ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২

পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা নিয়ে বিশ্লেষকদের অভিমত

বাণিজ্যে প্রভাব পড়ার শঙ্কা

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

বাণিজ্যে প্রভাব পড়ার শঙ্কা

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পরিস্থিতি দিন দিন আক্রমণাত্মক

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পরিস্থিতি দিন দিন আক্রমণাত্মক আকার ধারণ করছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশ দুটিতে যুদ্ধ শুরু হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। 
তারা বলছেন, প্রভাব এড়াতে ঢাকাকে এখনই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, পুরো পরিস্থিতির ওপর আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে- আঞ্চলিক নিরাপত্তা, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু।
তারা আরও বলছেন, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে কোনো বক্তব্য বুঝে-শুনে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সাইবার যুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এড়াতে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিগত সরকারের আমলে ভালো সম্পর্ক থাকলেও বর্তমানে সংকট যাচ্ছে। অপরদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ দেড়যুগ পরে শুরু হওয়া সম্পর্ক উন্নতির দিকে যাচ্ছে। চলতি মাসে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করেছেন। সফরে উভয় দেশের ফরেন অফিসার কনসালটেন্সি (এফওসি) হয়েছে। সেখানে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাকভারত উত্তেজনায় সে ইস্যুগুলোর সমাধান অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বড় রকমের কোনো সমস্যা হলে প্রকৃতিগতভাবেই সে উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক থাকলে বর্তমানে সরকারের সম্পর্ক আর নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক স্থবিরতায় রয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে কোনো দেশই তা স্বীকার করছে না।

এমতাবস্থায় যুদ্ধে লিপ্ত হলে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না সেটা বলা বাহুল্য। অপরদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিকসহ সকল প্রকার যোগাযোগ উন্নত করতে চাচ্ছে যা প্রতিবেশী দেশ সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। যার একটি প্রভাব যুদ্ধে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, কাশ্মীর ইস্যু দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। সীমান্তে  হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না। তবে যুদ্ধে জড়ালে বাংলাদেশেও যুদ্ধের প্রভাব পড়বে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানের যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বড় শঙ্কার কারণ না হলেও উদ্বেগের। কেননা পরমাণু শক্তির অধিকারী দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সম্ভাব্য তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশ বড় অঙ্কের পণ্য আমদানি করে। সে দেশে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম। ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। সে দেশে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে বাংলাদেশের ৪০ বছর লেগেছিল। পরের ৭ বছরে দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যদি সামরিক খাতে বেশি মনোযোগী হয়, তাহলে তাদের বাণিজ্য প্রভাবিত হতে পারে, যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) মুনরিুজ্জামান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে শান্তি বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে দুটি দেশের মধ্যে বর্তমানে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তাদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস আছে। তারা দুটি বৃহৎ সামরিক শক্তি এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। কাজেই পুরো পরিস্থিতির ওপর আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ খুব দ্রুত অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের দেখতে হবে যে কি কি ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে। তবে আমাদের প্রত্যাশা এই অঞ্চলে যেন কোনোভাবেই শান্তি বিঘিœত না হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত যে পর্যায়ে আছে, তাতে করে ‘এ কাইন্ড অব প্রক্সি ওয়ার’র দিকেই সম্ভবত যাচ্ছে। দুটো দেশের প্রক্সি ওয়ারের মধ্যে আমরা যেন অযথা জড়িয়ে না পড়ি।
তিনি আরও বলেন, যখন বিবৃতি বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে অভ্যন্তরীণভাবে বা কোনো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তখন এই কথাটা মনে রাখতে হবে-আমরা ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে এমনিতেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার উত্তেজনা এই সংকটকে আরও প্রভাবিত করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের যে গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তাদের এই বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজর রাখা দরকার বলেও মনে করেন তারা।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তিনদিনের উত্তেজনা পরিস্থিতিতে ভারতের গুজরাটে ইতোমধ্যে ৫০০ বাংলাদেশী আটক হয়েছে। 
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ দেড়যুগ পর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সর্ব্বোচ কূটনৈতিক সফর হয়েছে। সম্পর্ক উন্নয়নে দুটি দেশের যে পথ সূচনা হয়েছে সেটির ঘাটতি হবে না। দু’দেশের আলোচনার ভিত্তিতে নতুন তারিখ নির্ধারিত হবে বলেই তাদের ধারণা। 
২৭-২৮ এপ্রিল পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর আপাতত স্থগিত করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান হাইকমিশন জানিয়েছে, বর্তমান পারিপাশির্^ক উত্তেজনার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর আপাতত স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। পরবর্তীতে দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে সুবিধাজনক সময়ে সফরসূচি নির্ধারিত হবে বলেও উল্লেখ করে দেশটি। এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পারিপার্শ্বিক উত্তেজনার জের ধরে বাংলাদেশে সফর স্থগিত করেছে ইসলামাবাদ। যথাশীঘ্র দু’দেশের আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত হবে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, দেড় দশক পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরের পর যখন দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করছিল ঠিক এর তিনদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি স্থগিত করা হলো।
এ বিষয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সফর স্থগিত করার জন্য বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। দুটি দেশের উত্তেজনার কারণে সফরটি স্থগিত করা হয়ছে। এটি তাদের সমস্যার কারণেই তারা স্থগিত করেছে। বাংলাদেশের কোনো সমস্যা বা ইস্যুর কারণে সফর স্থগিত করা হয়নি।
তিনি বলেন, আমি জানি না তবে আমার মনে হচ্ছে দুটি দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সফরটি স্থগিত রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে আবারও আলোচনা মাধ্যমে সফর শুরু হবে।
প্রতিবেশী দেশের উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উত্তেজনার জন্য বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না। তবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ আক্রান্ত হবে। 
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, যুদ্ধ হওয়ার সম্ভবনা কম। সীমান্তে হয়ত কিছু সমস্যা হতে পারে, সেটা বড় আকারে হবে বলে মনে হয় না।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাতে কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত সরকার এ হামলার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপায়। যদিও পাকিস্তান এ হামলার সঙ্গে জড়িত নয় বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এই হামলার ফলশ্রুতিতে ভারতের মোদি সরকার পাকিস্তানের নাগরিকদের ভারত ত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদের পানি চুক্তি বাতিল করে। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সিমলা চুক্তি বাতিল ও পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান চলাচল বন্ধসহ আট পদক্ষেপ ঘোষণা করে।

×