
ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতির মহোৎসব
দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। একদিকে যেমন টাকা ছাড়া নাম জারি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তেমনি এলএ শাখায় চলছে সরকারি টাকা আত্মসাতের প্রতিযোগিতা। অধিগ্রহণ করা জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে তা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এমন এক ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে। এতে নাম উঠে এসেছে সংশ্লিষ্ট অনেকের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসন থেকে ভূমি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা জড়িত। তাই এদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বড়জোর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পরে তা আবার সমাধান হয়ে যায়।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জাহিদ হাসান জনকণ্ঠকে প্রথমে বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত নই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাঠানোর কয়েকদিন পর তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ তদন্ত কমিটির প্রধান কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
এটি দেখার দায়িত্ব তো আপনার ওপর রয়েছে। আপনার দায়িত্ব থাকার পর এ ঘটনা ঘটল। আবার আপনাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে কতটুকু নিরপেক্ষ তদন্ত আশা করতে পারি। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমারই দায়িত্ব ছিল। বিষয়টি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে।’
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বিভিন্ন মৌজায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। রূপগঞ্জ উপজেলার ২১/২০২১-২০২২ নম্বর এলএ কেসের মাধ্যমে অধিগ্রহণ কার্যক্রম ২০২১ সালে শুরু হয় এবং ২০২২ সালে ৪(১) ধারায় নোটিশ জারির পর ৪(৭) ধারা মোতাবেক নোটিশ জারির পর অসৎ উদ্দেশ্যে সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। যা সর্ম্পূণ বেআইনি। আইনে বলা আছে ৪(৭) ধারা মোতাবেক নোটিশ জারির পর কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে তা যৌথ তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্যে ৪(৭) ধারা মোতাবেক নোটিশ জারির দীর্ঘদিন পর প্রকল্প সংশোধন করে বাস্তব শ্রেণি পরিবর্তন করতে সযোগিতা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে যে বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছে, তার জমি শ্রেণি পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক করা হয়েছে। আর সুবিধা দিতে রাজি না হলে বাণিজ্যিক করা স্থানের জমি রয়ে গেছে আগের শ্রেণিতে। এই জমির রেকর্ডীয় শ্রেণি ডোবা, নাল, খাল, বাড়ি ইত্যাদি হলেও বিশেষ সুবিধায় রাতারাতি তা বাণিজ্যিক বনে যায়। এতে এই একটি প্রকল্পে শুধু ভূমি অধিগ্রহণে সরকারকে অতিরিক্ত ব্যয় মিটাতে হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরপা মৌজার ৩৯১ নম্বর দাগে আলামিনের মুদি দোকানকে বাণিজ্যিক, কিন্তু পাশে সুমি আক্তারের দোকানকে দোকান হিসেবে দেখানো হয়েছে। একই মৌজার ৭৭২ নম্বর দাগে মনিরুল আলমের মার্কেটের মতো দোকানকে দোকান হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ৭৭৩ নম্বর দাগে হাজী মোখলেছুর রহমান ৪(১) ধারা নোটিশের পর ফ্যাক্টরি সেড নির্মাণ করে তা দেখিয়ে একই দাগে তিন জনের জমিই বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। আবার ৭৭৬ নম্বর দাগে ইমাম হোসেনের স্থাপনাই নেই। অথচ তার জমিকেও বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। একই মৌজার ৭৮৪ নম্বর দাগে লোকমান হোসেনের জমিকেও বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে।
এ ছাড়া, ৭৮৭ নম্বর দাগে হাজী চিনু ব্যাপারীর দোকান, ৭৮৯ নম্বর দাগে আবুল হোসেন সাঈদের দোকান এবং ৭৯০ নম্বর দাগে শাহ আলম, নুরুজ্জামান, আসলাম ভূইয়া ও মোরসালিন ভূইয়ার দোকানগুলোকে বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে।
খাদুন মৌজায় ৯২ ও ৯৫ নম্বর দাগে খালি জমিকে বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। অথচ আধুরিয়া মৌজায় টেক্সটাইল মিলের ও মোহনা মৌজার ৩১, ৩৩, ৩৮, ৩৯, ১১৯, ১২০, ১২১ নম্বর দাগে স্পিনিং মিল ও টেক্সটাইল মিলের খালি জমিকে ভিটি দেখানো হয়েছে। একই মৌজার ৪৩২ নম্বর দাগে মাহবুব আলমের দোকানকে বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। আবার ১০৬ নম্বর দাগের শাহিন ভূইয়া ও নূরুল হকের দোকানকে দোকান শ্রেণি দেখানো হয়েছে। ১০৭ দাগে ইমাম হোসেনের দোকানকে দোকান হিসেবে দেখানো হয়েছে। ১৯৬ নম্বর দাগে লক্ষ্মী রাণীর দোকানকে দোকান হিসেবে দেখানো হয়েছে।
একইভাবে ভুলতা মৌজার ১৬৫৪, ১৬৫৫ এবং ১৬৫৯ নম্বর দাগে চাঁন মিয়া, জসিম ও নুরু মিয়ার জমি দোকান হিসেবে দেখানো হয়েছে। আধুরিয়া মৌজার ৮০১ দাগে হামিদা বেগমের জমিতে কোনো স্থাপনা না থাকলেও সুকৌশলে তা বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। ৮০৫ নম্বর দাগে জামান মোল্লার দোকানের ভূমিকেও বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। ৮২৯ নম্বর দাগে জহিরুল আসলামের চায়ের দোকানকে বাণিজ্যিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। ৮৩৮ নম্বর দাগে রাবেয়া আক্তারের দোকানকে বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে।
আবার ৮৪২ নম্বর দাগে জসিম মোল্লার কোনো স্থাপনা না থাকলেও তা বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে, ৮৪৩ নম্বর দাগে রাবেয়া আক্তারের কোনো স্থাপনা না থাকলেও তার জমি বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। মোহনা মৌজার ৮৯ নম্বর দাগে যৌথ তদন্তে ফিল্ডবুক মোতাবেক রুবিনা বেগমের কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম দেখা যায় না বলে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে রান্নাঘর, মুরগির ঘর দেখা গেছে। অথচ তা বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। ১০৯ নম্বর দাগেও যৌথ তদন্তে কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম না থাকলেও তা বাণিজ্যিক দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
কেশরাফ মৌজায় ১৩২৮ নম্বর দাগে সুফিয়া বেগমের জমিকে বাড়ি, দোকান ও বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। অথচ সেখানে আলিফ স্টোর নামের একটি দোকান রয়েছে। সুকৌশলে এটিকে বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। ১৩৭০ নম্বর দাগে মাসুদা আক্তারের অর্ধেক জমি বাণিজ্যিক আর অর্ধেক আবাসিক। কিন্তু পুরোটাকেই বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। এছাড়া ১৩৭২, ১৩৮০, ১৪১৬, ১৪১৭ নম্বর দাগে কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম না থাকলেও তা বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে।
এভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের কাছ থেকে কয়েকগুণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট চক্র। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এ কাজ করে থাকে এলএ শাখার কানুনগো, সার্ভেয়ার, সড়ক ও জনপথের সার্ভেয়ারসহ সংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ চক্র। ভূমি অফিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার এসি ল্যান্ড, এডিসি (রাজস্ব), ডিসি, বিভাগীয় কমিশনারকে নিযুক্ত করেছে। সারাদেশে এভাবে সরকারি অর্থ হরিলুট করে অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাচ্ছেন। সরকার তদারকের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মকর্তা নিযুক্ত করলেও অনেক ক্ষেত্রে তারাও এতে সামিল হচ্ছেন। এর দায় কে নেবে?