
ছবি: সংগৃহীত
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পরিস্থিতি দিন দিন আক্রমণাত্মক আকার ধারণ করছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। আঞ্চলিক নিরাপত্তা, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে। যুদ্ধ শুরুর আগেই প্রতিবেশী দুই দেশ একে অপরকে জড়িয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিশেষ করে ভারত কাশ্মীরের ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করছে, তবে পাকিস্তান দাবি করছে এই হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
চলতি মাসের ২৭ তারিখে দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে পাকিস্তান সফর স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিগত সরকারের আমলে সম্পর্ক ভালো থাকলেও বর্তমানে তা সংকটে পড়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ দেড়যুগ পর সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে। চলতি মাসে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় এই ইস্যুগুলোর সমাধান অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের কোনো সমস্যা হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে, এটি স্বাভাবিক। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো থাকলেও বর্তমানে সম্পর্ক স্থবির। যদিও প্রকাশ্যে কোনো পক্ষই তা স্বীকার করছে না, তবে যুদ্ধ শুরু হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। অপরদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগ উন্নত করতে চাইছে, যা প্রতিবেশী দেশ সহজভাবে নাও নিতে পারে এবং এর একটি প্রভাব যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, "কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না, তবে যুদ্ধে জড়ালে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে।"
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়। যদিও এটি সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে না, তবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর এবং যুদ্ধাবস্থা সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশ বড় অংকের পণ্য আমদানি করে, যদিও রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলক কম। ভারতের বাজারে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। সেখানে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে ৪০ বছর লেগেছিল এবং পরবর্তী ৭ বছরে তা দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যদি সামরিক খাতে বেশি মনোযোগী হয়, তবে তাদের বাণিজ্য প্রভাবিত হতে পারে এবং এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের উত্তেজনা গোটা অঞ্চলকেই সংকটে ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশকে এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। পরিস্থিতির ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে কোনো বক্তব্য অত্যন্ত বুঝেশুনে দিতে হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সাইবার যুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রতিরোধে নজরদারি জোরদার করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনশি মুজ্জামান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস আছে এবং তারা দুটি বড় সামরিক ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তাই পরিস্থিতির ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে। তবে প্রত্যাশা করা যায়, এই অঞ্চলে যেন কোনোভাবেই শান্তি বিঘ্নিত না হয়।
অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত উত্তেজনা ‘প্রক্সি ওয়ার’-এর দিকেই যাচ্ছে। এই দুই দেশের প্রক্সি যুদ্ধে বাংলাদেশ যেন অযথা জড়িয়ে না পড়ে। অভ্যন্তরীণভাবে বা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য প্রদানের সময় ন্যায়ের ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়া এমনিতেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে এবং ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এই পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকতে হবে এবং ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখতে হবে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তিনদিনের উত্তেজনা চলাকালে ভারতের গুজরাটে ৫০০ জন বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ দেড়যুগ পরে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সফর হয়েছিল এবং সম্পর্ক উন্নয়নের যে পথ শুরু হয়েছিল, সেটি থেমে যাবে না। দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে নতুন সফরের তারিখ নির্ধারণ হবে।
২৭-২৮ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর আপাতত স্থগিত করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান হাইকমিশন জানিয়েছে, পারিপার্শ্বিক উত্তেজনার কারণে সফর স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে সুবিধাজনক সময়ে নতুন সফরসূচি নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই তথ্য জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, দেড় দশক পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফরের পর যখন দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করণীয় নির্ধারণ করছিল, তখনই তিনদিনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর স্থগিত করা হয়।
তৎকালীন সময়ে অমীমাংসিত কিছু ইস্যু এফওসি বৈঠকে উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের দুঃখ প্রকাশ, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ প্রদান, আটকে থাকা পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের সময় ঘূর্ণিঝড়ের জন্য দেওয়া বৈদেশিক সহায়তার পাওনা পরিশোধের দাবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়গুলো এসেছে। এগুলো পরবর্তীতে আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করা উচিত। যদিও রাজনৈতিক বিষয় থাকায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না, তবে বাংলাদেশ আশা করে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধান হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, উপস্থাপিত বিষয়গুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা ধীরগতিতে চলবে। চলতি মাসের শেষের দিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসার কথা পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের।
বাংলাদেশ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ফেরত আনার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, কেবল জনসংখ্যার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের ৫৬ শতাংশের অংশীদার ছিল। বিদেশি মুদ্রা অর্জনের দিক দিয়ে এই অংশ ৫৪ শতাংশ। এমনকি সমতার নীতি অনুসরণ করলেও বাংলাদেশ অন্তত ৫০ শতাংশ দাবি করতেই পারে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন একটি হিসাব করেছিল, যেখানে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ৯০ লাখ টাকা আটকে রেখেছিল। এছাড়াও রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ ১৪.০৭ কোটি টাকা, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঋণ ২.৭৭ কোটি টাকা, পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ঋণ ১.১৫ কোটি টাকা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইউনিট বিনিয়োগের বিপরীতে ইস্যু করা সঞ্চয়পত্রের ২.৪৬ কোটি টাকা এবং পাকিস্তানি প্রাইজ বন্ড সংক্রান্ত ৬.৫৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, সফর স্থগিত করায় বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেই সফর স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ইস্যুর জন্য নয়। তিনি আশা প্রকাশ করেন, পরবর্তীতে আলোচনা করে নতুন সফরের সময়সূচি নির্ধারিত হবে। উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশের সরাসরি ক্ষতি হবে না, তবে যদি যুদ্ধ হয় তাহলে বাংলাদেশও আক্রান্ত হতে পারে। তবে তার মতে, যুদ্ধের সম্ভাবনা কম। সীমান্তে কিছু সমস্যা হতে পারে, তবে তা বড় আকার ধারণ করবে বলে মনে হয় না।
এদিকে কাশ্মীরের পহেলগাঁও এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত সরকার পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করে। পাকিস্তান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এর জেরে ভারত পাকিস্তানের নাগরিকদের দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয় এবং সিন্ধু নদের পানি চুক্তি বাতিল করে। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সিমলা চুক্তি বাতিলসহ আটটি পদক্ষেপ ঘোষণা করে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের এই অবনতি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
এম.কে.