ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

বিদেশী কর্মী নিয়োগে লাগাম টানছে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বিদেশী কর্মী নিয়োগে লাগাম টানছে সরকার

বিদেশী কর্মী নিয়োগে লাগাম টানছে সরকার

বাংলাদেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে লাগাম টানছে সরকার। সরকারের নির্দেশনা অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে যারা সাধারণ কর্মী হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন, তাদের ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নবায়ন করা হবে না। দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমানো, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 
দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়াতে কারখানার অপারেটর, টেকনিশিয়ান, মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও প্রকল্পের সাধারণ কর্মীসহ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যেসব কাজের জন্য পর্যাপ্ত জনবল পাওয়া যায়, ওইসব ক্ষেত্রে বিদেশী নাগরিকদের বাংলাদেশে কাজের অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন শুধু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মী নিয়োগে সরকারি অনুমোদন দেওয়া হবে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমানো, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের লক্ষ্যে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 
চলতি এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়ার সভাপতিত্বে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বর্তমানে যারা সাধারণ কর্মী হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন, তাদের ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নবায়ন করা হবে না। পাশাপাশি কেউ ভিসার শর্ত ভঙ্গ করছে কি না, সেটি দেখার জন্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) তিনটি টিম মাঠে নেমেছে।
কোনো বিদেশীর ক্ষেত্রে ভিসার শর্ত ভঙ্গ হলে অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য এসেছেন বা যে কাজের জন্য এসেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানে বা সেই কাজ না করলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে ফেরত পাঠানো হবে। ইতোমধ্যে  কয়েকজন বিদেশীকে ভিসার শর্ত ভঙ্গ ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণে কালো তালিকাভুক্ত করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে, সেসব দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া বন্ধ করা হবে। তবে সরকার আয়োজিত প্রোগ্রাম, আন্তর্জাতিক বা দ্বিপক্ষীয় টুর্নামেন্ট এবং প্রতিরক্ষা, জাতিসংঘ ও তাদের অধীনস্থ সংস্থার কর্মী ও কূটনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া অব্যাহত থাকবে। ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলার সঙ্গে সম্পৃক্তদের, বিশেষ করে ফুটবলারদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হবে না। 
পাশাপাশি বিদেশী কর্মীদের তথ্যভা-ার তৈরি করতে একটি সফটওয়্যার সিস্টেম চালু করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন-অ্যারাইভাল ভিসা, সফটওয়্যার সিস্টেমে বিদেশী নাগরিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে শীঘ্রই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অন-অ্যারাইভাল ভিসার জন্য অ্যাপ চালু করা হয়েছে। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. শামীম খান গত ২২ এপ্রিল বলেন, বিদেশী নাগরিকদের কর্মানুমতি, সফটওয়্যার বা অনলাইনভিত্তিক তথ্যভা-ার তৈরি করা এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে পরিপত্র জারির আগ পর্যন্ত বর্তমান নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পরিপালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশী নাগরিকদের কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের অনুরোধ করে। আরেক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধতা অর্জনের আবেদন করার সময় দেয়। এরপর গত ৩ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত সচিব শামীম খানকে প্রধান করে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। ওই টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে এক লাখ ৩৯ হাজার বিদেশী নাগরিক বৈধভাবে অবস্থান করছেন। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, দেশে প্রায় ৪৬ হাজার বিদেশী নাগরিক অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। সরকার অবৈধ বিদেশীদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রায় ১৫ হাজার বিদেশী এক্সিট পাস নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন। আর বাকিরা বৈধতার জন্য আবেদন করেন। ফলে, বর্তমানে দেশে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার বিদেশী নাগরিক বৈধভাবে অবস্থান করছেন। 
তবে শামীম খান বিদেশী নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের যে হিসাব পাওয়া যায়, তার সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, ডাবল কাউন্টিং হয়, অনেকে অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে এসে অবস্থান করছেন, নাকি ফিরে গেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। এসব কারণে বাংলাদেশে কত সংখ্যক বিদেশী কাজ করছেন, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশে যেসব বিদেশী রয়েছেন, তাদের ৫০ শতাংশের বেশি সাধারণ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানান তিনি। 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে এক জরিপে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এই সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩.১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। 
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪৪ টিরও বেশি দেশের নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে  ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, নরওয়ে ও নাইজিরিয়া। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশে রুশ নাগরিকদের উপস্থিতিও বেড়েছে। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করছেন তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও টেক্সটাইল খাতে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী কাজ করছেন। শিক্ষার্থী ও খেলোয়াড় রয়েছেন কয়েক হাজার। 
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিদেশী নাগরিকদের আয়ের ওপর করহার ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ কোনো বিদেশী ১০০ টাকা আয় করলে ৩০ টাকা কর দিতে হবে। এই কর যে প্রতিষ্ঠানে ওই বিদেশী চাকরি করেন, প্রতিমাসে বেতন-ভাতা দেওয়ার সময় কেটে রাখবে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান। বিদেশীদের ওপর কর পুরোটাই উৎসে কেটে রাখতে হবে। যথাসময়ে যথাযথভাবে কর না দিলে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বা ওই বিদেশী নাগরিককে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আয়কর আইনে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ বা প্রদেয় করের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান আছে। এছাড়া তিন বছরের জেল দেওয়ার সুযোগ আছে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, অপারেটর, টেকনিশিয়ান, মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হলে সমস্যা হবে না। কারণ, এখন দেশেই এ ধরনের পর্যাপ্ত কর্মী পাওয়া যাচ্ছে। বিজিএমইএর ঢাকা ও চট্টগ্রামের ফ্যাশন টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন ট্রেডে কোর্স করে বের হচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন কোর্স পড়াচ্ছে। তবে নতুন পণ্য চালু করার ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিশেষজ্ঞ আনা হয়। এছাড়া বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞানসম্পন্ন লোক বিদেশ থেকে আনা হয়।

আরো পড়ুন  

×