
ছবি: জনকণ্ঠ
জেলা পরিষদের অধীনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সকল স্থানীয় সরকারের মতো একটি সমন্বিত ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। সকল স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থাসহ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি এবং নারীদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংসদীয় ব্যবস্থার অনুরূপ করতে গিয়ে ‘নির্বাহী কাউন্সিল’, ‘সভাধ্যক্ষ’, ‘ছায়া পরিষদ/কাউন্সিল নেতা’ নির্বাচনের যে প্রস্তাব করেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবতা এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এখানেও কয়েকটি পক্ষ তৈরি হয়ে একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে এবং ভোট কেনা-বেচার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার আশংকা রয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ঢাকার হোটেল বেঙ্গল ব্লুবেরিতে গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে স্থানীয় সরকার সংস্কার’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব বলেন।
মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ে ফোরামের বক্তব্য উপস্থাপন গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সদস্য ও এনআরডিএস’র নির্বাহী পরিচালক আবদুল আউয়ালের ও সঞ্চালনায় এতে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রাশেদা বেগম হীরা; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি; এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া; বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন; সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন; জাতীয় নাগরিক পার্টিও যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান; বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা প্রমুখ। এছাড়া প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মহসিন আলী বলেন, ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর প্রদান করেছেন এর প্রধান ৫১টি সুপারিশের মধ্যে ২৫টি সুপারিশ গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সুপারিশগুলোর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ অথবা যেগুলোর সাথে একমত/আংশিকভাবে একমত পোষণ করা যায়। স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অধিদপ্তর, সেবা ইত্যাদি বিষয়ক ২৩টি সুপারিশ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আরো অংশীজনদের নিয়ে পর্যালোচনার পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
৩টি সুপারিশের কিছু বিষয় যেমন- স্থানীয় সরকারের গঠন-কাঠামো; পরিষদের সদস্য; জেলা পরিষদ: নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে ফোরামের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্দলীয় নির্বাচনের সুপারিশ করে আবার ছায়া পরিষদ নেতা নির্বাচনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা কি শুধু আলঙ্কারিক পদ তৈরির জন্য? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিষদে ‘অবৈতনিক সদস্য’ কতটা বাস্তবসম্মত তা ভেবে দেখতে হবে। স্থানীয় সরকারকে একই কাঠামোর অধীনে আনতে হলে আলাদা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তা কি আছে? সংসদীয় পদ্ধতির আদলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে ভঙ্গুর পরিষদ তৈরি হতে পারে। গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সংস্কার প্রস্তাবের বিশেষ দিক হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন:
জেলার সামগ্রিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান এবং জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সেবা প্রদানকারী দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে ‘জেলা পরিষদ কার্যালয়ে রূপান্তর’ করা। এক্ষেত্রে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা জেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন একজন জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা; বিদ্যমান জেলা পরিষদকে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে যুব ও নারীদের উদ্যোক্তা/ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি মার্কেটিংয়ের জন্য সহায়তা প্রদান করা।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলের রাশেদা বেগম হীরা বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আমলাদের প্রভু মনে না করে নির্বাচিত প্ররিতনিধিদের গুরুত্ব দিতে হবে আগে। ফলে জেলা পরিষদের অধীনে জেলা প্রশাসককে কাজ করার বিষয়টি দেরিতে হলেও বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। সাম্যতার ভিত্তিতে নারীদের জন্য স্থানীয় সরকারেও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে আমরা এখনও বের হতে পারিনি। ফলে ডিসি, ইউএনওদেরকে আমরা স্যার ডাকি। আমাদের দলের পক্ষ থেকে যে ১৬ দফা সুপারিশ দেয়া হয়েছে কমিশনের কাছে সেখানেও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করার কথা বলেছি আমরা। প্রতীক ও দলীয় নির্বাচন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন চাইলে পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, ক্ষমতার দিক থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কতটুকু এগিয়ে নেয়া যায় সেটিই এখন ভাবার বিষয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কঠিন হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থার আদলে জেলা সরকারকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তা ভাবতে হবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু বলেন, আমাদের সংস্কার যেমন প্রয়োজন তেমনি আমাদের মানসিকবাবে পরিবর্তন আনতে হবে স্থানীয় সরকার সংস্কারের ক্ষেত্রেও। তিনি ফোরামের জেলা পরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, স্থানীয় সরকারের পদগুলো যেন বিপজ্জনক না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে বার্ষিক পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। জনগণকে অবহিত করার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।
সিপিবি’র আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, আমাদের ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও বহাল রয়ে গেছে। ব্রিটিশ আইনগুলো দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে যেখানে আমাদের নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। সকল স্তরেই ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ঘটাতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির সারোয়ার তুষার বলেন, সরকারের সংস্কার সংক্রান্ত আলোচনায় স্থানীয় সরকার সংস্কার এজেন্ডা হিসেবে আসছে না। অথচ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনসহ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আরো জটিলতা তৈরি করতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা ও মনিটরিং বাড়িয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য এনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে প্রয়োজন। অতীতে দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত কোনো নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি। জাসদের নাজমুল হক প্রধান বলেন, স্থানীয়ভাবে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে তাদের কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করতে পারলে স্থানীয় পরিষেবা প্রাপ্তিতে নাগরিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাবে। উমামা ফাতেমা বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীরা এখনও পিছিয়ে আছে। তারা মুল স্্েরাতে এখনও পৌঁছায়নি। সংরক্ষণের মাধ্যমে রূপক অর্থে নারীদের না রেখে নারীদের কার্যকর ক্ষমতায়ন কীভাবে করা যায় তা ভাবতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাকিব হোসেন বলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাজ সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি।
দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কার্যত জাতীয় সরকারের সম্প্রসারিত অংশ। আমাদের জেলা সরকারের অধীনে সকল কিছু বাস্তবায়ন করতে হবে। রিকল ব্যবস্থা চালু করে আমদের স্থানীয় সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বিপ্লবী ওয়ার্কারস পার্টির মীর রেজাউল আলম বলেন, সকল কিছু কেন্দ্রীয়ভাবে না রেখে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সুবিধা বৃদ্ধি করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের ফেরদৗসী আখতার বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারী প্রতিনিধিদের সংখ্যায় না দেখিয়ে তাদেরকে কার্যকর ভ‚মিকায় নিয়ে আসতে হবে।
গণফোরামের এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষামতায়নের জন্য সবচেয়ে জরুরী নির্বাচন। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড করতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) মোমিনুল আমিন বলে, রাষ্ট্র সংস্কারে সকলের মতামত নিতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়িয়ে জনগণকে তাদের প্রাপ্য বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
শিহাব