
দুই বছরের কাজ শেষ হয়নি ছয় বছরেও
দুই বছরের একটি আন্তঃজেলা মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প ছয় বছরেও শেষ করা যায়নি। প্রকল্পটি হচ্ছে নীলফামারী আন্তঃজেলা মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২ বছর। কিন্তু অদ্যাবধি প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়নি। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের উদাসীনতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল স্থানীয়দের অসহযোগিতা। দীর্ঘদিনেও প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে অব্যাহতি নেয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
বরং প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্পের উপযুক্ত সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্টাডি নিয়ে। সন্দেহ তৈরি হয়েছে আদৌ সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে কি না? এরই মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে পুনরায় প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলেও, তা নাকচ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, রিজিওনাল কানেক্টিভিটি বা আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালের ১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন করা হয় নীলফামারী জেলার ‘ডোমার-চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ (জেড-৫৭০৬), ডোমরা (বোড়াগাড়ী) জলঢাকা (ভাদুরদরগাহ) (জেড-৫৭০৪) এবং জলঢাকা-ভাদুরদরগাহ-ডিমলা (জেড-৫৭০৩) জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প। ৪২১ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ ৩০ জুন ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেই সময় অতিক্রম করেছে ৪ বছর আগে।
অদ্যাবধি চলমান এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে ৪র্থ বারের মতো মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, যদিও তাতে সায় দেয়নি মন্ত্রণালয়। প্রকল্প গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দের পরও প্রায় ৬ বছরে কার্যক্রম শেষ করতে না পারায় এর ফিজিবিলিটি টেস্ট বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনকি অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের ফলে বাড়তি ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পটির আওতায় ৩টি সড়ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ডোমার-জলঢাকা এবং জলঢাকা-ভাদুরদরগাহ-ডিমলা জেলা মহাসড়ক দুইটির যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণের কাজ শেষ হয়েছে। ডোমার-চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ সড়কের দৈর্ঘ্য ২৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। মূল অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) দীর্ঘ সড়কটির ২০টি স্থানে বাঁক সরলীকরণে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য নতুন অ্যালাইনমেন্টে সড়কের নির্মাণ কাজের সংস্থান ছিল। ২০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার সড়কে নির্মাণ কাজে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে ৭ দশমিক ৯১ কিলোমিটার সড়কে বাঁক সরলীকরণ ও প্রশস্তকরণের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ৩৮ দশমিক ৫৬ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার বরাদ্দ ছিল। এই ভূমি অধিগ্রহণে ৪ ধারায় নোটিস জারির পর স্থানীয় কিছু মানুষ ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে আপত্তি দেয়। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত এই আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য গত ২৩-১২-২০২৩ তারিখে ভূমি মন্ত্রণালয়ে নথি প্রেরণ করা হয়। এরপর গত ২৪-০৪-২০২৪ তারিখে ৫টি বিষয়ে তথ্য চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় হতে উক্ত নথিটি নীলফামারী জেলা প্রশাসকের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত তথ্যাদি প্রেরণের কাজটি চলমান আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ৫টি প্যাকেজে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ১ ও ২ নং প্যাকেজ ব্যতীত বাকি ৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। অপরদিকে ১ ও ২ নং প্যাকেজের ভৌত অবকাঠামোর অগ্রগতি হার ৭৫ শতাংশ ও ৬২ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘদিন স্থবির রয়েছে এর কার্যক্রম। ফলে প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখেই কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে আবেদন জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে গত ১২ মে ২০২৪ তারিখের অনুষ্ঠিত পিএসসি সভায় ঠিকাদারকে অব্যাহতি দিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু চলমান প্রকল্পের ঠিকাদার অব্যাহতি নিলে কাজটি কিভাবে সমাপ্ত হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে ওইদিন অনুষ্ঠিত পিএসসি সভার এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, সভায় ১ ও ২ নং প্যাকেজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও এই দুইটি প্যাকেজকে যুক্ত করে তৃতীয় আরেকটি প্যাকেজ করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বশেষ রেট অব শিডিউল মেনে নির্ধারিত সীমার মধ্যেই কাজটি সম্পন্ন হবে। তবে এজন্য অতিরিক্ত ১ বছর সময় লাগবে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় উপদেষ্টার এক নির্দেশনার আলোকে রংপুর জেলা সওজ অফিসের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ভূমি অধিগ্রহণের কাজটি পরিহার করার বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।
একইসঙ্গে বর্তমানে অ্যালাইনমেন্টে প্রয়োজনীয় ট্রাফিক সাইন স্থাপন করে অবশিষ্ট সড়কাংশ ৩ দশমিক ৭০ মিটার থেকে উন্নীত করে ৫ দশমিক ৫০ মিটার প্রশস্ত করে প্রকল্পটির কাজ সমাপ্ত করার পরামর্শ দেন। গত ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় ভূমি অধিগ্রহণ সন্তোষজনক না হওয়া এবং ১ ও ২ নং প্যাকেজের কাজ অসমাপ্ত থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
প্রকল্পটির অগ্রগতি ও অর্থছাড় নিয়েও একাধিক বৈপরীত্য রয়েছে। নীলফামারী সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত তথ্যমতে, প্রকল্প শুরু থেকে জুন’২৩ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয় ১৭১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই সময়ে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৮০ শতাংশ দেখালেও আগস্ট’২৩ এর প্রতিবেদন প্রকল্পটির আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৭১ শতাংশ দেখিয়েছে। সে সময়ে প্রকল্পটি ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ৯০ কোটি টাকা অর্থছাড় করা হয়।
কিন্তু ৯০ কোটি টাকা অর্থছাড় হলেও ওই সময় পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটে ওই অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ হ্রাস করে ৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা করা হয়। নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭১ কোটি ৮৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। অপরদিকে ওই সময়ে ক্রমপুঞ্জীভূত অগ্রগতির মধ্যে আর্থিক অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশ দেখালেও ভৌত অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৯০ শতাংশ দেখানো হয়েছে।
অথচ অক্টোবর’২৪-এ এসে প্রকল্পটির পুঞ্জীভূত ব্যয় ১৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকায় আর্থিক অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৮৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকল্পটির অগ্রগতির তথ্য যে সঠিক নয়, তা প্রতীয়মান হয়।
এই বিষয়ে নীলফামারী সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পটি ১ ও ২ নং প্যাকেজ ছিল রাস্তা নিয়ে। অপরদিকে ৩ নং প্যাকেজটি ছিল ব্রিজ-কালভার্ট সংক্রান্ত। ৩ নং প্রকল্পটি সম্পন্ন হলেও ১ ও ২ নং প্যাকেজ অসমাপ্ত রয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত ৪ বছর হয়ে গেলেও কেন কাজটি সমাপ্ত হয়নি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা নেই, বরং সমস্যা হলো প্রসেসিংয়ে। প্রকল্প অনুমোদনকালে যিনি জেলা প্রশাসক ছিলেন তিনি এরপর ১ বছর ছিলেন, কিন্তু এই সময়ে প্রকল্পের কাজে হাতই দেননি। পরবর্তীতে যিনি এসেছিলেন তিনি কাজে হাত দিলেও কয়েকদিন পরেই বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এরপর বর্তমান ডিসি স্যার এসেছেন ৫ আগস্টের পর।
ওই কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে যতবার এডিসি পরিবর্তন হয়েছে ততবার নতুন এডিসি এসে আগের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন, অনেক ছোটখাটো ডিজাইন যেমন- মসজিদ, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স এসব পরিবর্তন করেছেন। এরই মধ্যে দেখা গেছে, যেসব ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেসব ভূমির মালিক বেশি টাকা পাওয়ার আশায় এসব জমিতে ঘরবাড়ি তুলেছেন। ফলে এসব ঘরবাড়ি রাখবে নাকি বাদ দেবে এ নিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এ কারণেই মূলত ভূমি অধিগ্রহণ বিলম্বিত হয়েছে, অন্য কোনো কারণ নেই।
প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে বলেন, মেয়াদ আরও ১ বছর বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমরা মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছি, কিন্তু মন্ত্রণালয় বাড়াতে চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কি?- এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য আমাদের ১৫৮ কোটি টাকা ধরা ছিল। ডিপিপিতে বলা ছিল চিলাহাটিতে একটা পোর্ট হবে।
বর্তমান সরকার এই পোর্ট বাদ দিয়েছে। আমাদের টেকনিক্যাল উইং এখন পর্যাপ্ত ট্রাফিক সাইন দিয়ে ও ১২ ফুটের পরিবর্তে ১৮ ফুট করে এবং যদি সম্ভব হয় বাঁকের ভেতরে একটু অতিরিক্ত প্রশস্ত করে সড়কের কাজটি শেষ করার পরিকল্পনা করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে, কিন্তু সরকার সময়ই দিতে চাচ্ছে না। হয়তো ভবিষ্যতে মেনটেন্যান্সের ফান্ড থেকে অনুমোদন দেওয়া হবে।
তবে এক্ষেত্রে সমস্যা আছে বলে মনে করেন সওজ’র এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বাঁকগুলো আমরা যেভাবে সরল করে ফেলব, এতে ভবিষ্যতে ভূমি অধিগ্রহণ আরও ব্যয়বহুল হবে। কারণ জমির দাম বাড়বে, নতুন করে বাড়িঘর উঠবে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এলাকাবাসীও অসহযোগিতা করেছে- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন খেতের মধ্যে দালান তৈরি করা হয়েছে, পরে ছাদ ভেঙে পড়েছে। এসব করা হয়েছে ইচ্ছা করে, একটু বেশি দামের আশায় এখন নিজেরাই ধরা খেয়েছে। অধিগ্রহণ না হলে এসব ঘরবাড়ি এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে তেমন ট্রাফিক নেই। সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক হলো মোটরবিহীন যানবাহন এবং মোটরসাইকেল। বাস যায় মাত্র দুইটি, অনেক সময় তাও না। আর ট্রাকও খুব কম, দিনে হয়তো ১৫-২০টি। এখানে যে রাস্তার বাঁকগুলো আছে সেগুলো খুবই সূক্ষ্ম। এগুলো সরলীকরণের জন্যই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল এবং বাঁকগুলোর জায়গাতেই সড়কের কাজ বন্ধ আছে।
প্রকল্পের ঠিকাদার চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ঠিকাদারের তো এতদিন থাকার কথা না। ২০১৯ সাল থেকে এই কাজ চলছে। সময় বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মিটারে তার অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তারপরও তাকে এতদিন ধরে রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আর সম্ভব হয়নি। সচিব স্যারের অনুমতি নিয়ে তার দেনা-পাওনা পরিশোধ করে অব্যাহতি দিয়েছি।