ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সাংবাদিক আগে মানুষ, পরে সাংবাদিক

প্রকাশিত: ২১:২৩, ২৭ আগস্ট ২০২২

সাংবাদিক আগে মানুষ, পরে সাংবাদিক

এক শিশুকে উদ্ধারের চেষ্টা সাংবাদিকের।

সাংবাদিকতার সংজ্ঞা কী? কেউ বলবেন কলম-ক্যামেরার পেশাদারিত্ব। কেউ বলবেন সাংবাদিকতা আসলে পাবলিক সার্ভিস। সংবাদপত্রের জন্মলগ্ন থেকেই এই দ্বন্দ ছিল। ব্যবসায়িক স্বার্থ মাথায় নিয়েই কর্ম অতিবাহিত করবেন একজন সাংবাদিক, নাকি জনগণের জন্য কাজ করবেন তিনি? উত্তর আজও মেলেনি! বরং এই দুইয়ের দ্বন্দকে কাঁধে নিয়েই যুগের পর যুগ বয়স বেড়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম গণমাধ্যমের। 

'বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল', এই মন্ত্র পাঠ করে কোনো সংবাদকর্মী সাংবাদিকতার পেশায় আসেন না, বরং পেটের দায়েই পেশা। তাহলে কী প্যাশন নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'কর্পোরেট কালচারে' পাবলিক সার্ভিস রোলের বদলে একজন পেশাদার সাংবাদিক হয়ে ওঠেন 'উন্নত মানের চাকর'। যে যত বেশি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন, যে যত বেশি করে নিজের মনের মানুষকে খুন করতে পেরেছেন তিনিই হয়ে উঠেছেন শ্রেষ্ঠ। আধুনিকালে এমনটাই হয়ে আসছে। তবে বহমান স্রোতের উল্টো দিকে কেউ না কেউ কখনও না কখনও সাঁতার কেটেছেন, এখনও সাঁতরে যান তারা। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম থাকেই। আর এই ব্যতিক্রমরাই হয়ে ওঠেন উদাহরণ, তারাই হন 'পথ প্রদর্শক'।  

মনুষত্ব ও সাংবাদিকতার মধ্যেকার প্রকট দ্বন্দে 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই', এই অনুভব আবারও ফিরে এলো। ফিরে এলো এক আলোক চিত্রগ্রাহকের হাত ধরে।    

একবিংশ শতকের এমনই এক ব্যতিক্রম আলোক চিত্রগ্রাহকের কথাই বলব এই প্রতিবেদনে। এখন যে সিরিয়ার কথা বলছি সেখানে আপনি পৌঁছে যাবেন এক পলকেই। একটা জ্বলন্ত অগ্নি গোলক। নিমিষে শেষ হয়ে যাচ্ছে শত শত প্রাণ। একদিকে গৃহযুদ্ধ অন্যদিকে শরণার্থী সমস্যা। সিরিয়া বেঁচে আছে 'আইসিইউ' বেডে। রক্তক্ষরণ ঠেকাতে পারছে না কেউই। যে মরে মরুক, আগে নিজে তো বাঁচি এটাই এখন সিরিয়া। এই সিরিয়াই সাক্ষ্মী থাকল জীবন বাঁচানো সাংবাদিকতার। ক্যামেরা কাঁধেই রয়েছে, আঙুলটা কেবল শাটারে নেই, কোলে এক শিশু নিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছেন এক সাংবাদিক। জীবন বাঁচানোর পেশায় নিয়োজিত এই সাংবাদিক সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং হয়েছিলেন। বাজারের ভাষায় লোকে পড়ছে, দেখছে, গিলছে আর খাচ্ছে। 

সন্ত্রাসের খবর সংগ্রহ করতে সিরিয়ার শরীর বেয়ে অনবরত দৌঁড়াচ্ছেন আলোক চিত্রগ্রাহক আলকাদের হাবাক। এদিনও এমন ঘটনার ছবি সংগ্রহ করতে বেড়িয়েছিলেন তিনি। বম্ব ব্লাস্ট। একটা গোটা বাস দাউ দাউ জ্বলছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ১২৬টি মৃত দেহ, যার মধ্যে ৮০টি দেহ শিশু। ক্যামেরা চলছে। এক একটা ক্লিক সাক্ষ্মী থাকছে 'মৃত্যু উপত্যকার'। প্রাণ কই? হঠাৎ এক মৃদু ক্রন্দনে যেন মরুভূমিতে চির হরিতের সন্ধান! হ্যাঁ, একটা জীবনের আওয়াজ পেয়েই ছুটে যান চিত্রগ্রাহক আলকাদের হাবাক। 

ক্ষত বিক্ষত শরীরে তখনও হৃদ স্পন্দন আছে শিশুর। কী করবেন তিনি এবার? খবর সংগ্রহ করবেন না জীবন? কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, জীবনের জন্য জীবন বাছলেন তিনি। ক্যামেরা কাঁধেই, কোলে তুলে নিলেন মৃতপ্রায় শিশুকে। নিয়ে এলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। এবার ফিরলেন অগ্নি গোলকে। আরও এক শিশু... না বাঁচাতে পারলেন না। ক্যামেরা কাঁধেই রইল, হাতগুলো পৌঁছে গেল ভেজা চোখে। সেদিন মেঘ ছিল না আকাশে তবুও বৃষ্টি হল। বৃষ্টি হল চোখে। আর এই ছবিই ধরা পড়ল আরেক সাংবাদিকের ক্যামেরায়। 

"সেই দৃশ্য ছিল ভীষণ ভয়াল। আমি দেখছিলাম, আমার চোখের সামনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট প্রাণ। ওই শিশু আমার আঙুল ছুঁয়ে ছিল আর আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি আর আমার সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যামেরাকে সরিয়ে রেখে এখন মৃতপ্রায় প্রাণগুলোকে বাঁচাতে হবে, তারপর সেটাই করলাম", সিএনএন কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই জানালেন চিত্রগ্রাহক আলকাদের হাবাক। 

আর যিনি এই ছবি তুললেন সেই চিত্রগ্রাহক মহম্মদ আলরাজিব বলছেন, ‘আমি সব কিছু ক্যামেরা বন্দি করতে চেয়েছিলাম, একজন নবীন সাংবাদিক জীবন বাঁচাতে উদ্যত হয়েছেন, এই ঘটনা আমাকে গর্বিত করেছে’। আর এভাবেই নির্মিত হল সাংবাদিকাতার 'মানবিক সংজ্ঞা'।   

লেখক: সৌরভ পাল। সূত্র: জি নিউজ। 

×