
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বৃহস্পতিবার দোহায় কাতার ইউনিভার্সিটিতে ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’ বিষয়ে বক্তৃতা করেন
তরুণ প্রজন্মকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম অভিহিত করে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদেরকে কল্পনা করতে, বড় স্বপ্ন দেখতে এবং নিজেদেরকে ‘তিন-শূন্য মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বৃহস্পতিবার কাতারের রাজধানী দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ শিরোনামে এক অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা প্রদান করেন।
প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই, তখন খুবই স্বস্তি বোধ করি। আমি নিজেকে তরতাজা অনুভব করি। তোমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম। আমি আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করি। তোমরাই সুপারম্যান আর সুপারউইম্যান।
অধ্যাপক ইউনূস হচ্ছেন ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার জনক এবং ২০০৬ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পান।
অধ্যাপক ইউনূস শিক্ষার্থীদের বলেন, এমন কিছু কর না যা ধনসম্পদের কেন্দ্রীকরণে অবদান রাখে। বরং কল্পনা কর এবং স্বপ্ন দেখ এমন একটি নতুন পৃথিবী গড়ার, যেখানে আত্মবিধ্বংসী পদ্ধতির কোনো স্থান নেই। অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক ইউনূসকে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদানের জন্য সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। নোবেল বিজয়ী ও ‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর’ বইয়ের লেখক অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে একটি উদীয়মান নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেন, যা মানবজাতি এবং পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই স্বপ্ন দেখতে হবে, কল্পনা করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি তুমি কল্পনা কর, সেটা তোমাকে সাহায্য করবে। কল্পনাকে অবহেলা কর না।’
অধ্যাপক ইউনূস তার ‘তিন শূন্য’ ভাবনার কথা তুলে ধরেন শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে এই প্রজন্ম আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশের রক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয় লামিয়া মোরশেদ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৃহস্পতিবার কাতারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি, যিনি একইসঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও, তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং দেশ পুনর্গঠনে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তিনি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজনকে মনোনীত করবেন। শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি ড. ইউনূসকে বলেন, আমরা আপনার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখি।
দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সুযোগ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সৃষ্টিসহ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পূর্ণ কূটনৈতিক, আর্থিক ও বিনিয়োগ সহায়তা কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমাদের তরুণদের স্বপ্নের দেশ গড়তে আপনাদের সহযোগিতা চাই।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী বিস্তৃত সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার জন্য কাতারে একটি টেকনিক্যাল টিম পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন।
বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা হয়। রোহিঙ্গারা যাতে মর্যাদার সঙ্গে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সমস্ত সহায়তার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সংলাপ আয়োজনে সহায়তার জন্য কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি সংকট সমাধানে আরও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি এবং এই সমস্যার টেকসই সমাধানে কাতারের অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
দুই নেতা ফিলিস্তিনের গাজা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। ড. ইউনূস দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, গাজাবাসীর দুর্দশা নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখনো নীরব। কাতারের প্রধানমন্ত্রী এই ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশংসা করেন।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গাজা সংকট তুলে ধরার জন্য আল জাজিরাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি গতকাল কাতারভিত্তিক এই সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও সুযোগ-সুবিধা নির্মাণসহ তাদের জন্য কাতারের সহযোগিতা কামনা করেন।
তিনি কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এই অনুরোধ শেখ মোহাম্মদ সানন্দে গ্রহণ করেন।
কাতারের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আহ্বান ॥ বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বুধবার রাতে কাতারের রাজধানী দোহায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশী কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে মালদ্বীপের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার রাজপরিবারের একজন সদস্য, মালয়েশিয়ার সাবেক একজন মন্ত্রী, কাতারের রাজপরিবারের একজন সদস্য, শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার এবং কয়েকজন ধনী প্রবাসী বাংলাদেশী উপস্থিত ছিলেন।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে একটি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তর করতে চায় এবং সব ধরনের বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়।
বাংলাদেশ এই অঞ্চলের মধ্যে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ হতে চাই।’ বিনিয়োগকারীরা উৎপাদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, ব্যাংকিং এবং পর্যটন- বিশেষ করে কক্সবাজারের রিসোর্ট জোনে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাইয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, আপনারা এ সুযোগ নিতে পারেন।’
তিনি নরওয়েজিয়ান টেলিকম অপারেটর টেলেনরকে বাংলাদেশে কীভাবে একটি টেলিফোন কোম্পানি গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল সে প্রেরণাদায়ক গল্পটি তুলে ধরেন, যা পরে টেলেনরের সবচেয়ে লাভজনক উদ্যোগে পরিণত হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফোরাম, কাতারের সভাপতি আজাদ আশরাফ স্বাগত বক্তব্য দেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সম্ভাব্য কাতারি বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সামনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনাদায়ী ঋণ ছিল, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৬০০ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে কাতার এনার্জির কাছে ২৫৪ মিলিয়ন ডলারের বকেয়া ছিল, যা বুধবারের মধ্যে শূন্যে নেমে এসেছে বলে তিনি জানান। তিনি জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নত অবকাঠামো নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন।
এদিকে পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের দোহা থেকে সরাসরি ইতালির রাজধানী রোমে যাবেন। আজ অধ্যাপক ইউনূসের রোমের উদ্দেশ্যে দোহা ত্যাগ করার কথা রয়েছে। তিনি চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দোহায় অবস্থান করছেন।