই তাদের নির্মাণ কাজ শুরু করতে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি পাখি এসে সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলে নির্মাণ কাজের বাধা দূর হয়ে যায়। শায়খ আহমাদ শাকের মুসনাদে আহমাদের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘কুরআনের আয়াতে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় বলা আছে এটি হলো দাববাতুল আরদ্। দাববা অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোনো প্রকার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বরং আমরা বিশ্বাস করি আখেরি যামানায় একটি অদ্ভুত ধরনের জন্তু বের হবে। সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। কুরআন ও সহীহ হাদিসে তার গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাতে বিশ্বাস করি। পৃথিবীর কোন্ জায়গা থেকে প্রাণীটি বের হবে? ১) এটি বের হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ থেকে। ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘সাফা পাহাড় ফেটে প্রাণীটি বের হবে। তিনি বলেন, আমি যদি চাইতাম তাহলে যে স্থানটি থেকে বের হবে তাতে পা রেখে দেখাতে পারতাম ’। - তাফসীরে কুরতুবী (১৩/ ২৬৩), তাবারানী ফিল আওসাত (২/১৭৬)। ২) জন্তুটি তিনবার বের হবে। প্রথমে বের হবে কা’বা শরীফ হতে দূরবর্তী একটি গ্রাম থেকে। অতঃপর কিছু দিন লুকিয়ে থাকার পর আবার বের হবে। পরিশেষে কাবা ঘর থেকে বের হবে। এ ব্যাপারে আরও কথা বর্ণিত আছে। সব মিলিয়ে আমরা বলব : মক্কা শরীফ থেকে দাববাতুল আরদ্ বের হবে। অতঃপর সমগ্র পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে। আসলে ইদানীং আমরা কেয়ামত ঘনিয়ে আসছে ঘনিয়ে আসছে এমন নানা বাদানুবাদ সমাজে শুনতে পাই। এমতাবস্থায় আমাদের ইয়াকীন রাখতে হবে ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে অবশ্যই কিছু ধারাবাহিক আলামত পৃথিবীতে দৃশ্যমান হবে। তন্মাধ্যে দাব্বাতুল আরদ নামে এক প্রাণীর আবির্ভাব অন্যতম।

প্রশাসক-রিসিভার নিয়োগ ॥ একটি পর্যবেক্ষণ

প্রশাসক-রিসিভার নিয়োগ ॥ একটি পর্যবেক্ষণ

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যবসয়িক প্রতিষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করাই এর মূল উদ্দেশ্য। সম্প্রতি হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপে বাংলাদেশ ব্যাংক রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার পর বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহল বরাবরের মতো সরকারি যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে এবারও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু দুর্বৃত্ততাড়িত ও সর্বদা মুনাফাকামী পুঁজিবাদী বিশ^ ব্যবস্থার ঘোর অনুসারী বাংলাদেশের মূলধারার ব্যবসায়ী মহল কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে না এবং সবকিছু বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ারই পক্ষে, সেহেতু তাদের এমন উদ্বেগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে তা যথেষ্ট যৌক্তিক। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, অর্থনীতিতে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি যাতে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক-রিসিভার নিয়োগের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণের আগে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের এ সংক্রান্ত পদক্ষেপের দিকে কিছৃুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বেক্সিমকোতে নিয়োগ দেওয়া রিসিভারের কাজ হবে গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে ইতোমধ্যেই রিসিভার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি সংযুক্ত করে তা ব্যবস্থাপনায় ৬ মাসের জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে ১২ নভেম্বর আপিল বিভাগ বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের আদেশ বহাল রেখে কেবল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে আপিল বিভাগ রিসিভার নিয়োগ নিয়ে হাইকোর্টের জারি করা রুল দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তিরও নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস চেয়ারম্যান, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃৃতি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর হিসেবে বহুলভাবে সমালোচিত এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন কারাবন্দি। বেক্সিমকো গ্রুপের অধীনে দ্য বেক্সিমকো গ্রুপ, বেক্সিমকো জুট, বেক্সিমকো ফার্মা, বেক্সিমকো সিনথেটিক্স, বেক্সিমকো টেক্সটাইল অ্যাপারেল, শাইনপুকুর সিরামিক, বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম, বেক্সিমকো পাওয়ার, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং, বেক্সিমকো মেরিন ফুডস, বেক্সিমকো আইটি, আইএফআইসি ব্যাংক, ইয়েলো, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, আকাশ ডিটিএইচ, বেক্সিমকো রিয়েল এস্টেট, বেক্সিমকো কম্পিউটার, বেক্সট্রেড, বেক্সিমকো সিকিউরিটিজ, বেক্সিমকো কমিউনিকেশনস, ওয়েস্টিন হোটেল বাংলাদেশ, শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব, বেক্সিমকো ফুডস, গিগা টেক, বেক্সিমকো ফিশারিজ, বেক্সিমকো পোর্টস, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং, বেক্সিমকো পিপিই, বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নামে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩০টি প্রতিষ্ঠানে ৭০ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োজিত আছেন। এসব প্রতিষ্ঠান সালমান এফ রহমান ক্ষমতা ও ঘুষ-দুর্নীতির জোরে নামে-বেনামে প্রায় ২০টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একাধিক নিয়ম শিথিল করে সালমান রহমানকে দেদারছে অর্থ নিতে সহায়তা করে। সরকারি-বেসরকারি ৮টি ব্যাংকেই বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ (নন-ফান্ডেডসহ) দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এসব ব্যাংক বেক্সিমকোর একাধিক বন্ডে আরও ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর বাইরে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বেক্সিমকোর বিপুল ধারদেনা রয়েছে। এর আগে অত্যন্ত বিতর্কিত বহু স্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনিতে একাধিক প্রশাসক বসাবে বলে জানিয়েছে বর্তমান সরকার। এমএলএম আইন পাসের পর সম্প্রতি ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য যে বিধিমালা তৈরি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার আলোকেই এই গ্রুপে এক-একাধিক প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড ও ট্রি প্ল্যানটেশনের নামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এক বছর ধরেই জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়িসহ ডেসটিনির যাবতীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দায়িত্ব পুলিশ পালন করছে। তবে পুরো সম্পত্তি দখলে নিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের নিরীহ মানুষকে মুনাফার লোভ দেখিয়ে ডেসটিনি গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে। এদিকে পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে গড়িমসির ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের সমস্যা পেলে সেখানে প্রশাসক বসিয়ে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। উল্লেখ্য, গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও মিরপুরের মতো পোশাক কারখানা-অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রশাসক-রিসিভার এখন আলোচিত বিষয় হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। এ ধরনের উদ্যোগ মূলত শুরু হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধপরবর্তী সময়ে জাতীয়করণের মোড়কে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা আনতে তৎকালীন সরকার বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করেছিল। একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিল্প-কারখানা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকার বলেছিল, এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতকে ত্বরান্বিত এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে ১৯৭৫ সালের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় এবং অনেক প্রতিষ্ঠানকে আবারও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেশে মিশ্র অর্থনীতির পথপরিক্রমা শুরু হয়, যা এখনো চলমান। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের জাতীয়করণের এই উদ্যোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয়করণের ফলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও অসুবিধাও হয়েছিল। যেমন সুবিধার মধ্যে ছিল প্রথমত, জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার আর্থিক খাত, শিল্প খাত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যা আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দ্বিতীয়ত, জাতীয়করণের ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাভের পরিবর্তে জনসেবার লক্ষ্যে কাজ করানোর মানসিকতা সৃষ্টি সহজ হয়, যা সরকারি পরিষেবার গুণগতমানের উন্নতিতে সহায়ক হয়েছিল। তৃতীয়ত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত মুনাফার জন্য শহরমুখী থাকে। জাতীয়করণের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে সারাদেশে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিষেবা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা গিয়েছিল। চতুর্থত, জাতীয়করণের ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনিক কার্যক্রমের ওপর নজর রেখে কর্মীদের মাঝে সততার সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কারণে কিছু অসুবিধাও পরিলক্ষিত হয়েছিল। প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথাগতভাবেই কাজের প্রতি উদাসীনতা বা দক্ষতার অভাব রয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতের সেবার গতি ও মান কমে যায়। দ্বিতীয়ত, জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় সরকার একটি নির্দিষ্ট খাতের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যা প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে বাজারের স্বাভাবিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত ব্যয় ও লোকসান। সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ক্ষেত্রে বাজেটের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান লাভজনক না হওয়ায় সরকারের অর্থনৈতিক দায় বেড়ে যায়। চতুর্থত, রাজনৈতিক প্রভাব। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপচয় বেশি হয় বলে দেখা গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিকভাবে নীতি প্রয়োগ ও দক্ষ কর্মী নিয়োগে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অর্থনীতি শাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় বেসরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রয়োগের উপায়। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে পুনরুদ্ধার এবং বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা। বিভিন্ন দেশে বিশেষত যেখানে আর্থিক বা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় সেখানে সরকার এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার এমন খাতকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে যেগুলো জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ ব্যাংকিং, জ্বালানি, যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের কথা বলা যায়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জরুরি সম্পদের সুরক্ষা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর্থিক সংকটে পড়ে তাহলে অনেক সময় তাদের সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে স্থিতিশীল রাখতে পারে। বড় প্রতিষ্ঠান বা খাতে কর্মরত অনেক কর্মী জাতীয়করণের ফলে তাদের কাজের স্থায়িত্ব পায়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়ক। সংকটকালীন পরিবেশে মানুষের প্রয়োজনীয় সেবা যেন অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয়করণ একটি কার্যকর পদক্ষেপ। অপরদিকে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সরকার একটি প্রতিষ্ঠান বা খাতের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রশাসন পরিচালনা করে। এটি সাধারণত সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান বা খাতটির স্থায়িত্ব ও কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। প্রশাসকেরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করায় সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া যায়। সংকটকালে বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয় প্রয়োজন হয় এবং প্রশাসকেরা এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসরণ করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে রিসিভার নিয়োগ মূলত অর্থনৈতিক সংকটে পড়া বা দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কায় থাকা কোম্পানিগুলোর জন্য করা হয়। রিসিভার কোম্পানিটির সম্পদ ও দায় পরিচালনার জন্য দায়ী হন এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য করণীয় পদক্ষেপ নেন। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দেউলিয়া না হয় এবং তাদের সম্পদ বিক্রি না করতে হয় সেজন্য রিসিভার কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির ঋণদাতাদের স্বার্থরক্ষা করা এবং প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দায়-দায়িত্বের সঙ্গে পরিচালনাও সহজ হয়। রিসিভার তার অধীন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয়করণ, প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সংকটের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। এতে কর্মীদের চাকরি সুরক্ষিত হয় এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে জনসেবা অব্যাহত রাখাও সহজতর হয়। তবে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয়করণ, প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ এবং কার্যক্রম পরিচালিত না হলে এই উদ্যোগ হিতে বিপরীতও হতে পারে। এর কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো দক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়। সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসক বা রিসিভাররা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে সরকারি নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে প্রতিফলিত হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে। প্রশাসকরা সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং তাদের লক্ষ্য থাকে স্বল্পমেয়াদি ফলাফলের দিকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া নিয়মিত প্রশাসক পরিবর্তনের ফলে প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের স্থায়িত্ব থাকে না, যা কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি এবং কাজের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। জাতীয় বা অর্থনৈতিক সংকটের সময় জাতীয়করণ, প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগ আর্থিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর উপায় হতে পারে। কিন্তু এটি অর্থনীতির ওপর অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের এখন পর্যন্ত নেওয়া এ সংক্রান্ত উদ্যোগগুলো যথেষ্ট যৌক্তিক হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি খাত যেন বাধার মুখে না পড়ে এবং ভিন্ন কোনো বার্তা না যায় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা, সততা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে অনেক বিপরীত কার্যক্রম সামনে চলে আসে। বিশেষ করে চিকিৎসাক্ষেত্রে নানা অনিয়ম যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসালয়ে ছাত্র আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের লক্ষ্যে ১০ নির্দেশনা জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যথাযথ নির্দেশনা আইনানুগভাবে প্রয়োগ করাও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়মের অধীন করা হয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের বিভিন্ন প্রতিনিধি যেভাবে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশের মাধ্যমে বাণিজ্যিক তৎপরতা চালান তা মোটেও শোভন নয়। তাছাড়া সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নই শুধু নয়, সংশ্লিষ্টদের সেবাদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাও সময়ের ন্যায্যতা। ১০ নির্দেশনার কোনোটির ব্যত্যয় ঘটলে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পিছু হটবে না। শুধু ছাত্র আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবাও অনিবার্য। বিবেচনায় রাখতে হবে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় গাফিলতি পর্যায়ে ঠেকলে তাও যথাযথ বিধানে সমাধান নিতান্ত জরুরি। আহত শিক্ষার্থীরা যদি চিকিৎসায় অর্থ প্রদানে অসমর্থ হন তার ব্যয়ভারও বিনামূল্যে করার কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও একই নির্দেশনা পালন করে যাবে। আহতরা ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় নিজেদের সুস্থ করে তোলার দাবিও নির্দেশনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওষুধের খরচ থেকে যাবতীয় আনুষঙ্গিক ব্যয়ভারও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপরই বর্তায়, যা উপর্যুক্ত ‘বিল ভাউচার’ তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। আহত শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোও প্রয়োজনীয় অন্যতম নির্দেশনা। সেখানে সার্বিক অর্থের জোগান দেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তার জন্য প্রয়োজনে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। বোর্ডের দায়িত্ব হবে উপর্যুক্ত রেকর্ডপত্রসহ সংশ্লিষ্ট আহত রোগীর আবেদনপত্র জমা দেওয়া। সব প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড নিয়মানুগভাবেই করা বাঞ্ছনীয়। আরও বলা হয়, প্রতিটি হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট আহত শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে অভ্যর্থনা কেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখাও রোগীর স্বার্থে জরুরি, যাতে হয়রানি কিংবা গাফিলতির শিকার হতে না হয়। আহত শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসাসেবায় যেন কোনো ব্যত্যয় না হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। শুধু অভ্যর্থনা কক্ষ নয়, বরং টিকিট কাটার নিয়মানুগ ব্যবস্থা থাকাও আহত রোগীদের জন্য জরুরি, যা তাদের অসুস্থ শরীরে কোনো ধরনের বিপন্নতা তৈরি করতে না পারে। সরাসরি উপস্থিতি ছাড়াও টিকিট করতে প্রযুক্তির সেবা নিশ্চিতের নির্দেশনা আসে। নিবন্ধিত আহত রোগী ছাড়া অন্য কাউকে সেবা দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে না নির্দেশনায় এমন বিধিও রাখা হয়। তার জন্য নজরদারি করতে হবে খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই। ছাত্র আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের যাতে চিকিৎসায় কোনো প্রকার বেগ পেতে না হয় এই প্রত্যাশা।

শান্তি ও সম্প্রীতির প্রত্যাশা

শান্তি ও সম্প্রীতির প্রত্যাশা

চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে যে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তাতে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নাকচ হলে তার অনুসারীরা সেখানকার আইনজীবী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। আদালত ভবনের মূল ফটকের সামনে রঙ্গম সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকায় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা এই হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই। বুধবার নিহত আইনজীবীর জানাজায় শোকার্ত মানুষের ঢল দেখে বোঝা যায় এ ঘটনায় মানুষ কতটা ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। মানুষ নানাভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আদালত ভবনে বিক্ষোভের ঘটনায় ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের নাম ফের আলোচনায় এসেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রত্যাশিত ছিল। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন আইনজীবী এভাবে নৃশংসভাবে খুন হবেন এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আছে। আদালত তার জামিনের আবেদন নাকচ করেছেন। এই আদেশে তার অনুসারীরা সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারতেন। কিন্তু সেসব না করে বিক্ষোভের নামে পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। এটি কোনোভাবে কাম্য ছিল না। আইনজীবী হত্যার পর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। ইসকন নিষিদ্ধ করারও দাবি উঠেছে। আমাদের প্রত্যাশা, শান্তিপূর্ণভাবে এসব কর্মসূচি পালিত হবে; হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন এবং হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও রাজনৈতিক দলগুলো আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশবাসীকে শান্ত থাকার ও ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত আটজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।   আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড শুধু নির্মমতা নয়, মানবসমাজের জন্য কলঙ্কজনক এক ঘটনা। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আমাদের আর দেখতে না হয় সে জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমাজজীবন থেকে মানবতা ও সহমর্মিতার বোধ একেবারে নির্বাসিত হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা নতুন নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রধানত শাসকদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতির প্রভাবে প্রায় সমগ্র ভারতেই মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস, অনৈক্য, এমনকি প্রাণঘাতী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ ও ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও সে অভিশাপ থেকে জাতির মুক্তিলাভ ঘটেনি। এটি দুঃখজনক। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদাসতর্ক থাকবে এবং সর্বস্তরের মানুষও এ ব্যাপারে সচেতন থাকবে, যেন কোনো অসাধু গোষ্ঠী পরিস্থিতির সুযোগ না নিতে পারে। যে কোনো মূল্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা চাই।