ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

নামেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

নামেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

একের পর এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করতেই সারাদেশে একের পর এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এসব বিশ^বিদ্যালয়ে  শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের চেয়ে সাধারণ বিষয়ে বেশি লেখাপড়া করছে। পরিস্থিতি এমন যে, বিশ^বিদ্যালয়গুলোর আসনের অর্ধেকের বেশি মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের দখলে।

এ অবস্থায় এসব বিশ^বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পৃথিবীতে বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয়গুলোর মূল কাজ গবেষণা ও এর প্রয়োগ। কিন্তু আমাদের দেশে সব পর্যায়ের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে রিসার্চ (গবেষণা) উপেক্ষিত রয়েছে। জনগণের টাকায় এখন প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও একই হাল দেখা যাচ্ছে। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষায়িত দক্ষ স্নাতক তৈরির ভাবনা থেকেই দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে সেই লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিষয় পড়ানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না কৃষি সম্পর্কিত বিষয়ও। প্রতিবছর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেক শিক্ষার্থীই ঢুকছে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ে। এই প্রবণতার লাগাম টানতে সম্প্রতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দেশনা পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে করে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ইংরেজি, আইন ও  বিবিএর মতো বিষয় পড়ানো বন্ধ হতে পারে।

এভাবে সব বিষয় পড়াতে থাকলে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সফল হবে না মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে অবশ্যই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। তবে বিশেষায়িত বিষয়কে সাহায্য করে এমন কিছু কলা, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিষয় থাকা দরকার। সেটির গুরুত্ব যেন কোনোভাবেই মূল বিষয়ের চেয়ে বেশি না হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি এটি মানা হচ্ছে না। এতে করে মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের প্রতি অবিচার হচ্ছে। 
বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিংগুইশড অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এখনই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়ে গেছে, সেগুলো হুট করে বন্ধ করা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আর নতুন করে যেন এসব বিভাগ খুলতে না পাওে, সেদিকেও ইউজিসির খেয়াল রাখা উচিত।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, এই শিক্ষাবর্ষে ১৪ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৯ হাজার ৫২৯টি আসন রয়েছে। যার মধ্যে কলা, মানবিক ও ব্যবসায় অনুষদভুক্ত বিষয়ে আসন রয়েছে ৪ হাজার ২২৯ টি। অর্থাৎ মোট আসনের অর্ধেকই বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ে। আবার কোনো কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের বাইরের শিক্ষার্থীই বেশি। 
ভর্তি বিজ্ঞপ্তির তথ্য বলছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে মোট ৯৮৫ টি আসন রয়েছে। যার মধ্যে ৫৮১ টি আসনই মানবিক ও বাণিজ্য অনুষদের। এছাড়াও হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১ হাজার ৭৯৫ টি আসনের মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরের আসন ১ হাজার ৫৫ টি, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫০৫ আসনের মধ্যে ৮৭০ টি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫৬৪ টি আসনের মধ্যে ৭৫১ টি বাইরে বিষয়ের আসন।   
ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫৫ টি সরকারি ও ১১৬ টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। যার মধ্যে ১৪ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে আরও ৪টি। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদের অধীনে ২৭ টি বিভাগ রয়েছে। ইনস্টিটিউট রয়েছে আরও ২টি।

যার মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরে কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ক ১০ টি বিভাগ আছে।  কৃষি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারেনি। নয়টি অনুষদের মধ্যে কৃষি ও বিজ্ঞানের বাইরে দুটি অনুষদ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ও পড়ানো হয়। মোট বিভাগ আছে ৪৫ টি। 
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীন ১৯ টি বিভাগ রয়েছে। ছয়টি অনুষদের তিনটিই বিজ্ঞানের বাইরের। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও আট অনুষদের অধীনে ৫৮ টি বিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে সাতটি বাইরের বিষয়ে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদের অধীনে ৩১ টি বিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয় ১২ টি। 
অভিযোগ রয়েছে, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ে বিভাগ খোলার পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ। প্রতিষ্ঠার সময় যেসব উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার দায়িত্বে থাকেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আত্মীয়স্বজন অগ্রাধিকার পান। ফলে, তারা ইউজিসিকে ম্যানেজ করে বেশি বিভাগ খোলেন। আবার কোনো কোনো ইউজিসি কর্মকর্তারও এখানে স্বার্থ জড়িত থাকে।

বিষয়টি অনুধাবন করে গত ১৩ মার্চ দেশের সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশেষায়িত বিষয়ের বাইরে সাধারণ বিষয় পড়ানো বন্ধে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এ এস এম কাসেম এই চিঠি দিয়েছেন। 
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে একই ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া কিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন বিষয়েও শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, ‘কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। সেখানে বিশেষায়িত বিষয়ের বাইরে সাধারণ বিষয়গুলোকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
এদিকে শুধু পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় নয়, বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। এক্সিম ব্যাংক কৃষি ভার্সিটিতে বিএস এগ্রিকালচার, বিএস এগ্রিকালচার ইকোনমিকসের মতো বিষয়ের সঙ্গে বিবিএ ও আইন বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। 
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, বিশেষায়িত বিষয়গুলোর গুরুত্ব আরও বাড়াতে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে সামাজিক বিজ্ঞান বা ব্যবসায় বিষয়গুলো বন্ধ করা যাবে না। অনেক সময় বিজ্ঞানের বিষয়কে সাপোর্ট করার জন্য বাইরের বিষয় পড়াতে হয়। ফলে, এ উদ্দেশ্যে বাইরের বিভাগ খোলা হলে ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমান প্রবণতা হলো বিশেষায়িত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে সাধারণ বিষয়ের গুরুত্ব বাড়ছে।

×