ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষে বিপ্লব

মনোয়ার হোসেন লিটন, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ১৩:৫৮, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষে বিপ্লব

ছবিঃ প্রতিবেদক

কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রহিম। নদী ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত আব্দুর রহিম ২৫ বছর আগে হলোখানা ইউনিয়ন থেকে বসতি গড়েছেন এখানে। চার ছেলেকে নিয়ে ছিলো অভাব অনটনের সংসার। ছেলেদের চাকরি না থাকায় কষ্ট করে এক ছেলেকে চার লক্ষ টাকা খরচ করে পাঠিয়েছিলেন বিদেশে।

প্রতারকের হাতে পরে নিঃস্ব হয়ে ছেলে ফিরে আসেন বাড়িতে। তারপর থেকে বিদেশ ফেরত ছেলের সঙ্গে শুরু করেন ফসল উৎপাদন।

শুরুতে বিভিন্ন রকম ফসল উৎপাদন করে লোকসানে ছিলেন। তবে কয়েকবছর থেকে স্বস্তি এসেছে ভুট্টার আবাদে। এবার ধরলার চরে ২০ একর জমিতে করেছেন ভুট্টা চাষ। উৎপাদন অনেক ভালো হওয়ায় সব মিলিয়ে লাভের আশা করছেন আট লক্ষ টাকা।

আব্দুর রহমান দৈনিক জনকন্ঠকে বলেন, ‘এক সময় অনেক অভাব অনটন ছিল। পরনে জামা ছিল না। ছেলেদের নিয়ে কষ্টের শেষ ছিলো না। নদী ভাঙ্গনের সবকিছু যখন শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন হলোখানা থেকে এসে এখানে বসতি করি। শুরুতে বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করি। তবে সেখানে যেমন পরিশ্রম হয়েছিলো, যেমন টাকা খরচ হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ফসল পেতাম না। ফসল পেলেও দাম পেতাম না। গেল পাঁচ বছর ধরে এই ভুট্টা চাষ করছি। এই ভুট্টা চাষ করে আমি সফল হয়েছি। এ বছরও ২০ একর জমিতে ভুট্টাচাষ করেছি। আশা করছি সবকিছু বাদ দিয়ে আট লক্ষ টাকা লাভ হবে। সংসারে সুদিন ফিরেছে ভুট্টা চাষে।’

শুধু আব্দুর রহিম নয় জেলার শিক্ষিত বেকার যুবকেরাও ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষের দিকে। পাঁচগাছি ইউনিয়নের মাস্টার্স পাস করা তিন যুবক ধরলার চরে ছয় একর জমিতে চাষ করেছেন ভুট্টার। ধরলার চরে গিয়ে দেখা গেল ভুট্টা উত্তোলন ও মারাইয়ের কার্যক্রম। ছয় একর জমিতে ৪ লক্ষ টাকা উৎপাদন খরচ হয়েছে তাদের। সবকিছু বাদ দিয়ে তারা লাভের আশা করছেন তিন লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।

উদ্যোক্তা আতাউল করিম বলেন, ‘এবছর ধরলার বালু জমিতে আমরা তিন বন্ধু এই ভুট্টার চাষ করেছি। প্রতি একরে এবার ভুট্টার ফলন হবে ৩০-৩৫ মন। সাধারণত যারা ভুট্টার আবাদ করে তারা একর প্রতি উৎপাদন করতে পারে ১৭-২০ মন। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করেছি, তাতে উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। আমরা চাই আমাদের দেখে যেন অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়।’

কুড়িগ্রাম জেলায় শুধু এই ধরলা নদীর চরেই নয় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধ কুমর, ফুল কুমর, গঙ্গাধরসহ ১৬ টি নদীর অববাহিকায় হয়েছে এই ভুট্টার চাষ।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে আর অর্জিত হয়েছে ১৮ হাজার ৭ শত ৫০ হেক্টর জমিতে।

কুড়িগ্রামে চরের অনুর্বর বালু মাটিতে হয়েছে ভুট্টার বিপ্লব। নদী বেষ্টিত এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য চরাঞ্চল। আর এসব চরাঞ্চলে ক্রমশই জনপ্রিয় হচ্ছে ভুট্টার আবাদ। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে লাভ ভালো হওয়ায় দিন- দিন কৃষকরা ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষের দিকে।

প্রতিদিন ক্ষেত পরিচর্যা, উত্তোলন সহ নানাবিধ কাজে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ চলছে অবিরাম। প্রতিদিন কাজের বিনিময়ে পুরুষ শ্রমিক পান ৫০০ টাকা এবং নারী শ্রমিকরা পান ৪০০ টাকা করে। ভুট্টার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় তাই কিষান না হয়েও ভুট্টার গাছ, পাতান এবং মোচার বিনিময়ে অনেকেই কাজ করেন ।

এখানে শুধুমাত্র ভুট্টার মোচ্ছার বিনিময় কাজ করতে আসা মতিন মিয়া বলেন, ‘ভুট্টার আবাদ আসায় যেমন কৃষকরা লাভবান হয়েছে অন্যদিকে এখানে কাজ করে অনেকেই জীবন ধারণ করছেন। আমরা এখানে মোছার বিনিময়ে কাজ করছি।’

মমেনা বেগম বলেন, ‘আমরা এই ভুট্রার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার  করি। তাই গাছ কাটতেছি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি কুড়িগ্রাম এর জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার ডা. মো. মামুনুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘জেলায় আবহাওয়া ভালো হওয়ায় এ বছর কুড়িগ্রাম জেলায় ভুট্টা চাষ ভালো হয়েছে। ভুট্টা  একটি লাভজনক ফসল। আমরা নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি। তবে আমরা এখন কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি চরের যেসব অনুর্বর জমি আছে তাতে ভুট্টা চাষ করতে। তবে ধানি জমিতে ভুট্টা চাষ করতে আমরা নিরুৎসাহিত করছি।’

 

আরশি

×