
.
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম পবিত্র হজ ফ্লাইট শুরু হচ্ছে আগামী মঙ্গলবার। এদিন ভোর তিনটায় ঢাকা ছেড়ে যাবে বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইট। তাতে থাকবেন ৪১৯ হজযাত্রী। ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে বিদায় জানাবেন প্রথম ফ্লাইটে আল্লাহর মেহমানদের। এবার মোট ৮৭ হাজার ১০০ জন পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব যাবেন। তাদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫ হাজার ২০০ ও বাকি ৮১ হাজার ৯০০ জন যাবেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করবেন। প্রতিবারের মতো এ বছরও সঠিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি গাইড ১১২ জন ও বেসরকারি গাইড থাকবেন ১ হাজার ৭৪৩ জন। ৭০ মোয়াল্লেম হজযাত্রীদের সার্বিক সহযোগিতায় রাখা হয়েছে। তাদের পরিবহনে বিমান বাংলাদেশসহ তিনটি এয়ারলাইন্স প্রস্তুত। ৩১ মে হজের শেষ ফ্লাইট সৌদি আরব যাবে। ফিরতি ফ্লাইট ১০ জুন শুরু হয়ে শেষ হবে ১০ জুলাই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ১১৮, সাউদিয়া ৮০ ও নাস এয়ারলাইন্সের ৩৪ ফ্লাইটে যাত্রীরা সৌদি আরব যাবেন। বিমান ১০৯, সাউদিয়া ৭৯ ও নাস ৩৪টি ফিরতি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। আগামীকাল হজের ফ্লাইট শুরু হলেও আজকের মধ্যেই তাদের আশকোনা হজ অফিসে রিপোর্ট করতে হবে। প্রথম ফ্লাইটের হজযাত্রী রবিবারই হজ ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইমাম কারি জাহাঙ্গীর । তিনি তাদের হজের প্রশিক্ষণ দেন রবিবার দিনভর। আজ সন্ধ্যায় ধর্মউপদেষ্টা হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন।
এদিকে হজ পালন আরও নির্বিঘ্ন ও সহজ করতে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘লাব্বাইক’ নামে মোবাইল অ্যাপ চালু করছে সরকার। এবার হজযাত্রীদের জন্য হজ প্রিপেইড কার্ড চালু ও মোবাইল ফোনে রোমিং সুবিধা দেওয়া হবে। আজ সোমবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বাসভবন যমুনায় হজযাত্রীদের এ এ্যাপসের উদ্বোধন করবেন। ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) যাচাইর পর ৪ ডিজিটের পিন সেট করতে হবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় হজযাত্রীর মোবাইল নম্বর, পিআইডি (পিলগ্রিম আইডি) ও জন্ম তারিখ প্রয়োজন হবে। একজন হজযাত্রী তার পরিবারের সর্বোচ্চ ৩ জন সদস্যকে ইনভাইটেশন পাঠিয়ে অ্যাপে যুক্ত করতে পারবেন।
পরিবারের সদস্যের নাম ও মোবাইল নম্বর দিয়ে ইনভাইটেশন পাঠালে ওই সদস্য তার মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার পর তারা হজযাত্রীর তথ্য জানতে পারবেন। এছাড়াও গেস্ট ইউজার হিসেবেও রেজিস্ট্রেশন করা যাবে।
এ অ্যাপসের সুবিধা সম্পর্কে হজ অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোনো হজযাত্রী হারিয়ে গেলে বা গুরুতর অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে জরুরি মুহূর্তে অ্যাপ থেকে এসওএস (সেভ আওয়ার সোলস) বাটনে ক্লিক করলে সাপোর্ট টিম যাত্রীকে উদ্ধার বা সহায়তা করবেন। অ্যাপের মাধ্যমে নামাজের সময়সূচি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা যাবে। হজযাত্রী ফ্লাইটের বিস্তারিত তথ্য যেমন ফ্লাইট কোড, বোর্ডিং টাইম, ডিপারচার ও অ্যারাইভাল টাইম, লাগেজের ওজনসীমা ইত্যাদি জানতে পারবেন। লোকেশন ট্র্যাকিং যেমন হজযাত্রী গুগল ম্যাপে নিজেদের বা দলের অন্যান্য সদস্যের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে। এছাড়া আবাসন তথ্য যেমন- হোটেলের নাম, ঠিকানা, দূরত্ব, ছবি, ভিডিও, চেক-ইন/চেক-আউট তারিখ ইত্যাদি অ্যাপ থেকে জানা যাবে। পরিবারের সদস্যরা তাদের হজযাত্রীকে ট্র্যাকিং করতে পারবেন। মিনা-আরাফার তাঁবুর লোকেশন ট্র্যাকিং, হজ প্রিপেইড কার্ডের ব্যালেন্স, ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রোফাইল তথ্য ও সার্বক্ষণিক ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহায়তা; বাংলাদেশ মেডিক্যাল সেন্টার ও সৌদি হাসপাতালের তথ্য; গাইডভিত্তিক গ্রুপ যোগাযোগ সুবিধা; কুরআন ও হাদিস লাইব্রেরি, কিবলা নির্দেশনা, ডিজিটাল তাসবিহ, হজ ও উমরাহ সহায়িকা; কোরবানি কুপন সংগ্রহ কেন্দ্রের তালিকা; মক্কা ও মদিনার ঐতিহাসিক স্থানের বিবরণ; হজ এজেন্সির তথ্য যেমন এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর, প্যাকেজ, রেটিং, রিভিউ প্রদান ইত্যাদি সেবা অ্যাপে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অ্যাপটি হজ ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, হজ প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করতে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন নেই। কার্ডের মেয়াদ ৫ বছর। এটি ক্যাশের পরিপূরক সুবিধা। তৎক্ষণাৎ কার্ড ইস্যু ও ডেলিভারি হবে। কার্ড ইস্যুতে কোনো চার্জ বা ফি নেই।
লেনদেন প্রসেস ফি ৩ শতাংশের স্থলে ১ শতাংশ। হজ পরবর্তী সময়েও এ কার্ড ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশী টাকা লোড করে ডলার বা সৌদি রিয়াল পাওয়া যাবে। প্রত্যেক হজযাত্রী এক হাজার ২০০ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা কার্ডে লোড করে নিতে পারবেন।
সৌদি আরবে মাস্টার কার্ড লোগোযুক্ত এটিএম বুথ থেকে নগদ সৌদি রিয়াল উত্তোলন এবং পিওএস (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিনে পেমেন্ট সুবিধা, কার্ডে ব্যালেন্স রি-লোড এবং অব্যবহৃত ব্যালেন্স রিফান্ড সুবিধা পাওয়া যাবে এ কার্ডের মাধ্যমে।
ইসলামী ব্যাংকের সব শাখা থেকে এ কার্ড পাওয়া যাবে। এজন্য মূল পাসপোর্ট/ পাসপোর্টের ফটোকপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, ২ কপি ছবি, হজ ভিসার কপি, সচল মোবাইল নম্বর লাগবে। তথ্য জানার জন্য দেশ থেকে ১৬২৫৯ এবং ০২-৮৩৩১০৯০ কল সেন্টার, ইসলামী ব্যাংকের যে কোনো শাখায় যোগাযোগ করা যাবে। বিদেশ থেকে +৮৮০১৮৪৪২৪২৬৪৬, +৮৮০১৮১৩১৯৭৯১৫ হোয়াটস অ্যাপ নম্বর এবং +৮৮০৯৬১১০১৬২৫৯ কল সেন্টার নাম্বারে যোগাযোগ করতে হবে।
জানা গেছে- এবারের হজে হজযাত্রীদের জন্য ‘গ্রামীণফোন’, ‘বাংলালিংক’ ও ‘রবি’ বিশেষ ফোন রোমিং প্যাকেজ চাল করেছে। রোমিং প্যাকেজের হজযাত্রীরা সৌদি আরবে মোবাইল সিম কেনা ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিজস্ব মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতে ও বার্তা পাঠাতে পারবে। হজ রোমিং প্যাকেজগুলো সৌদি মোবাইল অপারেটরগুলোর রেটের তুলনায় সাশ্রয়ী। হজযাত্রীরা প্রচলিত পেমেন্ট গেটওয়ে বা অপারেটরদের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে দেশীয় মুদ্রায় সহজেই ১ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের প্যাকেজ ক্রয় ও অ্যাক্টিভেট করতে পারবেন। প্যাকেজ মূল্যের চেয়ে কম অথবা বেশি টাকা রিচার্জ করলে প্যাকেজ অ্যাক্টিভেট হবে না।
বিস্তারিত জানতে নিজস্ব মোবাইল অপারেটরের কল সেন্টার/কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে হজযাত্রীদের জন্য গ্রামীণফোন ছয়টি, রবির তিনটি, বাংলালিংক পাঁচটি স্পেশাল রোমিং প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। গ্রামীণফোনের প্যাকেজগুলো কেনার দিন থেকেই সক্রিয় হবে। বাংলালিংকের প্যাকেজ হজযাত্রীরা সৌদি আরব পৌঁছালে সক্রিয় হবে। বাংলালিংকের পোস্টপেইড গ্রাহকরা রোমিং ভয়েস কল সুবিধা পাবেন না।
এদিকে বিমান জানিয়েছে, এবারও হজের সেবা নিশ্চিত করতে হজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে যোগ্যতার নিরিখে। সব ধরনের বিতর্ক এড়াতে পেশাদার যোগ্য ও অধিকতর ন্যায়নিষ্ঠাবান জনবল বাছাই করা হয়েছে সৌদি আরবে পাঠানোর জন্য।
প্রশিক্ষণ অনিবার্য ॥ এদিকে বাংলাদেশ থেকে যারা হজে যান, তাদের অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিয়ে যাওয়া উচিত বলে ঢাকায় এক সেমিনারে জোর দিয়েছেন বক্তারা। তাদের মতে, প্রশিক্ষণ না থাকায় সেখানে গিয়ে তারা নানা ধরনের জটিলতায় পরেন এবং হজ সঠিকভাবে পালন হয় না। এছাড়া হজের প্রক্রিয়া যেহেতু বছরব্যাপী হয়ে থাকে, তাই এই প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন করতে বাংলাদেশে একটি হজ অধিদপ্তর গঠন করতে হবে।
রবিবার দৈনিক সময়ের আলোর কনফারেন্স রুমে ‘সময়ের আলো গোলটেবিল: হজ ২০২৫ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন ইসলামিক স্কলার্স ও হজ এজেন্সির মালিকরা। গোলটেবিল বৈঠকে হজ প্রশিক্ষক গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ রাহমানী বলেন, হজ এজেন্সিগুলোর প্রতি অভিযোগ নেই, এমন সংখ্যা খুবই কম। হজ এজেন্সিগুলোর উচিত যারা হজ করতে যান, তাদের মানসিক বিষয়টি খেয়াল রাখা। হজের প্রত্যেকটি বিষয় তাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। যারা হজ করতে যান, তাদের মামলাগুলো জেনে যেতে হবে। অনেকেই তা জানেন না। তিনি প্রস্তাব রেখে বলেন, সরকার ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) তত্ত্বাবধানে যারা হজ করতে যাবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের মানসিক বিষয়গুলো প্রস্তুত করতে হবে। তারা যতক্ষণ না পর্যন্ত মানসিকভাবে প্রস্তুত হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ করতেন ৯ দিন। কিন্তু আমাদের এখান থেকে হজ করতে যান ৪৩ দিন ধরে। কিন্তু তারা এটা পারেন না। এটা ২০ দিনে করা যায় কিনা বিষয়টি দেখতে হবে। তাদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করা এবং সেখান থেকে তাদের সার্টিফিকেট দিতে হবে।
আলওয়াসি হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল গাফফার খান বলেন, হাজিরা জানেন না, কীভাবে হজ করতে হয়। তারা এজেন্সিদের টাকা দিয়ে খালাস হয়ে যান। কিন্তু তাদেরও অনেক দায়িত্ব আছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, যখন সরকারিভাবে হজ প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তখন প্রশিক্ষকদের সময় দেওয়া হয় মাত্র দুই মিনিট। আর পুরো প্রোগ্রামজুড়ে শুধু হয় রাজনীতির আলোচনা।
শেফার্ডস হজ অ্যান্ড ওমরাহ সার্ভিসেসের ম্যানেজিং পার্টনার আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ বলেন, হজ শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যেই সৌদি থেকে চিঠি পাঠায়। কিন্তু সেই চিঠি আয়োজেন করে আমাদের কাছে আসতে সময় লাগে। আমরা চাই, চিঠি পাওয়া মাত্র যেন আমাদের জানানো হয়। এতে করে পরবর্তী হজের প্রস্তুতি নিতে আমাদের সমস্যা হবে না।
গোলটেবিল বৈঠকে স্কলার আলেম মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল এহসান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হজের দায়িত্ব দেওয়া হলে ৯০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যারা খুব ভালো আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন, তাদের সৌদি আরবে বাংলা টিমে রাখা গেলে হজের সময় হাজীদের জন্য ভালো হবে। সেখানে বাংলাদেশের যে টিম থাকে, তারা অনেকটা দুর্বল। তাদের খুঁজে পাওযাা যায় না।
প্যানেল